“আমার শৈশব ও শেকড়ের সন্ধান”
ইতিহাস আমার খুব প্রিয় বিষয়। ইতিহাস না জানলে মানুষের জীবনটা অপূর্ণ রয়ে যায়, এটা কেনো যেনো আমার মনে হয়। ইতিহাস পড়তে পড়তে আজ মনে হলো আমার বংশের ইতিহাসটা লিখে রাখি শৈশব কিছু স্মৃতির সাথে। আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি কিছুটা জানতে পারে তবে তৃপ্তি পাব। যদিও জানি, বংশের এক পুরুষ থেকে আর এক পুরুষের ডালপালার বিচরন, দিনে দিনে ভাগ্য-বিপর্যয় এবং স্থান পরিবর্তন হওয়ার কারনে যেকোনো বংশের জায়গির ক্রমশ ছোটো হয়ে অবশেষে বিলিপ্ত হয়। আমার বংশেরও তাই হয়েছে। আমার বাবার চার মেয়ে। তাই বংশ ধরে রাখার আর কেউ রইলো না। কিন্তু প্রজন্ম তো থাকে। অবশ্য এ কথাও ঠিক যে, কোনো কোনো বংশের ভাগ্য কিন্তু আবার সু-প্রসন্নও হয়।
ইতিহাসবেত্তা ইবনে খালুদুনের মতে কোনো মানুষের চার বা পাঁচ পুরুষের নাম মনে রাখা কঠিন ব্যাপার। আজ তার সত্যতা উপলব্দি করতে পারছি। আমি ইতিহাস পড়লেও মোটেও ইতিহাসবেত্তা নই। তাই মৌখিকভাবে শুনে শুনে আমার পূর্ব পুরুষের কথা লেখা একটু কঠিনই মনে হচ্ছে। আজ মন থেকে আরো বেশি করে ইতিহাসবেত্তাদের সালাম জানাই। একটা জাতির জীবন যাত্রা পাঠকের সামনে তুলে ধরা রিস্কিই বটে। বড় বেশি মুশকিল।
“কোনো মানুষের পক্ষে নিজের বিষয় লিখতে যাওয়া যেমন সুখকর, তেমনি কঠিন। নিজের কোনো অকীর্তির কথা বলতে গেলে বুকে যেমন বাজে, তেমনি আত্মপ্রশংসাও পাঠকের কাছে কর্ণপীড়াদায়ক।”
– আব্রাহাম লিঙ্কন।
মানুষ আদিম যুগ থেকেই যাযাবর জীবন যাপন করে আসছে। তারা এক ভূ-খন্ড থেকে আর এক ভূ-খন্ডে বিচরন করে আসছে আদিম যুগ থেকে এখন পর্যন্ত, তা আমরা ইতিহাস পড়লেই দেখতে পাই। আমার বংশের পূর্ব পুরুষও ঠিক তাই।
আমার বাবার নাম আফছার উদ্দিন ফরাজী। তিনি চাকরিসূত্রে রামপাল ছেড়ে মোংলাতে তার বসতি গড়ে তুলেছে। তার ছেলে থাকলে সেও তার বসতভিটেতেই হয়তো থাকতো। যাইহোক, আমার আব্বার বাবার নাম জোহর ফরাজী। জোহর ফরাজির বাবার নাম ধোনাই ফরাজী। ধোনাই ফরাজীর বাবার নাম ছাবের ফরাজী। ছাবের ফরাজী হাজী শরীয়তুল্লাহর পরবর্তী কতোতম পুরুষ তা আমি জানতে অক্ষম হয়েছি। শুধু জানতে পারলাম তারা এ বংশের মানুষ।
হাজী শরীয়তুল্লাহর জন্ম ১৭৮৬ সালে মাদারিপুর জেলার চর শামাইল গ্রামে। তিনি আরবি ভাষায় পন্ডিত ছিলেন। তিনি ধর্মীয় সংস্কারক, নীলকর ও সামন্তবাদ বিরোধী নেতা এবং ভারতবর্ষে সংঘটিত ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা ছিলেন। তিনি শুধু ধর্মীয় সংস্কারক ছিলেন না, বরং কৃষক, তাঁতি এবং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ থেকে মুক্ত করার জন্য সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন । তিনি ১৭৯৯ সালে মক্কা গমন করেন এবং ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকে বাংলায় ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তিনি আরবের ওয়াহাবী আন্দোলনের আদলে ফরায়েজী আন্দোলন শুরু করেন। নীলকর ও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতেন। তার প্রবর্তিত ধর্মমত ছিলো আধুনিক ও মানবতাবাদী। ইসলাম ধর্মের উৎপীড়নমূলক নিয়ম রদ করে ভন্ড মোল্লামৌলবীদের হাত থেকে তার শিষ্যদের রক্ষা করেন। এ কারনে রক্ষণশীল ধনী মুসলমানগণেরা তাকে ঢাকা থেকে বিতাড়িত করেন। ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার অসংখ্য কৃষক তারশিষ্যতা গ্রহন করেন। তার ছেলে দুদুমিয়াও একজন ঐতিহাসিক যোদ্ধা ও ফরায়েজী আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তিনিও নীলকরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ব্রিটিশদের তাড়ানোতে ভূমিকা রেখেছিলেন। দুদুমিয়া ১৮১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮৬২ সালে মৃত্যবরণ করেন। এ দুই পুরুষের পরে তার ঠিক কতো পরে ছাবের ফরাজী তা খুঁজে বের করাটা আমার একটু কঠিনই। তাই ছাবের ফরাজী থেকেই শুরু করি। আমার বাবার তথ্যমতে ছাবের ফরাজী ফরিদপুর থেকে ব্যাবসায়িক কাজে রামপাল এলাকায় আসেন। এখানে তিনি বসতি গড়ে তোলেন। তৎকালীন সেখানকার জমিদারের দুই মেয়ে ছিলো। তার এক মেয়ে মনুর কাছ থেকে জমিদারির কিছু অংশ কিনে নেন। তার ছেলে ধোনাই ফরাজী। তিনি চাঁনপুর গ্রামে বসতি গড়ে তোলে। তার দুই ছেলে। একজন আমার দাদা জোহর ফরাজী আর একজন ফজর ফরাজী। ফজর ফরাজী রামপাল থানাঅধীন উজলকুড় গ্রামে বসতি গোড়ে তোলেন।
ধোনাই ফরাজী তার ছেলেকে অর্থাৎ আমার দাদার বিয়ে দেন রামপাল থানার আদাঘাট গ্রামের রহমত-উল্লাহর একমাত্র মেয়ে জোহরার সাথে। রহমত-উল্লাহ্ সেই সময়ের এমই অর্থাৎ মিডিল ইংলিশ স্কুল পাশ। আব্বার কাছে গল্প শুনেছি তার হাতের লেখা ছিলো চমৎকার। তাল পাতায় তিনি লিখতেন। তিনি ওখানকার কোনো এক মক্তবে পড়াতেন। তালপাতায় তার কিছু লেখা আব্বার সংগ্রহে ছিলো কিছুদিন। রহমত-উল্লাহ তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিতে চাইলেন এক শর্তে যে, তার জামাইকে তার বাড়ি ঘর জামাই থাকতে হবে। কারণ, আমার দাদীর মা মারা যান দাদী যখন শিশু তখন। দাদীর বাবা তাকে লালন পালন করেন, তিনি আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। দাদীকে তিনি প্রচন্ড ভালবাসতেন নাকি। চোখের আড়াল করতে চাইতেন না। আমার দাদীকে দেখে খুব পছন্দ হয়ে যাবার কারনে আমার দাদার বাবা সে শর্তে রাজী হয়ে যান। সেই থেকে আমার দাদা আদাঘাট মুন্সিবাড়ির ঘর জামাই হয়ে রয়ে যায়। এভাবে ফরাজীরা বৈবাহিকসূত্রে ও বসতিসূত্রে রামপালের বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। আমার দাদার চার ছেলে। আমার দাদা শুনেছি প্রচন্ড রাগী মানুষ ছিলেন। তাকে আমরা কোনো চাচাতো ভাইবোনই দেখিনি। আমার বাবা সবার ছোটো। তিনি আদাঘাট গৌরম্বা স্কুলে পড়াশুনা করে একসময় ভর্তি হন ফয়লা স্কুলে। তখনকার সময়ে বাড়ি থেকে স্কুল করা কতো যে কষ্টকর তা এখনকার প্রজন্মের বোঝার কথা নয়। কারণ, সে রাস্তাঘাট এখন প্রায় সব পাকা হয়ে গেছে। তখন বর্ষাকালে এমন কাঁদা হতো যে এক পা উঠাতে গেলে আর এক পা ডুবে যেতো কাঁদায়। তবু অনেক কষ্ট করে সেখান থেকে মেট্রিক পাশ করেন। স্কুলে পড়া অবস্থায় আমার দাদা হঠাৎ করে মারা যান।
