সাত সকালেই চাঁন মিয়ার বস্তিতে ব্যাপক হট্টগোল, সকাল থেকেই হইহই রব, বাতেন ভাই, ও বাতেন ভাই ঘরে আছোনি? কেডা মজিবর ভাই? কি হইছে, আরে বাতেন ভাই সর্বনাশ হইয়া গেছে বস্তিতে এক মাইয়্যার লাশ পাওয়া গেছে, জলদি চলো। বাতেন এতোক্ষণ দাঁত মাজছিলো, টুথব্রাশ হাতে নিয়েই ছুট। চারদিকে গোল হয়ে লোকজন দাঁড়ানো, মনে হচ্ছে সাপ খেলা হচ্ছে, আসলে সাপ খেলা নয়, একটা কিশোরী মেয়ের লাশ শোয়ানো। কয়েকজন পুলিশের লোক রাইফেল কাঁধে দাঁড়ানো, একটা চেয়ারে দারোগা সবুর সাহেব বসা, আরেকটা চেয়ারে চাঁন মিয়া, চাঁন মিয়াকে দেখে মনে হচ্ছে সে রাত ভর ইবাদত বন্দেগি করে এসেছে, তার ফতুয়া থেকে তরতাজা বেলী ফুলের সুবাস বের হচ্ছে, যেন কিছুই হয়নি এখানে।
দারোগা সবুর মিয়া ব্যাপক পান খায়, তার ঠোঁট বেয়ে পানের রস বারবার নীচে যাচ্ছে আর রুমাল দিয়ে মুছতেছে, সবুর মিয়ার হাতের রুমাল দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে, তার ঘরে শান্তি নাই, এত ময়লা একটা রুমাল কেউ মুখে লাগায়। হঠাৎ হইচই ভেদ করে সবুর মিয়ার হুংকার, এই হারামির বাচ্চারা সত্যি কইরা ক তো দেখি? এই আকামডা কেডা করছোত? সত্যি কইরা কইলে বাইচা যাবি, নতুবা থানায় নিয়া যখন সাপ মাইর দিমু তখন টের পাবি, এই সব কয়ডারে গাড়িতে তোল? একজন কনষ্টেবল সবুর সাহেবের কানেকানে এসে বললো, স্যার সবাইকে ধরে না নিয়ে ভাগে ভাগে নিই, তাতে আমাদেরই সুবিধা হবে, নতুবা বস্তিবাসীর আন্দোলনে উপর মহল পর্যন্ত জানাজানি হলে ব্যাপারটা সামাল দিতে সমস্যা হবে। সবুর মিয়া হাসতে হাসতে মাথা নাড়তে থাকলো, মনে হচ্ছে সে সব বুঝে গেছে, হঠাৎ আবার হুংকার, এই বেটা এইদিকে আয়, তোর নাম কি? স্যার আ.. আ.. আব্দুল বাতেন, কি করিস? স্যার সিজনাল ব্যবসা, সিজনাল ব্যবসা মানে খারপ কিছু, না.. আ.. স্যার, মানে যখন সে যেটা পাই, ও আচ্ছা, চাঁন মিয়া তোমারে দেইখাতো মনে হইতাছে কিছু হয় নাই, লাশ থানায় নিয়া গেলাম, তুমি কি লগে যাইবা? চাঁন মিয়া যেন ঘুম থেকে উঠলেন, সে বললো স্যার কি দরকার এই সবের ভিতরে আমার মত ধর্মপ্রাণ মুসলমান কে টানা হেঁচড়া করা। এটা কোন বিক্ষিপ্ত ঘটনা, আপনে যান শোয়ারী ঘাট থাইক্কা আমার ছোট বিবি আইতাছে, তার সাথে মোলাকাত করেই থানায় আইতাছি।
