
ছাত্র জীবনে বহু চিঠি লিখেছি ,পাড়া প্রতিবেশীদের ফরমায়েশি চিঠি। এক বড়মা ছিলেন, দুবাইয়ে ছেলেকে চিঠি লিখাতেন আমাকে দিয়ে। লিখা শেষে পড়ে শোনালে আমাকে অনেক দোয়া করতেন। এক বড় বোন ছিলো, শশুর বাড়ি থেকে আসতেন, আমাদের বাড়িতে দুদিন থেকে আমাকে দিয়ে প্রবাসী স্বামীকে চিঠি লিখাতেন। সেই চিঠি পড়ে মানুষটার নাকি রাগ পড়ে যেত। আমি মোটামুটি ইন্ট্রোভার্ট তাই নিজের মানুষটাকে ও মুখ ফুটে মনের কথা বলতে পারতামনা, বেশি মন খারাপ হলে চিঠির আশ্রয় নিতাম! আমার বেরসিক স্বামী চিঠি পড়ে মৃদু হেসে বলতেন ” চিঠি তো ভালোই লিখ “।
সেসব চুকেবুকে গেছে কবেই, বহমান সময়ের পরিক্রমায় আমার আবেগগুলো ও সাবালকত্ব পেয়েছে।
যা-ই হোক আজ আমি আমাকে চিঠি লিখছি __
প্রিয় আমি!
আজ তোমাকে বলবো, আমি কেমন আছি, আমার নিজের সমুদয় সুখ দুঃখ কিংবা কুশল। আমি আসলে হৈহল্লা পছন্দ করিনা। নিরিবিলি নিরবচ্ছিন্ন থাকতে পছন্দ করি, আমি সবসময় অন্যকে কষ্ট না দিয়ে নিজের মতো ভালো থাকি, ভীষণ ভাবে বর্তমানের আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকি, অতীত আমার কাছে শুধু একটা আয়না যাতে আমি নই প্রতিবিম্ব থাকে। আর ভবিষ্যত হচ্ছে আশা যা আমাকে আগামী দিন বাঁচার হাতছানি দেয়। তবে সুখ -দুঃখের পাশাপাশি বিষাদের সাথে ও আমার কোন বিবাদ নেই। বিষাদ আমার মরচেধরা মনকে শানিত করে, এক কাপ কফি বানাতে উদ্বুদ্ধ করে, আমি ফের সুখের স্বাদে আস্বাদিত হই। হ্যাঁ প্রিয় তুমি ঠিক ধরেছ আমি কিছুটা দুঃখ বিলাসী। তবে সেটা অমূলক দুঃখ নয়, শত ভাগ খাঁটি দুঃখ! তাই দিয়ে আমি আমার বলয় ঘিরে সাজাই বাগান বিলাস, ব্যর্থ হলে সাজাই কাঁটায় ভরা ক্যাকটাস! দিনলিপির পাতায়…..
এ সপ্তাহে লিখেছিলাম হালে আমি কেমন আছি, উগড়ে দিয়েছি যতো রাগ, অনুরাগ। তুমি তো জানোই আমার আবার ভুংভাং লেখার বাতিক আছে। আমার ডায়েরির কাছে জমা রাখা অসংলগ্ন এলোমেলো আলাপচারিতার কিছু অংশ তোমাকে জানাচ্ছি ___
এক জীবনে আর আমার বলে কিছু হলোনা, মাটি, পানি, বায়ুর মিশেলে যে জীবন বয়ে বেড়াই সে ও তো আমার নয়। সেই মহান স্বত্তা যখন চাইবেন তখনই তো সে উড়াল দিবে। আপন বলে ভাবি যাদের তারা ও কি আপন?
তারা কি বোঝে কতোটা সয়ে আজ আমি খিটখিটে,তারা কি দ্যাখে কখন আমার চোখ বেয়ে কতোটা জল গড়ায়, কতোবার মেঘের ঘনঘটায় অন্তর চেয়ে যায়, ঘর্ষণে বিজলি চমকে আমাকে জ্বলসে দেয়,ভেতরে কতো জ্বলোচ্ছ্বাস মুহূর্মুহু আঘাত হানে, মন কেমনের বিষন্ন হাওয়ায় নিরিবিলি দুপুরে আমার কতোটা একলা লাগে? তারা চায় আমি ভালো থাকি, আমাাকে ভুলে থাকি। সব ইচ্ছেদের মাটিচাপা দিয়ে আমি হাসির ফোয়ারা ঝরাই! তারা আমাকে ভালোবেসেই প্রকারান্তরে এমন উপদেশ দেয়। আমি ও তাদের এহেন ভালোবাসায় গা ভাসাই, ভিজতে চাই আকন্ঠ! কিন্তু কেন যেন শুষ্ক রুক্ষতায় আমার চামড়া ফেটে যায় জ্বলুনি হয়, কোমল পেলব পরশের তৃষ্ণায় ছটফট করি, না তারা তখনো টের পায়না। একজন ছিলো যে আমার না বলা কথা, অব্যক্ত ব্যথা বুঝতে পারতো। সে-ও পালিয়ে বেঁচেছে না ফেরার দেশে। বিনা তারে খবর পান যিনি সন্তানের উহ্ শব্দের! হ্যাঁ তিনি আমার মা। সেই থেকে আর কেউ আমার জন্য উদ্বেগে উদ্বেল হয়নি! আমিও আাশার ভেলায় নিরাশাকে ভাসিয়ে দিয়েছি! বুঝে গেছি জীবনের নিগূঢ় সত্য। জন্মঋণ শুধতে এসেছিলাম তোমাদের তরে, তাইতো ভালোবাসি, কর্তব্যে ফাঁকি দেইনি কখনোই। তারা যে আমার নাড়িছেঁড়া ধন! আমার সহোদর আপনজন। দিনশেষে তাদেরকে আঁকড়ে ধরেই পরবর্তী দিনলিপি সাজাই। আমার সুখ, আমার দুঃখ, আমার বিষাদ,আমার যন্ত্রণা একান্ত আমারই থাক।
বুঝলে তো আমার আমি?এগুলো ছিলো অভিমান! আমি ভালো আছি, বেশ ভালো আছি। এই চল্লিশের কোঠায় দাঁড়িয়ে এটুকু বলতে পারি ‘জীবন অদ্ভুত সুন্দর’!
