জন্ম থেকে জ্বলছি!হ্যা তাইতো আগুনের সৃষ্টি হল সব কিছু সবাইকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারা।বহু কাল আগে তখন অবশ্য খুব ছোট একবার আমার এলাকায় এক বাড়ীতে আগুন লাগে।কিছুটা স্বরণে আছে আমরা ভয়ে আমাদের বাসা হতে যতটুকু সম্ভব জিনিসপত্র গুছিয়ে অন্যত্র সরে গিয়েছিলাম।তখন মনে এক আতঙ্ক কাজ করেছিলো।বিশাল বাড়ীটি প্রায় এক সপ্তাহ ধরে জ্বলে।তখন যোগাযোগের খোলা মাঠ থাকলেও দ্রুত আগুন নেভাতে সক্ষমতা ছিলো না  ফায়ার সার্ভিসগুলোর।এর পর শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে পারটেক্স গ্রুপের একটি ফ্যাক্টরী পুড়েছিলো এপাড় হতে দেখেছি আগুনের লেলিহান শিখা।আরেক বার বর্তমান এ ইপিজেট পূর্বে এশিয়ার বৃহত্তম আদমজী জুট মিলস এ দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আদমজীর ভিতরে রোডের দুই সাইটের বড় বড় গাছগুলোতে আগুন জ্বলে উঠে।দূর হতে দেখেছি আগুনের তীব্রতা।কি ভয়ংকর ভাবে শব্দ করে জ্বলছিলো গাছগুলো।
আজকাল বাসা বাড়ীতে আগুন লাগার ঘটনা তেমন একটা শুনতে পাই না।তবে দেশের বস্তিগুলোতে কয়েক দিন পর পর শুনতে পাই আগুন লাগার বিভৎষ কাহিনী।বস্তিগুলোতে আগুন লাগার বেশীর ভাগ কারনগুলো সু-স্পষ্ট কিন্তু কিছুই বলার নেই।এ দেশে কারনে অকারনে বিনা নোটিশে বস্তি পুড়িয়ে দেয়া এখন সবার কাছে একটি স্বাভাবিক ঘটনা।দেশে বর্তমানে ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে গার্মেন্টস ও বিভিন্ন শিল্প কল কারখানাগুলোতে।বিশেষ করে গত কয়েক বছর ধরে দেশের প্রধান অর্থকারী সেক্টর গার্মেন্টগুলোতে আগুন লাগা যেন নিত্য নৈমিত্তির ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে।
ইউরোপের জঙ্গলগুলোতে আগুন লেগে বন উজার হয়ে যায় তার অবশ্য তাদের পরিবেশ বা আবহাওয়া নষ্টের কারন থাকতে পারে কিন্তু আমাদের নাতিশীতষ্ণ ষড় ঋতু  দেশে যখন বনে আগুন লাগে তখন এখানে পরিবেশ নয় নিজ স্বার্থ হাসিলের কারন থাকে।প্রায় সময় নিউজ আসে সুন্দর বলে আগুন লেগেছে।আসলে কি তাই?নাকি কেউ আগুন লাগিয়ে দেয় বা দিয়েছে।