আব্বা ঢাকা মেডিকেল থেকে প্যাথলজি বিষয়ে পড়াশুনা করে সরকারী হসপিটালে যোগদান করেন। তবে তার পড়াশুনার সিঁড়িটা খুব সহজ ছিলো না। অনেক জমিজমা থাকতেও তাকে অন্যের বাড়ি লজিং থেকে পড়াশুনা করতে হয়েছে। আব্বার কাছে গল্প শুনেছি, মেট্রিক পরীক্ষার ফর্মফিলাপ করার জন্য ১৬০ টাকা দরকার ছিলো আব্বার। আর তা তিনি জোগাড় করেছিলেন অন্যের বাড়ি ধান কেটে। আর ইন্টার পুরোটাই লজিং থেকে।
আমার মায়েরাও এই একই বংশ বা গুষ্টির লোক। উজলকুড় ও নপ্পুরে তাদের বসতি আছে। আমার নানা রুস্তম ফরাজীরা দুই ভাই। তাদের মা মারা যাবার পর নানার বাবা আবার বিয়ে করেন। তাই তার নানী তাদের নপ্পুর তার দাদাবাড়ি থেকে চাঁনপুর গ্রামে নিয়ে আসেন। আমার নানার নানীর আবার ঐ এক মেয়েই ছিলো। তাই তার সমস্ত সম্পত্তি তার দুই নাতিকে ভাগ করে দেন। আমার নানারা দুই ভাই খুব আদরেই মানুষ হয়। আমার নানার পাঁচ মেয়ে এক ছেলে। আমার নানা খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন।
এবার আমার শৈশব নিয়ে লিখিঃ আমার শৈশবকাল খুব অন্যরকম কেটেছে। প্রতিটা মানুষের শৈশব নির্মল নির্মহ। আব্বার চাকরির পোষ্টিং মোংলাতে হওয়ার পর আমরা ওখানেই থাকতাম। আমার জন্ম চালনা হসপিটালে ১৯৮১ সালে। তখন ওখানেই আব্বার পোষ্টিং ছিলো। দাদী বেঁচে থাকাকালীন সময়ে মা দাদী বাড়িতেই ছিলো। মাঝে মাঝে যাওয়া আসা করতো। আমার দাদীর কথা আমার খুব অল্প মনে আছে। শুধু মনে আছে তাকে আমি হাত ধরে ধরে পাশে তার এক কেমন যেনো ভাই হয় সে বাড়ি নিয়ে যেতাম। খুব ফর্সা ছিলেন আমার দাদী। আমার ছোটোবোন মুক্তাকে তিনি খুব ভালবাসতেন। তাকে তিনি নুমির মা বলে ডাকতেন। যদিও মুক্তা তার কোনো মেয়ের নাম নুমি রাখেনি। দাদী ওর নামটা নিতে নিতেই মারা গেলো!
আমার নানা বাড়ি থেকে দাদাবাড়ির দুরত্ব খুব বেশি না। তাই বড় আপা নানাবাড়ি থেকেই পড়াশুনা করে। কারণ, আদাঘাট থেকে ফয়লা স্কুল দুরে, আর চাঁনপুর থেকে মোটামুটি কাছে।
আমি ছোটোবেলায় খুবই দূরন্ত প্রকুতির ছিলাম। আমি দাদাবাড়ির থেকে নানাবাড়িতেই বেশি থাকতাম। আমার নানাবাড়িটা খুব সুন্দর। একপাশে দিয়ে বয়ে গেছে একটা ছোটো নদী। একপাশে বড় একটা গোলপাতার বাগান। সামনে দুইটা জোড়া পুকুর। ছিলো গরু ও মহিষ রাখার আলাদা আলাদা ঘর। পনেরো বিশটা মহিষ ছিলো। ধান মাড়াই করার জন্য এসব মহিষ কাজে লাগতো। যাকে বলে, মলন দেওয়া। কিন্তু আমার সমস্যা একটাই ছিলো বাথরুম দূরে। আমার ঐ এক যায়গাতে আপত্তি থাকতো। তাই রাত হলে আর থাকতে চাইতাম না নানাবাড়িতে।