বস্তিটা এখন খা খা, লাশ নিয়ে পুলিশ চলে গেছে, ঘরে ঢুকে দেখি তানিয়া খুব তাড়াহুড়ো করে তৈরি হচ্ছে, তানিয়া আমার বউ, খুব শখ করে তাকে বিয়ে করেছিলাম, তখন আমাদের অবস্থা এমন ছিলো না, গোয়ালে গরু, বছর চুক্তি চাকর, বাবার ছিলো গঞ্জে বড় মনিহারী দোকান। আমার বন্ধু মির্জার বিয়েতে গিয়ে ওর সাথে পরিচয়। তানিয়ার বয়স তখন নতুন কিশোরী, তার বান্ধবীর বিয়ে, লাল একটা তাঁতের শাড়ি পড়ে এসেছিল, বরের পাশে এসে সে কি দুষ্ট দুষ্ট কথা, ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম বিয়াইন সাহেবের নামকি? সেদিন যে উত্তর দিয়েছিল তা প্রকাশ যোগ্য নয়, জেদ চেপে গিয়েছিল সেদিন, কি ত্যাদর রে বাবা, বিয়ের অনুষ্ঠানে একা একা হাঁটছিলাম, তানিয়া ভুতের মত এসে জিজ্ঞাসা করলো, কি বিয়াই সাহেব কি খুঁজছেন? গরু? উত্তরে বললাম বিয়াইন সাহেব না, আমি ডালিম বাগান খুঁজছি, সে বললো দুত্তরি বেয়াই যে কি বলেন, আমাদের সাত গ গ্রামেও ওষুধ খাওয়ার জন্য একটা ডালিমের গাছ খুঁজে পাইবেন না, এবার একটু সাহস করে বলে ফেললাম, বিয়াইন সাহেব যে ডালিম বাগান নিয়া ঘুরতাছেন, তাতে আমার মত পুরুষ কিন্তু ঘুরে আপনারেই খুঁজে পাবে, ছি! ছি! বিয়াই আপনিতো পোংটা, আপনার সাথে কথা নাই। কথা নাই বললেই কি হয়, বিয়াইন সেদিনই মনের ভিতরে জায়গা করে নিয়েছিল, সেই বিয়ে ছিলো আষাঢ় মাসে এরপর জৈষ্ঠ্য মাসে আমাদের মিলন হলো, বিয়াইন থেকে বউ, এর মাঝের সময় গুলো যে কীভাবে কেটেছিল তা এক অন্য ইতিহাস, গ্রাম শুদ্ধ লোক বলতো বাতেনের কপালডা ভালা, পরীর মত বউ তাঁর ঘরে, আজ সেসব কথা মানে সোনালি অতীত, পদ্মার ঢেউে সব এখন পানি আর পানি, নিত্য রোজ অভাবের ছাপ তানিয়ার যৌবনে যেন হঠাৎ কোন দুর্ঘটনা। সে এই সাত সকালে খাঁ সাহেবের ফ্ল্যাটে কাজ করতে যাবে, খাঁ সাহেবের বউ শেলী খালা বড় ভালো মানুষ, ঘরে যেদিনই ভালো মন্দ রান্না হবে সেদিনই বাটি ভরে দিয়ে দিবে কিছু না কিছু। অসুখ বিশুখে উনিই এখন আমাদের বিধাতা বলা চলে। আমার ছেলে আবির, বয়স চার ছুই ছুই, শেলী খালার মেয়ে টুনটুনি তাঁকে পড়ায়, বাংলা ইংরেজি অংক, আবিরকে নিয়ে আমাদের চেয়ে টুনটুনির স্বপ্ন বেশি। শুনেছি সে নাকি আবিরকে ভালো স্কুলে ভর্তি করাবে, শেলী খালার পরিবারের এই ভালবাসা প্রায়ই চোখে জল এনে দেয়।
কয়দিন আগেও খুব ঝুম বৃষ্টি ছিলো, ঘরে চাল ডাল কিছুই নেই, ক্ষুধার কষ্ট ঘর হারানো পর অনেকবার টের পেয়েছি, দুই মুঠ ভাত দুইজনে শুধু পানি দিয়ে খেয়ে রাত কাটিয়েছি, কিন্তু ঘরে যে বাড়ন্ত শিশু, ওর মায়া ভরা মুখের দিকে তাকালে মনে হয় সব কিছুই করতে পারবো ওর জন্য।