দেশে উল্লেখযোগ্য বা আলোচিত আগুন লাগার কিঞ্চিৎ আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।
@১৯৯০ সালের ১৭ ডিসেম্বর সারেকা গার্মেন্টে আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন ২৭ জন।
@১৯৯৫ সালে রাজধানীর ইব্রাহিমপুরের লুসাকা অ্যাপারেলসের কারখানায় নিহত হন ১০ গার্মেন্টকর্মী।
@১৯৯৬ সালে ঢাকার তাহিদুল ফ্যাশনে ১৪ জন এবং সানটেক্স লিমিটেডের কারখানায় ১৪ জন আগুনে পুড়ে মারা যান।
@১৯৯৭ সালে ঢাকার মিরপুরের তামান্না গার্মেন্ট এ রহমান অ্যান্ড রহমান অ্যাপারেলস কারখানায় নিহত হন ৪৯ জন।
@২০০০ সালে ২৫ নভেম্বর নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যার লিমিটেড গার্মেন্টস নিহত হন ৫৩ জন।সেই বছর বনানীর চেয়ারম্যান বাড়িতে গ্লোব নিটিং ফ্যাশন লিমিটেড গার্মেন্ট এ ১২ নিহত হন।
@২০০১ সালে ৮ আগষ্টে মিরপুরে মিকো ফ্যাক্টরীতে শুধু আগুন লাগার গুজবে কান দিয়ে পায়ে পিষ্ট হয়ে নিহত হন ২৪ জন তার সপ্তাহখানেক আগে মিরপুরের কাফরুলে অগ্নিকাণ্ডে ২৬ শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছিল।
@২০০৪ সাল এ ডিসেম্বরে নরসিংদীর শিবপুরে গার্মেন্ট কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৪৮ শ্রমিক নিহত হন।একই বছর ৩ মে মিসকো সুপার মার্কেট কমপ্লেক্সের এ নিহত হন ৯জন।
@ ২০০৫ সাল এ নারায়ণগঞ্জের সান নিটিং নামের একটি গার্মেন্টসে নিহত হন ২০ জন।
@ ২০০৬ সালে চট্রগ্রামে কে টি এস অ্যাপারেলস নিহত হন এ ৬৫ জন,একই বছরে  ৯ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের যমুনা স্পিনিং মিলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হন ৬ জন।এছাড়াও মার্চ মাসে সায়েম ফ্যাশন লিমিটেডে আগুনে ৩ জন শ্রমিক নিহত হন।
@ ২০১২ সালে তাজরীন গার্মেন্টসে আগুন লেগে নিহত হন ১১১ জন।একই বছরে গাজীপুর সদরে গরীব এন্ড গরীব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে ২১ জন নিহত।একই বছরে গাজীপুর আশুলিয়ায় হা মীম এ নিহত হয় ৩০ জন।
@ ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে ৭৮ হাজার ৯৫টি, নিহত হয়েছেন ১১২৫ জন, আহত হয়েছিলেন ৫ হাজার ৩৩৫ জন।
@২০১৪ সালে ১৭ হাজার ৮৩০টি অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিহত হন ৭০ আর আহত হয়েছিলেন ২১০ জন।
@২০১৫ সালে ১৭ হাজার ৪৮৮টি অগ্নিকান্ডে নিহত ৬৮ জন, ২১৬ জন
@২০১৬ সালে ১৬ হাজার ৮৫৮টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে এতে নিহত হন ৫২ জন, আহত হন ২৪৭
@২০১৭ সালে ১৮ হাজার ১০৫টি অগ্নিকান্ড ঘটে, এতে নিহত হন ৪৫ জন, আহত হন ২৬৯ জন,
@ ২০১৮ সালেই  দেশে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে ১৯ হাজার ৬৪২টি।তাতে নিহত হয় ১৩ জন,আহত হয়েছেন ৬৬৪ জন।
আলোচিত আগুন লাগার ঘটনাগুলোর মধ্যে নীমতলীর ট্র্যাজেডি ও বর্তমান আলোচিত পুরান ঢাকার চকবাজার ট্র্যাজেডি।
২০১০ সালের ৩ জুনে পুরনো ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের কারখানায় আগুন ধরে নিহত হয় প্রায় ১২৪ জন।চলছিল বিয়ের আয়োজন।কনেরা চলে গেলেন পার্লারে।বরযাত্রীরা চলে এলেন সন্ধ্যার আগেই।হঠাৎ আগুন লেগে গেল।ক্যামিক্যালের কারনে আগুনের তীব্রতা এত বিকট ছিলো যে মুহুর্তেই ছড়িয়ে পড়ল সর্বোত্র।সেই বিয়ে বাড়ীর প্রায় ৪১জন মেহমান অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন।