আমার নানা খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন। ছিলেন খুব দয়ালু সাধাসিদে ধরনের মানুষ। সে সময় মুখে মুখে জমি অদল বদল করা যেতো। নানা তার বসতবাড়ির কাছে আনছার সরদার নামে এক লোককে বসতি কিছু জমি অদল বদল করে থাকার ব্যাস্থা করে দেন। তারা এখনো সেখানে বাস করছে। নানার বন্দুক ছিলো। সে সময় হরিণ শিকার করা নিষেধ ছিলো না। নানারা মাঝে মাঝে হরিণ শীকার করে নিয়ে আসতো। দূর জমি থেকে ধান বয়ে আনার জন্য ছিলো বড় বড় গোণটানা নৌকা। আমার শৈশব স্মৃতি খুব প্রখর। তাই সে সব নৌকার কথা অল্প অল্প মনে আছে। আমরা ছোটোরা নৌকা থেকে ধানের আঁটি নামানোর পর যে ধান পড়ে থাকতো তা সংগ্রহ করতাম সে ধান দিয়ে আসলে কি করতাম তা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
গোণটানা মাঝিদের নিয়ে আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম।
শুনেছি গোণটানা মাঝিদের ঘাড়ে কালসিঁটে দাগ পড়ে যেতো। নৌকার পিছনে বড় দাঁড় ধরে দিক ঠিক রাখতো আর এক মাঝি। নারকেলের ছোবড়া আর পাট দিয়ে পেঁচিয়ে তৈরি করতো সে গোণের দড়ি। খুব শক্ত ও মোটা সে দড়ি। যিনি গোণটানতো সেদিকে দড়ির মাথায় আড়াআড়ি একটা লাঠির মতো থাকতো, অনেকটা জোয়ালের মতো। তা সে মাঝি ঘাড়ে নিয়ে হাঁটতো। কতো কষ্টকর ছিলো সে সব জীবিকা আসলে!
নানার দুইটা ঘোড়া ছিলো। ঘোড়া দুইটার কথা আমার মনে আছে। একটা ছিলো সাদা ঘেড়া আর একটা খয়েরী রঙের। চাঁনপুর গ্রামে ঘোড়দৌড় মাঠ আছে। বিশাল সে মাঠে ঘোড়দৌড় হতো। মেলা বসতো। আমরা ছোটোবেলায় সে মেলায় যেতাম।
আমার নানাবাড়ির সামনের খালে নৌকা বাইচ হতো। সে খাল এখন মরে গেছে। আমার মনে আছে নৌকার মাথায় এক লোক হাতে একটা টিনের প্লেট নিয়ে খুব জোরে জোরে পিটাতো, আর বলতো,” আ হা হা ডং।
ধান উঠার মৌসুমে নানাবাড়ির উঠোন ভরে যেতো নতুন ধানে। নানা আমাকে খুব আদর করতেন। তিনি যেখানে যেতেন আমাকে নিয়ে যেতেন, নাকি আমিই যেতে বায়না ধরতাম ঠিক মনে নেই। নানাবাড়িতে কিষেণ হিসেবে কিয়াম নামে (আসলে কিয়াম মামাকে কিষেণ হিসেবে দেখতে আমি রাজি নই, তবু লেখার প্রয়োজনে লিখতে হচ্ছে) এক মামা ছিলো। আমি তাকে খুব পছন্দ করতাম নানারকম আবদার করতাম মামার কাছে। আমাকে ঘাড়ে করে করে নানান যায়গা নিয়ে যেতো। আমিও মামা ও নানার সাথে ফয়লা হাঁটে গিয়েছিলাম একবার সে সব পরবাসী কিনতে। ধান কাটা, মাড়াই করা থেকে শুরু করে গোলায় ওঠানো পর্যন্ত পরবাসী ধানকাটা শ্রমিকরা কাজ করতো। নানা এসব পরবাসী শ্রমিকদের প্রতিবছর ফয়লা হাঁট থেকে কিনে আনতো। ধানকাটা সরঞ্জাম সাধারণত তাদের কাছেই থাকতো। দশ পনেরো জনের একদল থাকতো তাদের। তাদের জন্য বড় বড় হাড়িতে সকালে আতপ চালের জাও রান্না হতো। তার সাথে নারকেল ও খেজুর গুড়। দুপুরে ও রাতে তরকারি ভাত। গ্রামের ভাষায় ভাত-সালুন। ধান কাটা, দুর জমি থেকে ধান বয়ে নিয়ে এসে মাড়াই করে তা মেপে গোলায় ভরে তারা বিদায় হতো। তারা ধান মাপার সময় অদ্ভুদ কিছু শব্দ বলতো। শব্দগুলো এই মুহূর্তে আমার মনে আসছে না। কারণ, তা খুবই ছোটোবেলার কথা। পরবাসীদের বিদায় অনুষ্ঠান নানা খুব জাঁকজমক ভাবেই করতো। নানারকম পিঠা, গাজীকালুর গীতের আয়োজন থাকতো। আমার মনে আছে, প্রতিবারই তাদের বাড়ি ফিরে যাবার সময় তাদের চোখে পানি জমে থাকতো।

