অপেক্ষা

মামুন ১৯ নভেম্বর ২০১৪, বুধবার, ০৮:২০:৫৮পূর্বাহ্ন গল্প ২৮ মন্তব্য

অ্যালার্ম ঘড়িটা যেন শরীরের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। রোজ ভোর সাড়ে চারটায় সে মোলায়েম স্বরে ডাকতে থাকে। যদিও মিলির শরীরের ভিতর অদৃশ্য অন্য একটি ঘড়ি প্রায় একই সময়েই ওকে জাগায়। বিছানায় শুয়ে থেকেই সে হাত বাড়িয়ে বেডসাইড টেবিল থেকে ঘড়িটির ডেকে চলা স্তব্ধ করে দেয়।

কিছুক্ষণ চোখ বুজে বেঁচে থাকাটা উপভোগ করে। জানালা দিয়ে বাইরের আকাশকে মনে মনে দেখতে থাকে। বাসার সাথেই একটি চালতে গাছ। সেখানে নাম না জানা পাখিদের কিচির মিচির কানে মধুর অনুভূতি জাগায়।পাশের বাড়িতে এই সময়ে প্রতিদিন টিউবওয়েল চাপার আওয়াজ। ওখানে কয়েক ঘর ব্যাচেলর ভাড়া থাকে। কী শীত কি গরম-প্রতিদিনই এই কল চাপার শব্দটা মিলির নেহায়েত খারাপ লাগে না। তবে কখনো এই লোকগুলোকে সে দেখে না। কেবলি তাদের উপস্থিতি দিনের শুরুতে ঐ টিউবওয়েলের সাথে শক্তি পরীক্ষার ভিতর দিয়েই যেন জানান দিয়ে যায়।

পাশে ঘুমন্ত দুই মেয়ের দিকে তাকায়।

আহা! কি নিষ্পাপ চেহারা! ঘুমন্ত অবস্থায় ওদেরকে আরো ভালো লাগে। এক ক্রমবর্ধমান মায়া কোন অজানালোক থেকে সৃষ্ট হয়ে মিলির হৃদয়কে ঘিরে উদ্বাহু নৃত্য করতে থাকে। সে জোর করে ওদের থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। একটু পরেই তো বড়টিকে ডেকে দিতে হবে। স্যারের বাসায় পড়তে যেতে হবে। তা সেই ছ’টায়। কিন্তু ওর তৈরী হতেই তো ঘন্টা পার হয়ে যায়। সে এবার জেএসসি পরীক্ষা দিবে। ছোটটি এখন ক্লাস টু তে। মিলির সাথেই রোজ স্কুলে যায়। মা মেয়ে একই স্কুলে। ঘন্টা দেড়েক পরে একজন মা তার মেয়ের টিচার রূপে দেখা দিবেন।

প্রাতঃকর্ম সেরে ফজরের নামাজ আদায় করে। এরপর অজিফা পড়ায় কিছু সময় ব্যয় হয়। বড় মেয়ের টিফিন রেডী করে টেবিলের নির্দিষ্ট যায়গায় রাখে। এরা আবার সব কিছু সঠিক যায়গাটিতে না পেলে বাড়ি মাথায় তুলে। ছোটটির পছন্দমত নাস্তাও তৈরী করতে ভুল হয়না। আর নিজের জন্য?

ঠিক সাড়ে সাতটায় ছোট মেয়ের হাত ধরে বাসা থেকে বের হওয়া। ওর স্কুলটি কাছেই। পায়ে হাঁটা পথের দূরত্বে। তবে মেইন রোড ধরে বর্ষার সময় ছাড়া যায় না। অন্য সময়গুলো মানুষের বাড়ির ভিতর দিয়ে এক সরু পায়ে চলা পথ ধরে যায়। এভাবেই চলে যাচ্ছে মিলির রোজকার জীবন। সকাল আটটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত স্কুলের ক্লাস চলে। তবে বাসায় ফিরতে ফিরতে এগারোটা বেজে যায়। মিলি বাসায় এলে ছুটা কাজের মেয়েটি আসে। মূল রান্না ছাড়া বাকি কাজগুলো ওকে দিয়ে সে করিয়ে নেয়। সাড়ে এগারোটার দিকে ওর কাছে প্রাইভেট টিউশন নিতে আসে কয়েকজন। এদের পেছনে সময় দিতে দিতে বেলা গড়িয়ে একটা বেজে যায়। এর ফাঁকে ফাঁকে রান্নার কাজটাও সেরে নিতে হয়। ছোট মেয়েটি এই সময়গুলো একান্ত নিজের করে পার করার সুযোগ পায়। সে হয় বার্বি নিয়ে খেলে, না হয় ল্যাপটপে গেমস খেলে সময়টা কাটায়। মাঝে মাঝে টিভির কার্টুন চ্যানেলগুলো থেকেও ঘুরে আসে।

