বাড়ীটির সামনে ক’দিন ধরেই “For Sale” সাইনবোর্ড ঝুলছে। মারিয়া আর জেসন বাড়ীটির মালিক। বয়স ৮০/৯০ হবে। ওদের ড্রাইভওয়েতে গাছের ছায়ায় গাড়ীটি পার্ক করে প্রতিদিন স্কুল ছুটির সময়টাতে ছেলের জন্য অপেক্ষা করি… গান শুনি… ওদের দেখি। ওরা বাড়ীর সামনে টবে লাগানো গাছের পরিচর্যা করে… রাস্তার কিনারের বিশাল গাছ থেকে ঝরে পড়া পাতা পরিষ্কার করে… কখনো একজন অন্যজনকে হাঁটতে সহযোগিতা করে। কিন্তু কে যে কাকে সহযোগিতা করছে, কখনই আন্দাজ করতে পারিনা। কেননা, দু’জনেই বয়সের ভারে ন্যুজ। ভালোলাগা নিয়ে দেখি ওদের কফি হাতে হাসি হাসি গল্প করা…

সাতান্ন বছর আগে তরুন বয়সে অনেক স্বপ্ন আর শখের কেনা বাড়ী এটি। বলল, বড় বাড়ী… মেইনটেইন করা কষ্টকর। বয়সের কারনে ঠিকমত পাতা, স্নো, গারবেজ পরিস্কার করতে পারে না। আজ এই ডিপার্টমেন্ট টিকেট দেয় তো, কাল অন্য ডিপার্টমেন্ট। জরিমানা গুনতে হয় ক’দিন পরপর। তাই বিক্রির সিদ্ধান্ত। ওয়ান বেডরুমের এপার্টমেন্ট কিনে সেখানেই চলে যাবে। এতএত জিনিসের ভার বইতে পারবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল সৌখিন মারিয়া__ ঘর সাজানোর শখ এবং নেশা ছিল তার। যখন যেখানে যা কিছু সুন্দর দেখেছে… কিনেছে… দামের দিকে তাকায়নি। এখন বাড়ীটি যে কিনবে, সে যদি জিনিষগুলো রাখে… যত্ন করে, তাহলেই সে খুশি হবে। না রাখতে চাইলে ফেলে দিবে___ আবারও দীর্ঘশ্বাস… চোখে মুখে অসহায় বিষাদ।

ক’দিন আর ওদের দেখিনি। বাড়ীর বাইরে “Sold” সাইনবোর্ড ঝুলানো। কাল দূর থেকে ব্যাকইয়ার্ডে বসে থাকা জেসনকে দেখি। একটু একটু করে এগিয়ে যাই। কুশল জিজ্ঞেস করি। কেউ ফিরে চায়না… উত্তর করে না…নির্বাক…বুজে থাকা চোখ বেয়ে জল গড়ায়। অর্ধনিদ্রিত ভেবে আমি বিরক্ত না করে ফিরে আসব বলে ঘুরে দাঁড়াই। কাঁপা কণ্ঠে জেসন বলে উঠে, “যাচ্ছ?” আমি ফিরে চাই। বলল, মারিয়া নেই… মারিয়া ফিউনারেল হোমে… ঘুমিয়েছে চিরতরে ! ভেতরটা হুহু করে উঠে। ডানাভাঙা পাখীর আকাশে উড়তে না পারার যন্ত্রণায় ছটফট করার মতই অসহায় চাহনিতে তাকায়। এপার্টমেন্ট আর কেনা হচ্ছে না… ওল্ডহোমে বাকি দিনগুলো কাটাবে__ বলতে বলতে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো নিঃসন্তান জেসন। লাঠি ভর করে বাড়ীর ভেতরে হেঁটে যেতে যেতে বলল__ জীবন সংক্ষিপ্ত… মানুষের জীবন খুব সংক্ষিপ্ত…

আমি ফিরি ড্রাইভওয়ের দিকে। বাড়ীর সামনে ঝরাপাতার স্তুপ। টবের প্রতিদিনের পরিচর্যার গাছগুলো মৃতপ্রায়। কাল সকালের আলো ফোঁটার কিছু আগে শুরু হয়েছিলো যে বৃষ্টি… দুপুর, বিকেল, রাত্রি পেড়িয়ে আজ আরেকটি ভোর অবধি রয়ে সয়ে ঝরছে অবিশ্রান্ত ভাবে। অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীতে হঠাৎ দমকা বাতাস বইলো। এমনই দমকা ঝড় যেন দু’জন মানুষকে ইহকাল আর পরকাল নামক দুর্লঙ্ঘ্য দুই দিকে বিচ্ছিন্ন করে দিলো !

হুম… মানুষের জীবন সংক্ষিপ্ত। তবুও বাড়ী ঘিরে মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্ন… বেঁচে থাকার সবটুকু… সব সব… সবটুকু……

মনের ভেতরে খণ্ডখণ্ড কালো মেঘের আনাগোনা… মনে হচ্ছে, এই বুঝি ঝরবে অঝোরে ! একজন ভিনদেশী জেসন কোনদিন জানবে না তাদের জন্য ক্ষণকালের পরিচিত এই আমার ভেতরটাও হুহু করে…দু’ফোঁটা জল গড়ায়….

৪৪৩জন ৪৪৩জন
0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