আমার নানাবু ছিলো খুব কর্মঠ ও স্বাস্থ্য সচেতন মহিলা। তিনি সবকিছু হাতেই বানাতে পছন্দ করতেন। একটা জিনিস বানাতেন তিনি খুব সৌখিনতার সাথে। আর তা হলো মুখে খাবার চুন আর খেজুরের গুড়। নানাবুর এমন সব ছোটোখাটো কাজের জন্য কিয়াম মামা তাকে খুব সহযোগিতা করতেন। নানাবু তার নাতিনাত্নীদের নিয়ে নিজেই শামুক ঝিঁনুক কুড়াতেন। এ শামুক ঝিঁনুক সাধারণত গোলবাগান(গোলপাতা ঝাঁড়) থেকে সংগ্রহ করতো। গোলবাগানে পানি থাকতো বেশিরভাগ সময়ে পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত। সে শামুক ঝিনুকের ভিতরে নাড়িভুড়ি বের করে হাঁসমুরগির খাবার হিসেবে ব্যাবহার করা হতো। আমি খেয়াল করতাম হাঁসমুরগিগুলো তা খুব তৃপ্তি নিয়েই খেতো। তারপর তিনি শামুক ও ঝিঁনুকের খোলসটা ভালমতো পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে বড় একটা তাফলে জাল দিয়ে চুন বানাতেন। তবে এই প্রক্রিয়ায় চুন বানানোটা কষ্টের হলেও স্বাস্থ্যকর।
নানাবু বাড়ির নারকেল দিয়ে ঘানি দিয়ে তেল বানাতেন। সে প্রক্রিয়াটাও বেশ সময় ও পরিশ্রমের ব্যাপার ছিলো। নারকেলগুলো কেটে রোদে শুকিয়ে তা ঘানিতে পাঠানো। একবার হলো কি, নানাবুর একটা মুরগী প্রায়শুকনাড় নারকেল খেয়ে ফেলেছে এবং সে নারকেল মুরগির পেটে গিয়ে ফুলতে শুরু করেছে। মুরগি প্রায় মরে যাবার মতো অবস্থা। নানাবু করলো কি, মরগিটাকে ধরে ব্লেড পুড়িয়ে ওর খাদ্য নালী চিরে তা থেকে সে নারকেল বের করে দিলো। খেজুর গাছের কাঁটা দিয়ে আর কি সূতা দিয়ে যেনো তা সেলাই করে দিলো। সে ক্ষত স্থানে হলুদ মেখে কি যেনো গাছের পাতা দিয়ে পেঁচিয়ে দিলো। আমি শিওর ছিলাম মুরগিটা মারা যাবে। আশ্চার্য জিনিস সে মুরগিটা ভালো হয়ে গেলো এবং পুরো সে ঘটনাটা ঘটেছিলো আমার সামনেই। আমি নানাবুকে সে কাজে সাহায্য করেছিলাম। এটা আমার শৈশবের এক অন্যরকম স্মৃতি।
নারকেল তেল ভাঙানোর পরে সে তেলের নীচে ঘন তলানী পড়ে। যা ঘা পাঁচড়া হলে লাগিয়ে দিতো। সত্যি আশ্চার্য রকম কাজ হতো।
আমি ছোটোবেলায় মাছ ধরতে খুব
পছন্দ করতাম। নানাদের বাড়ির সামনের খালে ছোটোছোটো এক ধরনের মাছ পাওয়া যেতো। মাছটির নাম ডগরা মনে হয়। ছোটো গর্তের মধ্যে ওরা বাসা করে থাকতো। জোয়ার ভাটার কারনে খালের পানি কম বেশি হতো। তাই ভাটার সময় সে সব ডগরি মাছ ধরতাম গর্তের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে। একবার কি হলো এটা সম্ভবত দাদাদের খালে হবে। আমি দাদাবাড়ির ছোটো ছোটো ভাইবোনের সাথে ডগরা মাছ ধরার