এই আবিরের বাপ পাতিলে ভাত ছালুন সবই আছে খাইয়া যাইয়ো, আর যাওয়ার সময় ঐ মাজেদা খালার কাছে আবিররে দিয়া যাইয়ো, মাজেদা খালা সে আরেক রহস্য আমাদের এই বস্তির, সবাই তাকে কুটনা বুড়ি বলে, কিন্তু খালা খুব ভালো মানুষ, এই কয় বছরে কারো সাথে ঝগড়া করতে দেখি নাই, অনেকের সন্দেহ সে গাল কাটা নাজমুলের গুপ্তচর, তাঁর কোমরে নাকি অনেকে পিস্তল দেখেছে, গাল কাটা নাজমুল হচ্ছে এ এলাকার ত্রাস, সবাই তাকে খুব ভয় পায়, মানুষ খুন করা নাকি তাঁর কাছে দুধ-ভাত। সে সপ্তাহের একটা নিদিষ্ট দিন এসে মাজেদা খালার সাথে দেখা করবে, বস্তির একটা রুমে বসে কি যেন নিরিবিলি সময় কাটায়, গালকাটা নাজমুল বুড়ির জন্য বেশ ভালো পয়সার বাজার সদাই নিয়ে আসে। নাতি হিসাবে আমার ছেলে আবিরও তাঁর হিস্যা পায়, আবির একবার বুড়ি কাছে হোন্ডায় চড়ার বায়না ধরেছিল, গাল কাটা নাজমুল হোন্ডায় চড়িয়েছে, সে মজার গল্প প্রায়ই আবির আমাকে বলে, হোন্ডায় চড়তে নাকি বেশ আরাম, বড় হলে যেন তাকে হোন্ডা কিনে দিই। ছেলেটাকে নিয়ে আরেকটা সমস্যায় আছি, টুনটুনি হয়তো তাকে আঁকা শিখিয়েছে, এখন তাঁর আবদারের সব জিনিস ছবি হয়ে আমাদের বেড়ার দেয়ালে ঝুলতে থাকে। তখন খুব কষ্ট হয়, মনে হয় আবিরে ভুল জায়গায় জন্ম গ্রহন হয়েছে।
আজকের দিনটা বেশ ভালই, কাজের আশায় এখন আমি, এলাকার দিন মজুরের হাঁটে। এখানে আমার মত অনেকেই আসে, বৃদ্ধ, যুবক, মহিলা। আমাদের সাথে আছে দালাল, যদিও ওনাদের সম্মান করে সর্দার বলি, কোট টাই পড়া, লুঙ্গী পাঞ্জাবি পড়া সব ধরেন ক্রেতাই আসে, আমাদের কাজের অনুযায়ী দৈনিক মুজুরী, আজকের কাজটা আগে কখনো করিনি, এটা টাইলসের উপর থেকে দাগ উঠানের কাজ, এখন গোড়ান থেকে সাহেবের পিক-আপ ভ্যানের খোলা অংশে বসে বসুন্ধরাতে এলাম।
আহ! কি সুন্দর বাড়ি, আমার মত হাজার শ্রমিকের ঘাম দিয়ে তৈরি, অথচ তৈরি হয়ে গেলে আমরা এর ভিতরে ঢোকার যোগ্যতা রাখি না, কাজ বলে কথা সাহেবের বাড়ির ফ্লোরে ক্যামিকেল দিয়ে ঘষে ঘষে পরিস্কার করছি, এর ভিতরে নীচ তলায় গাড়ি ঢোকার শব্দ পেলাম, হয়তো এই ফ্ল্যাটের মালিক এসেছেন, কিছুক্ষণ পর এক অল্পবয়েসী মেয়ে একটা ছোট্ট বাচ্চা হাতে এলো, এসেই ধমকের শুরু, এই দয়াল এসব কি লোক এনেছো? এরা দেখি কচ্ছপ এর মত ধীরে কাজ করছে।
দয়াল আমাদের চুক্তিতে এনেছে, সে বয়স্ক একজন মানুষ চুল নেই মাথায়, শরীর থেকে পেট অনেকাংশে বড়, কাচুমাচু করে সে ঐ মেয়েটির পাশে গিয়ে বললো ম্যাম, এরা খুব অভিজ্ঞ, দক্ষ, পরিশ্রমী। মেয়েটি আবার চেঁচিয়ে উঠলো, তাঁর গায়ের রং ফিনফিনে ফর্সা, টোকা দিলে রক্ত বের হওয়ার অবস্থা, ফর্সা মেয়েরা একটু রাগীই হয়, তাকে দেখে এ মুহুর্তে ধাঁতাল শুয়োরের মত কিছু লাগছে, দয়াল যেন আরো ভয় পেয়ে গেলো, সে কুকুরের মত আমারদের চারপাশে ঘুরতে থাকলো, আমার মনে হলো মানুষের যদি লেজ থাকতো দয়াল নিশ্চয়ই এতক্ষণে লেজ নাড়া শুরু করে দিত।
—– চলবে
১১টি মন্তব্য
অনিকেত নন্দিনী
আমাদের সমাজে এমন ঘটনা হয় কখনো?