ছাত্র ছাত্রীরা চলে গেলে ছোট মেয়েকে গোসল করিয়ে তাঁকে খাওয়ানোর পালা। এটা এক বিরাট ঝক্কি। এই কাজটি-ই মিলির কাছে সবচেয়ে কঠিন মনে হয়। দুপুর দুটায় বড় মেয়ে এলে তার সাথে একত্রে মিলি খেয়ে নেয়। এরপর একটু বিছানায় পিঠ লাগানোর সুযোগ পেলেও একটানা ঘুমানোর ইচ্ছে থাকা স্বত্বেও তা আর হয়ে উঠে না। কারণ চারটার দিকে কয়েকজন ওর কাছে ড্রয়িং শিখতে আসে। বিকেল পাঁচটার পরে গিয়ে মিলি ওর একান্ত ভূবনে প্রবেশ করে।

আজ প্রায় পনের বছর হল মিলি ওর সংসার সংসার খেলায় মেতেছে। এর ভিতরে গত আট বছর ধরে এভাবেই চলছে মিলির প্রতিদিনের জীবন। শনি থেকে বৃহস্পতিবার… একই নিয়মে। তবে কি শুক্রবারটা মিলির একান্ত নিজের?

নাহ! বৃহস্পতিবার রাত দশটা থেকে অন্য আর একজন ওর সপ্তাহের বাকি সময়গুলোকে কেড়ে নিতে আসে। অবশ্য সেই লোকের কাছে সময় কেন, ওর সব কিছুই দিয়ে দিতে মিলির বড্ড ভালো লাগে! সপ্তাহব্যাপী মিলি এই ত্রিশ ঘন্টার অপেক্ষায়ই থাকে!

চাতকের অপেক্ষার মতো…মিলির শত ব্যস্ততার ভিতরেও ওর অবচেতন মন এই ত্রিশটি ঘন্টার জন্য তৃষ্ণাতুর প্রহরকে পল পল করে পার করে। ওর হৃদয়ের গভীর থেকে কিছু উষ্ণ শোণিত প্রতিটি শিরা-উপশিরায় একটি বার্তাই পাঠাতে থাকে-

‘আজ বৃহস্পতিবার!’

‘আজ যে তাঁর আসার কথা!’

মেয়েরাও মায়ের এই উন্মুখতাকে লক্ষ্য করে। ওদের বাবাকে নিয়ে তাঁদের মায়ের এই অপেক্ষা এবং নির্দিষ্ট দিনটিতে থেকে থেকে প্রগলভ হয়ে ওঠা, ওদের ভিতরেও কিছুটা কি ইর্ষার উদ্রেক করে? না হলে শিহাব ঠিক পৌনে দশটায় যখন শেভবিহীন একমুখ দাড়িগোঁফের জঙ্গলসহ বাসার সদর দরোজার বেল টিপে, মিলি নিজেই দরোজা খুলতে আগায়। বড় মেয়ের এই নিয়ে কত অনুযোগ। সে বলে, ‘অন্য সময় দেখি কলিং বেল বাজলে আমাদেরকে পাঠাও কে এলো দেখতে। বৃহস্পতিবার এই সময়ে নিজে যাও কেন দরোজা খুলতে?’ ছোট মেয়েও ফোড়ন কাটে, ‘ পাপা এলে আম্মুর মুখটা কেমন হাসি হাসি হয়ে যায়, দেখেছ আপু?’ জীবনের অসহ্যকর জটিল রুটিনের ভিতর থেকে এই ত্রিশটি ঘন্টার জন্য মিলি মেয়েদের এই খুনসুটিমূলক অভিযোগকেও উপভোগ করে। শিহাব ঢুকেই যখন ওকে জিজ্ঞেস করে, ‘ কি খবর?’ মিলি একটু হেসে ওর কথার উত্তর হাসি দিয়েই জানায়। তাতেই যেন সকল কিছু বলা হয়ে যায়। সব সময় ভাবে মিলি, এই সময়টিতে কি থাকে মিলির চোখে? ওর চোখও কি হাসে? না হলে শিহাব ঐ সময় কি দেখে মিলির চোখে?

বড় মেয়ে তার পাপার জন্য ঘরের পোশাক রেডি করে রাখে। ছোটজন শেভিং কীটস বেসিনের নির্দিষ্ট যায়গায় রেখে দেয়…ল্যাপটপ চার্জে দেয়। একজন শিহাবকে ঘিরে তিন ভিন্ন বয়সের নারীর চঞ্চলতা কর্পোরেট জীবনের নাগপাশে আবদ্ধ একটি ছোট্ট দুই রুমের বাসায় এক অনাবিল প্রশান্তি বয়ে আনে! সপ্তাহান্তে এই বাসাটিতে যেন ঈদের আমেজ বিরাজ করে!