চেষ্টা করছি। গর্তে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছি, আমি ডগরা মাছের বদলে আসলে সাপের মুখ আর লেজ ধরে চিৎকার শুরু করেছি যে, মাছ ধরেছি। আমার এক চাচাতো ভাই চিৎকার করে বলছে, ছেড়ে দিয়ে দৌড় মার। আমি নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি আমি সাপ ধরে আছি। তখন আমার সে কি ভয়ানক চিৎকার! না, সাপটা আমাকে কামড় দেয়নি। এটাও আমার একটা আশ্চার্যরকম শৈশব স্মৃতি। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আর কোনোদিন মাছ ধরিনি।
ছোটোবেলায় কিছুদিন আব্বার এক মামার বাড়িতে ছিলাম। বসুপাড়াতে। আব্বা তখন গরীব নেওয়াজ ক্লিনিকে বসতো। ওখানে খুব অল্পদিন ছিলাম। ওখানে আমার খেলার সাথী ছিলো মনি। মনিকে আমার খুব মনে পড়ে। তারপর আমরা সম্ভবত ১৯৮৮ সালের সেই ভয়াবহ বন্যার পরপরই মোংলা চলে যাই। তখন মোংলা নদীতে সাম্পান ছিলো। আমরা সেই সাম্পানে করে নদী পার হতাম।
বড় আপা এস এস সি পাশের পর মোংলা চলে আসে। বড় আপা মোংলা সরকারি কলেজে ভর্তি হয়। মোংলাতে তখন খাবার পানির তীব্র সঙ্কট। এখন যেমন বড় বড় পানি রাখার জিনিস পাওয়া যায় তখন কিন্তু সেরকম পাওয়া যেতো না। মাটির এক ধরনের পাত্র যাকে আমরা মাইট বলি তাতে সংরক্ষণ করা হতো। আমাদের মোংলার বাড়িতে এখনো পুরাতন দুইটা মাইট এখনো আছে। ওটার বয়স অন্তত ত্রিশ বছর হবে। মা এবার দেখলাম মাইটের গায়ের চারপাশ সিমেন্ট দিয়ে লেপে দিয়েছে। যাতে ভেঙে না যায়। এবার ছবি তুলে এনেছি আমি মাইট দুটার। আমার মনে আছে মোংলা মাকরডোন একটা দীঘি থেকে আমরা ভ্যান ভাড়া করে কলসি করে পানি ভরে নিয়ে আসতাম। আবার বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হতো এসব বড় বড় মাইটে। কালো কালো ছোটোছোটো চিকন পোকা কিলবিল করতো সে পানিতে। তবু আমরা নীরে যাওয়া সে পানি খেতাম।
মোংলা চাঁদপাই গ্রামে চৌত্রমাসে এক মেলা হয়, আমার সেই মেলাতে যাবার এক তীব্র ইচ্ছা কাজ করতো সব সময়। সামান্য কিছু টাকা পেলেই আমি মেলায় চলে যেতাম। তখন ছিলো কাঁচা রাস্তা। এতোটা পথ যে ঐ ছোটো ছোটো পায়ে কেমন করে যেতাম!
মেলা থেকে আমি মায়ের জন্য কাঁচা গুওমরি কিনে আনতাম। মা এটা পান দিয়ে খেতে খুব পছন্দ করতো।
আব্বা আমাকে খু্ব ভালবাসতো। বড় আপারও অনেক ছোটো আমি। তাই আমার শৈশবটা খুব মধুর ও আদরের। বড় আপা আমাকে খুব সুন্দর সুন্দর জামা তৈরি করে দিতো। ছোটোবেলার কিছু ছবি এখনো আছে।
আমার সেই দুরন্ত শৈশব এক অনন্য স্মৃতি ভান্ডার।
,,রিতু,,,