বহু বছর আগে আজমপুরের ওই কুলিরহাট প্রথম দেখি। দেখে আমিও খুব অবাক হয়েছিলাম, “মানুষেরও হাট হয়!”
অঃটঃ এইটা কার বাসার ঠিকানা দিয়ে দিলেন? কাজের দরকার পড়লে সোজা হাজির হয়ে গেলে কাজ পাবো তো? ;?
লীলাবতী
রফিকুল স্যারের মত এমন লোক কি আছে এখনো? এমন লোকের কথা লেখাতেই পাওয়া যায়।আমাদের স্বপ্নের মাঝে এদের বসবাস।ভালো লেগেছে গল্প।
সীমান্ত উন্মাদ
রফিক স্যারের মত মানুষ এখনো আছেন, তবে কি জানেন আমরা চোর ডাকাত স্যারদের খবর শুনতে শুনতে আর তাদের কর্মকাণ্ডের বিবরনের খবরের পাতা কিংবা টেলিভিশনের সময় ভরপুর হয়ে যায় যে রফিক স্যারদের খবর দেওয়ার জায়গা থাকেনা। তবে হা রফিক স্যাররা আছেন আর তারা আছেন বলেই যতটুকু মানবতা মানবিকতা টিকে আছে, রফিক স্যাররা না থাকলে তাও থাকতো না। ধংসের ধামামা বাজত সেই কবেই।
জিসান শা ইকরাম
শেষটায় সব ভালোয় ভালোয় মিটে গিয়েছে।
আশংকা করছিলাম কোন বিয়োগাত্বক ঘটনার 🙂
আর্বনীল
সময় নিয়ে খুব খুটিয়ে খুটিতে পড়লাম। এজন্যই একেবারেই ছোটখাট দু-একটা ভুল চোখে ধরা পরছে।
১) ডাক্তারে (ডাক্তারের) সাথে আমার কথা হয়েছে।
২) আজ যদি কোন কাজ না পেতাম নিজের বিবেকে (বিবেককে) বিক্রি করে দিতাম। (আমি কিন্তু বিবিকে ভেবে বসেছিলাম। পরের লাইন পড়ে বুঝছি :p)
৩) অসহায় ও ক্লান্ত প্রাণীর মতো নেতিয়ে ইট বেছানো রাস্তা (রাস্তায়) বসে রইল।
আরেকটা প্রশ্ন – প্রতি ঈদেই লাল জামা নিয়ে কোন না কোন গল্প আমার চোখে পড়েই। এখন প্রশ্ন হল লাল জামা কেন? সাদা, কালো, নীল বা অন্য রঙ এর জামা নয় কেন???
নীলাঞ্জনা নীলা
আর্বনীল নিজের থেকে এসে বলছি বলে ভুল বুঝবেন না। আসলে বাচ্চাদের লাল রঙের প্রতি আকর্ষণ বেশী। সে ছেলে কিংবা মেয়ে যে-ই হোক। একটু বড়ো হলেই অবশ্য তারা রঙ বাছতে চিনে যায়। তখন দেখা যায় ছেলেরা প্রায় সকলেই নীল রঙ পছন্দ করছে।
নীলাঞ্জনা নীলা
গল্পটির কাহিনী ভালো। তবে আর্বনীল-এর মন্তব্যে যে ভুলগুলো উনার চোখে পড়েছে, তার সাথে আমিও একমত।
শুন্য শুন্যালয়
গল্প হলেও আপনার একান্ত কিছু অনুভূতি আছে বলে মনে হলো লেখায়। ভালো লেগেছে লেখাটা।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সংসারে টানপোড়নের গল্প এটা আমাদের সমাজের সাম্যহীনতার প্রতিচ্ছবি।রুদ্র ভাই কেমন আছেন।ঈদ শুভেচ্ছা আপনাকে -{@ পিতার একটিই কষ্ট কোন সন্তানের চাহিদা পূরণের ব্যার্থতা।
সিকদার
জীবন ঘনিস্ট লেখা । ভাল লেগেছে ।
সীমান্ত উন্মাদ
গল্পটা আমার বেশ ভালোলেগেছে।
আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।