বসত বাড়ীর আনাচে কানাচে বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ ক্যামিক্যালের স্টক বিক্রয় এর কারনে আগুনের ভয়াবহতা বাড়ে।ঘনটার আট নয় বছর পরও সেখানের ক্ষত বা সেই সময়কার ভয়াবহতার চিহ্ন এখনো লেগে আছে অথচ সেখানকার বাসিন্দা ব্যাবসায়ীরা সরকারের চোখ ফাকি দিয়ে এ সব ক্যামিক্যালস এর ব্যাবসা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে।সরকার হাজার চেষ্টা করলেও জনগণের সহোগিতা ছাড়া এ সব জীবনের ঝুকিপূর্ণ ক্যামিক্যালের ব্যাবসা বানিজ্য অন্যত্র সরানো কষ্টকর।এ ক্ষেত্রে সরকারের কিছু গাফলতিও ছিল।
নীমতলির এ ভয়াবহ ট্র্যাজেডির কয়েক বছরের মাথায় যেন সিনেমা স্টাইলে ঘটে গেল পুরান ঢাকা চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড।চকবাজার এমন একটি এলাকা যেখানে দেশের এমন কোন ব্যাবসা নেই যে,না আছে।বিশেষ করে ছোট বাচ্চাদের বিভিন্ন প্লাষ্টিকের খেলনা,বিদ্যুত ও অন্যান্য সরঞ্জামাদির তৈরীর কাঁচামাল,আতশঁবাজি,ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন দাহ্য পদার্থের ক্রয় বিক্রয়ের মুল কেন্দ্র।একই সাথে বসবাস করছেন অসংখ্য মানুষ।বিশেষ করে সেখানকার বাড়ীওয়ালারা এসব ক্যামিক্যাল রাখার জন্য বেশ উচ্চ মুল্যে বাসা ভাড়া দিয়ে থাকেন।অথচ ভাবলেন না এই লোভ তাদের জন্য একদিন না একদিন কাল হয়ে আসবে।সেই কাল রাতটি ছিলো ২০ ফেব্রুয়ারী ২০১৯ বুধবার দিবাগত রাতে তিন’শ বছর আগের মোঘল আমলের স্মৃতি বিজরিত পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকার একটি চারতলা ভবন থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে যা পরবর্তীতে আশ পাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়ে খুবই দ্রুত।তবে আগুনের এ সূত্রপাত নিয়ে এখনো লোকজনের মাঝে সন্দেহের গুঞ্জন আছে।
প্রত্যক্ষদর্শীর মতে যতটুকু জানা যায়,পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারী সহ সরকারী তিন দিনের ছুটি।স্বাভাবিক ভাবে ব্যাবসায়ীক,পথ চারীর বিভিন্ন পিকআপ ভ্যানগাড়ী সহ প্রায় শতাধিক গাড়ীর ভিড় ছিলো,ছিলো আগত,কর্ম শেষে ফেরত যাওয়া অসংখ্য মানুষজনের ভিড়। একটি সিলিন্ডারের গাড়ী  বুধবার রাত প্রায় ১০টা ১০ মিনিটে নন্দ কুমার দত্ত সড়কের শেষ মাথায় মসজিদের পাশে ৬৪ নম্বর হোল্ডিংয়ে  এসে থামার সাথে সাথে হঠাৎ বিকট শব্দে একটি সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে উপরে উঠে নীচে পড়ে আশপাশে ক্যামিক্যালের দোকানেগুলোতে তা ছড়িয়ে পড়লে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে।আগুনের তীব্রতায় এতোই ছিলো যে নীচে যে সমস্থ গাড়ী ছিলো রিক্সা পিকাপ ভ্যান এবং সাধারণ জনগণ তৎক্ষণাত জ্বলে পুড়েঁ ছাইঁ হয়ে যায়।একটি সিসি টিভির লিংক দেখুন।
যতটুকু জানা যায় এ ঘটনায় প্রায় ৭০/৮০ জন নিহত হয়েছেন এবং অসংখ্য লোক আহত সহ ব্যাবসায়ীক ভাবে প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি হয়।

সেদিন টিভিতে আমি ২১ ফেব্রুয়ারীর শোকাহত দিবসটির লাইভ দেখতে টিভি অন করতেই প্রথম আগুন লাগার লাইভ নিউজটি চোখে পড়ে।অবাক হয়ে শুধু দেখেই যাচ্ছি সেখানকার মানুষজনে ভয়াবহ পরিস্থিতি,দমকল বাহিনীর কষ্টকর উদ্ধার কাজ।সেই রাতে আর ২১ ফেব্রুয়ারীর শোকাহত রাতে অনুষ্ঠানগুলোর লাইভ দেখা আর হল না।হয়তো আমার মত আরো অনেকে সেই ভয়াবহ রাতটির কথা ভুলবে না যা কিনা একটি জাতীয় শোকাবহ রাতে আরেকটি শোকাহত রাতের জন্ম হল।অথচ দুঃখের বিষয় হল তবুও বাঙ্গালী মানুষ হল না।সরকার যখন সচেষ্ট চকবাজারে ক্যামিক্যাল স্থানান্তরে তখন সেখানকারই কিছু অবৈধ ব্যাসায়ী বাধা দেন মিছিল করে।যেন ভাবটা এমন যে তাদের কাছে অর্থই সব।অর্থের জন্য এ সব অকাল মৃত্যু যেন তাদের কাছে নগণ্য।

দেশটা জন্ম থেকেই জলছে,জ্বালানো পুড়ানোর মধ্যে দিয়েই একটি লাল সবুজ পতাকার জন্ম।কখনো বঙ্গবন্ধুকে স-পরিবারে হত্যায় জ্বলেছিলো স্বদেশ,কখনো কু্-স্বৈরশাসনে জ্বলেছে দেশ জনতা,কখনো বা সুবিবাদী রাজাকার আলবদরের হাতে ছিলো স্বদেশ জ্বালানোর মশাল।স্বাধীনের এতোগুলো বছর পরও যখন দেশের উন্নয়ণের শির উদিয়মান তখনো আমরা সরকারের জনকল্যায়ণকর বিভিন্ন উন্নয়নে করি অ-সহযোগীতা যা প্রক্ষান্তরে আমাদের ভাবায়-আমরা যেন কেবলি জ্বলতেই অভ্যাস্ত-ভালবাসি।

তথ্য ও ছবি
অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যম।

অনুভুতিগুলোর বিশ্রাম -“কি খাচ্ছি আমরা”! পর্ব ০৩

১জন ১জন
0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