কুড়িগ্রাম।

৮৯১জন ৮৯১জন
0 Shares

৯টি মন্তব্য

  • জিসান শা ইকরাম

    বেশ বড় লেখাটি,
    তবে পড়ার সময় মোটেই বুঝতে পারিনি এটি এত বড়।
    লেখনি কৌশলের কারনে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পড়েছি।

    তাহলে তোমরা হাজি শরীয়তউল্লাহ্রর বংশ ধর! দারুন তো 🙂
    আমি আমার বংশের দাদু পর্যন্ত নাম জানি, আজ আম্মার কাছে জিজ্ঞেস করবো তার দাদা শশুরের নাম জানে কিনা।

    অনেক প্রসঙ্গ এনেছো লেখায়, গুনটানা নৌকা আমি দেখেছি, একজন বা দুজন কাঁধে গুনটানতো, এমন পরিশ্রমী পেশা আজকাল আর নেই। নৌকা তো সব ইঞ্জিন চালিত হয়ে গিয়েছে।
    অবাক হলাম মুরগীর গলা অপারেশন এমন ভাবে হয়েছে 🙂 কত কিছু জানতো আগের মানুষগন।

    চমৎকার লেখায় দশে দশ দিলাম।

  • ছাইরাছ হেলাল

    বাপরে!! বিশাল শ্রমসাধ্য কাজ করে ফেলেছেন দেখছি।
    একেবারে ঠিকুজি তৈরি করে ফেললেন!!
    এ কাজ আপনার দ্বারাই সম্ভব!!
    সোনেলা ধন্য আমাদের মাঝে হাজী শরীয়তুল্লাহর উত্তরাধিকারী কেউ আছেন।
    রিতুজিকে ভয়ার্ত-শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

    আপনার স্মৃতিশক্তি দারুন ঈর্শ্বনীয়।
    আরও ভাবছি এত্তবড় একটি এমন লেখা কী করে লেখা সম্ভব!!

    ফিরিয়ে দেও/চাই আমার সোনালী শৈশব
    মাছ ধরায়, সাম্পানওয়ালা নদী, মনিমালা,
    আর পোকাধরা পানিতে;
    কাঁচা গুওমরি, যা এখনো চোখে-চোখে ভেসে থাকে।

    শরীয়তুল্লার কোচড়ে লুকিয়ে রাখা
    কদমা-ও আমার চাই-ই!!

    • মৌনতা রিতু

      কদমা কিছু কি আর আছে! হুম, শৈশব স্মুতি আমার প্রখর। তবে এখন বয়স হয়েছে বলে কারো নাম মনে রাখতে পারি না। মোবাইল ফোনে এজন্য নামের পাশে চিহ্ন দিয়ে রেখেছি।
      আসলে এবার বাসায় গিয়ে দলিল দেখতে গিয়ে গোষ্টির অনেকের নাম চলে আসলো। তাই লিখে ফেল্লাম। আমার মেমনও লিখেছে তার দাদুবাড়ি নিয়ে সাথে সে তার শৈশব ও ক্যাডেট কলেজের প্রথম বছরের অভিজ্ঞতা যোগ করেছে।
      অনেক ধন্যবাদ কবি। ভালো থাকবেন গুরুজী।

      • ছাইরাছ হেলাল

        ধ্যাৎ!! কদমা না থাকুক লাঠি লজেন্স বা অন্য কিছু তো নিশ্চয়ই আছে!!
        যে সব নাম এখন ও পাননি সেগুলো পেতে চেষ্টা জারি রাখুন, এটি অমূল্য দলিল হিসাবে থাকবে।

        বাহ বাহ্‌, বাবা-সোনার লেখাটি এখানে দিন আমরাও একটু পড়ে আনন্দ নেই।

        ক্রমাগত লজ্জা দিচ্ছেন কেন!!

        লেখা দিন।

      • মৌনতা রিতু

        এজন্য এবার ফেব্রুয়ারিতে ফরিদপুর শরিয়তপুর যাব ভেবেছি।
        মেমনের কিছু লেখা এখনো বাকি আছে, ও কলেজে নিয়ে গেছে। তবে তার ছোটো গল্প লেখা আছে বেশকিছু ।
        ওমা! গুরুজিকে গুরুজি বলব না? আমার দুষ্মন্ত রাজা নিয়ে কবিতা সাজিয়ে ফেলল ;?

  • নীলাঞ্জনা নীলা

    আপু একটানে পড়েছিলাম। যদিও মন্তব্য করছি এখন। তুমি তো দেখছি বিশাল নামী পরিবারের একজন! এতো কিছু কি করে মনে রাখলে? তুমি যে মেধাবী আবারও তার প্রমাণ হলো।

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