শেভ করে শিহাব যখন বেডরুমে প্রবেশ করে- মিলির কাছে প্রতিবারই ওকে কেন যেন অন্য মানুষ মনে হয়। নতুন কোনো শিহাবকে দেখছে এমনটা লাগে মিলির কাছে। ওর মনে হয় ইচ্ছে করেই শিহাব সপ্তাহব্যাপী শেভ করেনা। দু’টি ভিন্নরূপে শিহাব মিলির চোখে ধরা দিয়ে আসলে কি বোঝাতে চায়? সপ্তাহব্যাপী ক্লান্তির ক্লেদাক্ত মুহুর্তগুলোকে কি সে মাত্র ত্রিশটি ঘণ্টা দিয়ে মুছে দিতে চায়?

প্রথমদিকে শরীর নিয়ে যে উন্মত্ততা ছিল, ধীরে ধীরে তা হ্রাস পেলেও প্রগাঢ় এক ভালোবাসা সেই যায়গা দখল করেছে এখন! যতই দিন যাচ্ছে ভালোবাসা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। মিলি নিজেকে জিজ্ঞেস করে, সে কি এটাই চায়নি? সংসারে চাহিদার তুলনায় যতটুকু প্রাপ্তি এসেছে, এতেই কি সে সন্তুষ্ট নয়? শিহাবের বুকের মাঝে মাথা রেখে বহুবার এসব কথা মনে এসেছে। কিন্তু শিহাবের সংস্পর্শ সে সব কিছুকে ভুলিয়ে দিয়েছে। দেহহীন এক ভালোবাসায় বিলীন হতে হতে মিলি কত রাত এভাবে শুধু শিহাবের বুকের ভেতর ঘুমিয়ে গেছে!

সময়গুলো যেন পাগলা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে চলে যায়! বিশেষ করে এই ত্রিশটি ঘন্টা কীভাবে চলে যায় মিলি নিজেও টের পায় না।তবে সে প্রতিবারই চিন্তা করে প্রতিটি মুহুর্তকে আলাদা ভাবে সজ্ঞানে উপভোগ করবে। কিন্তু শিহাবকে পাশে পেয়ে ওর সকল চিন্তা-ভাবনা কীভাবে যেন কর্পূরের মত উবে যায়। একটা ঘোরের ভিতরে মিলি কেন জানি শিহাবকেন্দ্রিক আবর্তন করতে থাকে।

এই দু’রাত অ্যালার্ম ঘড়িটি বিশ্রাম নেয়। সপ্তাহের বাকি পাঁচদিনের জন্য শক্তি সঞ্চয় করে রাখে। মিলিও কি ঐ ঘড়িটির মত নয়?

শনিবার ভোর পাঁচটায় শিহাবের ডাকে মিলির ঘুম ভাঙ্গে। ‘ কই, ওঠো… দরোজা বন্ধ কর’ – শিহাবের এই কথায় ধ্যানমগ্ন এক যোগির গভীর আবিষ্টতায় মিলি উঠে নিঃশব্দে দরোজা বন্ধ করে। কোনো বিদায় সম্ভাষণ নেই… অন্ধকারে শিহাবের পিঠকে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে দেখা যায়। মিলি দ্রুত দরোজা বন্ধ করে সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। কোলাপসিবল গেট টেনে দেবার আওয়াজের সাথেই ভোরের স্নিগ্ধ ধোঁয়াটে আলোয় শিহাব দৃশ্যমান হয়। নীচ থেকে উপরে মুখ তুলে একবার তাকায়। গ্রীলের ওপারে দাঁড়ানো মিলিকে দেখে… একটু হাসে… হাত নেড়ে নিঃশব্দে বাই বলে সামনে পা বাড়ায়। দ্বিতীয়বার আর পেছনে ফিরে তাকায় না। মিলির হৃদয়ে কেন জানি প্রচন্ড এক বেদনা দোলা দিয়ে যায়। সে ভাবে, শিহাবেরও কি একই অনুভূতি জাগে?

না হলে শিহাব আর একবার কেন ওর দিকে ফিরে তাকায় না? ঘুমন্ত চোখের পাপড়িগুলোকে পরিষ্কার করতেই হয়তো দু’ফোটা লোনাজল গড়িয়ে পড়ে মিলির চোখ দু’টোকে আরো ঝাপসা করে দেয়। সে প্রতিবারই ঠিক এই সময়টিতে ভাবে, এবার এলে শিহাবকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবে, সে যাবার সময় আর একবার কেন পিছনে ফিরে তাকায় না? কিন্তু কোনোবারই মিলির এটা জিজ্ঞেস করা হয় না।

মিলি বারান্দা থেকে ফিরে আসে… নিজের ক্লান্তিকর রুটিন জীবনে এক সপ্তাহের তীব্র অপেক্ষা নিয়ে জীবনের বাইরে থেকে ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়।

জীবনটা এমন কেন?

৪৮৯জন ৪৮৯জন
0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