স্কুল, কলেজ জীবন শেষে ইডেনে ভর্তি হয়ে দেখি, শেষ অবধি অবশিষ্ট রইলাম আমরা দু’জন। বাকি’রা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে। একই ডিপার্টমেন্টে, একই হোস্টেলে পারিবারিক গণ্ডির বাইরে শুরু হয় দুই বান্ধবীর অন্য এক সংগ্রামী জীবন।
সকালে ক্লাস শুরুর আগে খিচুড়ি-ডিমভাজি-আচার আমাদের নিত্য দিনের নাস্তা। কখনো বা পুরাতন হলে গিয়ে মামা’র দোকান থেকে পরোটা কিনে আনি। দুটো পরোটা বেশি হয়ে যায়। আবার একটি করে খেলে কম হয়। বিধায় আমরা তিনটি পরোটা কিনি। ভাগাভাগি করে খাই। সেই থেকে শুরু হয় আমাদের ভাগাভাগি’র জীবন। ভাগাভাগি হয় আমাদের সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ। আমরা একই রকম জামা পরি, একসাথে গাওসিয়া, নিউমার্কেটে যাই। হরতালের বিকেলগুলোয় আজিমপুরের ফাঁকা রাস্তায় হেঁটে বেড়াই। জীবনের শ্রেষ্ঠ এক সময়। শেষে একদিন আটলান্টিকের এই পাড়ে নিউইয়র্কে আমি, আর ওই পাড়ে ইংল্যান্ডে বান্ধবী__ দুই দেশে আমাদের বসবাস।
সব আনন্দও একসময় ফুরায়। সব পাখি নীড়ে ফিরে যায়। আমাদেরও ফিরবার সময় ঘনায়। আমরা বিদায় নেই। একে অপরকে জড়িয়ে ধরি। ভর দুপুরে প্রকৃতির সুনসান নিরবতার মাঝে একে অপরের হৃদস্পন্দন শুনতে পাই। হৃদয় গহীনে কালবৈশাখী ঝড়ের শব্দ শুনি। দু’চোখ ভেসে যায় জলে। আমাদের দু’জনের স্বামী’রা স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অদূরে। দুই বান্ধবীর বিচ্ছেদের সময়টাতে স্বামী’দের চোখে মুখেও এক আকাশ কালো মেঘ জমে, যেন এখনই ঝরে পরবে বৃষ্টি হয়ে।
গাড়িতে উঠে বসি। হাইওয়ে ধরে ছুটছে। অন্য শতশত ছুটে চলা গাড়িগুলোর ভিড়ে মিশে যায় আমাদের গাড়িটি। শাঁইজি লালন শাহ্ এর গান বাজছে___”হেলায় হেলায় দিন বয়ে যায়, ঘিরে নিলো কালে… ” এতো দরদী গান ! অশ্রুসজল হয়ে বাইরে চেয়ে থাকি। দীর্ঘ পথ এক নৈঃশব্দ্যে ছেয়ে থাকে।
জীবনের অনেকটা পথ এদেশ ওদেশ ঘুরে দু’টো দিন এক হয়ে থেমে ছিল আমাদের দুই বন্ধু’র পথ। সেইপথ আবারো দুইদিকে বেঁকে গেলো। ছোট্ট এই জীবনটাতে আবার কোনদিন আমাদের দেখা হবে কিনা জানিনা। শুধু জানি___
আত্নায় আত্নায় মিশে থাকা সম্পর্কগুলো এমন এক জিনিস, যা হাজার বছর পরে দেখা হলেও একই রকম আবেগ, অনুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকে। বিচ্ছেদে একইভাবে জল ঝরায়।
রিমি রুম্মান
প্যানসিলভ্যানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
আগস্ট ২৭, ২০১৫
২২টি মন্তব্য
অরুনি মায়া
স্কুল কলেজের জীবন টা আসলে কেও ই ভুলতে পারেনা। জীবনের সবচেয়ে মধুরতম সময় টা আমরা এখানেই পার করি। দুনিয়া খুব ছোট। এখানে কখন কবে কার সাথে দেখা হয়ে যায় কেও জানেনা,,,,,,
রিমি রুম্মান
আমরা কখন কেমন করে যে একে অপরের আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠি, নিজেদের অজান্তেই। স্বার্থহীন ভালবাসা কিংবা মনের টান বোধ হয় একেই বলে।
মেহেরী তাজ
ফ্রেন্ডশিপ সম্পর্ক টায় অনেক বড় একটা সম্পর্ক।
পৃথিবী যখন গোল আপনাদের আবার দেখা হয়েও যেতে পারে। আপনাদের সম্পর্ক টিকে থাকুক অনন্ত কাল।
রিমি রুম্মান
দেখা হোক আবারো এই জীবনে। হুম… এই জীবনেই… ভাল থাকুন সবসময়।
সীমান্ত উন্মাদ
বন্ধুত্ব হল পৃথিবীর সেরা সম্পর্কের একটি। অনেক বন্ধুর ভিড়ে এমন দু একজন থাকে, যারা হয়ে যায় জন্ম জন্মান্তররের বন্ধু।
অনেক অনেক ভাললাগা জানিয়ে গেলাম আপনার লিখায়। শুভকামনা জানিবেন নিরন্তির।