গড় আয়ু যখন সন্নিকট বর্তী তখন প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেব গোলমেলে হলেও বেঁচে থাকা, দুচোখ ভরে দেখতে পাওয়া হয়ে উঠে জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।
জীবন তো এক বহমান নদী এর বাঁকেবাঁকে সৌন্দর্য!
স্বাদ হয়তো আলাদা।
৯টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি
জীবন তো এক বহমান নদী এর বাঁকেবাঁকে সৌন্দর্য
ঠিক তাই।সাগরের ঢেউয়ের ন্যায় বহমান জীবন কত বিচিত্র রঙ; ছড়ায়।তবুও জীবন বহমান জীবনের নিয়মে।
ভালো থাকবেন।সুস্থ থাকবেন।
চিঠি ভালো হইছে।
আলমগীর সরকার লিটন
না আসলেই খুবি সুন্দর চিঠি লেখতে পারেন স্যালুট জানাই কুবরা আপু
মোঃ মজিবর রহমান
আসলেই একটাই কথা জীবন অদ্ভুত সুন্দর- যেভাবে সাজাবে সেভাবেই পাবে। সেটা ভুলে হোক আর স্বজ্ঞ্যনে হোক। সুন্দর জিবনের উপস্থাপনা। সুস্থ থাকুন।
ছাইরাছ হেলাল
অবশ্যই সাবালকত্ব পেয়েছে, আর ও পাবে, তা এ লেখায় বুঝতে পারছি,
ভুংভাং শব্দ তো আর এমনিতে আসে না।
লিখুন এবং লিখুন, সে চিঠি আকারে বা ডায়েরির মত করে, কবিতা হলে তো কথাই নাই।
সঠিক উপলব্ধি এ লেখায়, আমরা একা আসি একাই ফিরে যাব, এখানে সামান্য একটু এদিক-সেদিক।
ভাল থাকবেন লিখে লিখে, প্রাণ খুলে, আমাদের সাথে।
রোকসানা খন্দকার রুকু
বাহ অসাধারণ আমিত্ব ভরা চিঠি। এমন আমারও হয়। তবে না বলতেই বুঝতে পারা মানুষটা অন্যপ্রেমে মজে থাকে এ বড় কষ্টের। লিখো লিখো আরও চিঠি লিখো। কিছু ভাষা, শব্দ চুরি করতে চাই।।।
অনেক ভালোবাসা রইলো।।।
অনন্য অর্ণব
পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীই একা এবং সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্যের। কেউই কারো দায় নেবে না, নিতে চাইবেও না।
বাবা মা ভাই বোন আত্মীয় পাড়া প্রতিবেশী কেউ না, কেউই আপনাকে তুলে ধরবে না। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে আমরা যখন একা কোন কাজ করতে না পারি তখনই আমরা অন্যের সরণাপন্ন হই। আর এখান থেকেই সংসার সমাজের সূত্রপাত। প্রকৃতপক্ষে একটা সময় কেউই আর পাশে থাকে না।
নিজেকে বললেও কথাগুলো ছিলো সার্বজনীন। মিলে যায় হয়তো অন্য কোথাও, অন্য কারো জীবনের সাথে।
হালিমা আক্তার
একসময় তোমার মতো আমিও প্রক্সি চিঠি লিখতাম। মাঝে মাঝে চিঠি পড়েও শোনাতে হত। কোথায় গেল সেই দিনগুলি।
নিজেকে নিয়ে খুব চমৎকার চিঠি লিখেছো।
জীবনের বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে থাকে দুঃখ-কষ্ট আনন্দ-বেদনা। ইচ্ছা অনিচ্ছায় সব কিছুই বহন করে নিতে হয়। খুব ভালো লাগলো ব্লগে তোমার লেখা দেখে। আশাকরি আরো নতুন নতুন লেখা পাব। শুভ কামনা রইলো।
রেজওয়ানা কবির
আমিকেই আমি এতো সুন্দরভাবে চিঠি লেখা যায় না পড়লে বুঝতাম না। তবে আপু সত্যি জীবন এরকমই।
যতদিন আছি আমিটা আমিকেই বলতে পারি এও বা কম কিসে? অনেক ভালো লাগা রেখে গেলাম, শুভকামনা আপু।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আসলেই জীবন অদ্ভুত সুন্দর — “বুঝলে তো আমার আমি?এগুলো ছিলো অভিমান! আমি ভালো আছি, বেশ ভালো আছি। এই চল্লিশের কোঠায় দাঁড়িয়ে এটুকু বলতে পারি ‘জীবন অদ্ভুত সুন্দর’!”।