রিমি রুম্মান
আপনাকেও শুভকামনা। ভাল থাকুন সবসময়।
শুন্য শুন্যালয়
বিচ্ছেদের কথা ভুলে যান আপু। ভেবে দেখুন দুপ্রান্তের দুই দেশে থাকেন দুজন, কিভাবে দেখা হয়ে গেলো তাও আবার নিউইয়র্কে! আপনি তো সৌভাগ্যবতী। আমিতো আপনাদের দুজনের কি এত কথা হলো শোনার জন্য কান পেতে রয়েছি। কাবাব মে হাড্ডির মত বর দুটোকে নিয়ে গিয়েছেন কেন? ইশ কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা সেই দুষ্ট ছেলেগুলোর গল্প করা হলো না!! আপু ওয়েটিং আপনার নেক্সট পোস্টের জন্য। 🙂
রিমি রুম্মান
কাবাব মে হাড্ডিগুলো ভালই উপকারী। আমাদের এখানে সেখানে ঘুরতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। সংসার থেকে ছুটি দিয়েছিলো, সময়গুলো আরও সুন্দর করেছিলো। কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে থাকা দুষ্টু গুলো এখন অনেক বেশি পরিনত, দায়িত্বশীল … কোন একদিন লিখবো হয়তো তাঁদের নিয়ে। 🙂
মরুভূমির জলদস্যু
”হেলায় হেলায় দিন বয়ে যায়, ঘিরে নিলো কালে… ”
এভাবেই দিন কেটে যায়…….
রিমি রুম্মান
আসলেই এমন করেই দিন বয়ে যায়। তবে শফি মণ্ডলের কণ্ঠে দারুন আবেগি গানটি। পরিস্থিতির সাথে দারুন মানিয়ে গিয়েছিলো।
ছাইরাছ হেলাল
আচ্ছা, যদি এমন হোত এক দেশে এক শহরে আছেন কিন্তু যোজন যোজন
দূরত্বে, তবে কেমন হোত!!
বরাবরের মতই স্বকীয়তার স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
রিমি রুম্মান
আত্নার সাথে মিশে থাকা সম্পর্কগুলো আসলে এমনই হয়। যতদূরেই থাকি না কেন, কাছে টানবেই। ভাল থাকুন সবসময়য়।
ব্লগার সজীব
ছোট বেলার কত প্রানের বন্ধু দূরে চলে গিয়েছে।এদের অনেক বছর পরে যখন দেখি মনটা বিশাল রকমের আনন্দে ভরে যায়। আবার হয়ত দেখা হবে আপনার বন্ধুর সাথে।আবেগকে প্রকাশ করতে আপনার দক্ষতা তুলনাহীন।
রিমি রুম্মান
একটা জীবন এতো ছোট যে, আবারো দেখা হওয়া কল্পনাতীত, যেখানে আমরা দু’জন বাংলাদেশের বাইরের দুই দেশের বাসিন্দা। তবুও আশায় থাকি। স্বপ্নে বাঁচি।
জিসান শা ইকরাম
আবার কবে দেখা হবে
বা আদৌ আর দেখা হবে কিনা
এই ভাবনাটা আসলে কষ্টের ………
ভালো থাকুন আপনারা দুজন
ভালো থাকুক আপনাদের বন্ধুত্ব।
রিমি রুম্মান
জীবনটা আসলেই অনেক ছোট। তাই এভাবে বলা। ভাল থাকুন। প্রার্থনায় রাখুন।
ইমন
কিছু সৃতি আছে যা তাড়া করলে শুখিকর হয়। স্কুল কলেজের সৃতিগুলা তার মধ্যে অন্যতম। 🙂
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। তবে অনেক বছর বাদে যদি সেইসব বন্ধুদের দেখা পাওয়া যায় এমন বিদেশ বিভূঁইয়ে __ সেটা আরও বেশি সুখকর।
লীলাবতী
এমন বিদায়ের অনুভুতি খুবই কষ্টের আপু। -{@
রিমি রুম্মান
তবে দুটো দিন চমৎকার কেটেছে। সৃষ্টিকর্তাকে অনিঃশেষ ধন্যবাদ। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু মনের দূরত্ত্বটুকু তো নেই! ওটাই অনেক।
এমনও মানুষ দেখেছি অনেক কাছে থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখা।
বিশ্বাস আর ভুল বোঝাবোঝির মাধ্যমে সম্পর্কের ইতি টানা। আবার এও দেখেছি অনেক অনেক দিন পর ফোন
করেও নাম্বারহীন ফোন ধরে জানতে চাওয়া “নীলা তুই আছিস কেমন?”
এমন বন্ধুত্ত্ব আজীবন থাকুক। -{@
রিমি রুম্মান
আত্নায় আত্নায় মিশে থাকা সম্পর্কগুলো অন্যরকম এক অনুভুতি নিয়ে আসে, যা কোন শব্দের মাধুর্য দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। কেবলই অনুভবের। ভাল থাকুন সবসময়। শুভকামনা। -{@