ম্যাকডোনাল্ডস্ এর ব্রেকফাস্ট মেনু’র একটা খাবার বেশ পছন্দের। মাঝে মাঝেই খাই। আজও যাই সেখানে। খাবার ট্রেতে নিয়ে দোতলায় নিরিবিলি বসি যেন বাইরের দৃশ্য দেখা যায়। ওয়াই ফাই আছে। বিধায় খেতে খেতে আয়েশ করে নিউজ পেপারও পড়া যাবে ফোনে। কাঁচের দেয়ালে বাইরে তাকাই। কেবল দিনশুরুর ব্যস্ততা সবার।
ফোন অন করতেই বাবার ছবিটি ভেসে উঠে স্ক্রিনে। আমার বাবা ! হাসিমুখে চেয়ে থাকা মায়াময় মুখখানা ! এই মুখ দেখলে আমি একখণ্ড আবেগ হয়ে থম্কে থাকি। কত ছোট ছোট চাওয়া ছিল তাঁর। চাইলেই পূর্ণ করা যেতো। করিনি। গুরুত্ব দেইনি। ফোন করলেই কেবল আকাঙ্ক্ষার কথা, পরিকল্পনার কথা শুনাতো __ তুই দেশে আয়… তোকে নিয়ে অমুক জায়গায় যাবো… তমুক জায়গায় যাবো। আমার প্যারালাইজড বাবার পাখির মত মন। কতখানে উড়তে চাওয়া ! আমি যাইনি। চাওয়াগুলো অপূর্ণই পড়ে রইলো অনন্তকালের জন্যে !
কখনো বলতো__ পারলে মোস্তফাকে সাহায্য করিস… ওর ছেলেমেয়ে’রা লেখাপড়া করে… অভাবী… কুলাইতে পারে না। আমি সেটিও ভুলে থাকলাম। ভুলে থাকলাম, আমার বাবার একাকি সময়টাতে একাজে, ওকাজে সার্বক্ষণিক সাহায্যকারী রক্তসম্পর্কহীন মানুষটিকে। পরিবারটিকে।এমন ছোট ছোট চাওয়াগুলো সময়মত পূর্ণ না করতে পারার বেদনায় বিমর্ষ আমি খাবারে কামড় দেবার সময় দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এক হাতে খাই। অন্য হাতে চোখ মুছি…
কেউ একজনের কণ্ঠস্বরে ফিরে তাকাই। “আর ইউ ওকে”, বললেন পাশের টেবিলের বৃদ্ধ লোকটি।বলি, আই অ্যাম ফাইন। তারপর কথা হয় আমাদের আরও কিছুটা সময়। জানালেন,কাছেই থাকে। মাঝে মাঝে এখানে আসে। খায়। বসে থাকে। স্মৃতিচারণ করে। তাঁর ছোট্ট মেয়েটি প্রায়ই এটা সেটা আবদার করতো, খেতে চাইতো। কখনো দিয়েছে। কখনো দেয়নি, এড়িয়ে গিয়েছে, ধম্কে দিয়েছে। মেয়েটি এখন বড় হয়েছে। দূরের শহরে থাকে। স্বামী, সংসার, সন্তান নিয়ে ব্যস্ত। বৃদ্ধ বাবা এখনো এই শহরেই একাকি। খাবার সময়টাতে মেয়েটির কথা ভাবে। বিষণ্ণ হয়। খেতে পারে না আর।
আমার সময় ফুরিয়ে আসে। “গুড বাই” বলে বাইরে খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়াই। ব্যস্ত শহরের কোলাহলে, ভিড়ে মিশে যেতে যেতে ভাবি__ ভিন্ন ভিন্ন দেশে, ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন সময়ে জন্মানো আমরা দু’জন মানুষ। অথচ কতোই না মিল ! প্রিয় মানুষের ছোট ছোট চাওয়াগুলো পূর্ণ করতে না পারার অতৃপ্তিতে প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খাওয়া দু’জন মানুষ ! পার্থক্য শুধু __ একজন কারো পিতা, অন্যজন কারো কন্যা।
প্রিয় মানুষগুলোর ছোট ছোট চাওয়াগুলো আমরা মনের অজান্তেই কতোই না হেলা ফেলা করি। তাইনা ?
৩৩টি মন্তব্য
অরুনি মায়া
সময় থাকতেই কেন যেন এই বোধের জন্ম হয়না | আর যখন হয় তখন সেই সুযোগ হারিয়ে যায় | এই অতৃপ্তি আমাদের চিরকালের | কারণ আমরা সময়ের সম্পর্ক সময়ে ধরে রাখতে ব্যর্থ হই,,,
রিমি রুম্মান
এটাই বোধ হয় নিয়ম। হারায়ে খুঁজি আমরা।
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু কি বলবো বুঝে পাচ্ছিনা।
বাপি এখনও আশা করে তার মেয়ে তাকে কানাডা নিয়ে আসবে। নায়াগ্রা ফলস দেখতে যাবে। মামনি সেদিন বললো আচ্ছা আইসড নায়াগ্রা কেমন রে দেখতে? কি জানি দেখা হবে কিনা!
তবে জানেন আমি না আশা ছাড়িনি? আমার বাপি এতো বাচ্চা হয়ে গেছে, হুইলচেয়ারে বসে বলে কবে নিবি? আর কতোদিন?
আমার কাজিন ও সেদিন ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলো, “আমার মেসো। যাকে আমরা বসে থাকতে দেখিনি কখনো। ছুটছে তো ছুটছেই। না, না পায়ে হেঁটে নয়। পায়ে হেঁটে খুব কমই দেখেছি। সময়ের চাকায় সাইকেল-হোন্ডা-গাড়ির পর এখন সে চলে হুইল চেয়ারে বসে। যাকে একটা মিরান্ডা কিনে দিতে বললে- পুরো মিরান্ডার কেস নিয়ে আসতো, সে এখন হুইল চেয়ারে বসে কি প্ল্যান করে খুব জানতে ইচ্ছে করে। কিছু বলতে গেলে কান বাড়িয়ে দেই… ফিসফিস করে কি যেন বলে, কিছু বোঝা যায় না। হাল ছেড়ে যখন সরে আসি, তখনও সে আপ্রান চেষ্টা করে কিছু বলতে। চলে আসতে চাইলে হাত বাড়িয়ে বাঁধা দেয়। আবার ফিসফিস করে। বুঝতে পারি- তার মনে এখনো অনেক প্ল্যান…”
আপু গুমোট মেঘে অনেক অস্থিরতা কাজ করে, তাই না? ভালো থাকুন। -{@
রিমি রুম্মান
একটা সময় কঠিন, কঠোর মানুষগুলোও কেমন যেন শিশুর মত অসহায় হয়ে যায়। ভীষণ মায়া হয়। আমরাও কিন্তু একদিন এমন সময়ের মধ্য দিয়ে যাবো, যদি সেই পর্যন্ত বেঁচে থাকি। আমাদের সন্তানরাও তখন ব্যস্ত থাকবে নিজনিজ পরিবার নিয়ে। তাঁদের সান্নিধ্য পাবার হাহাকার থাকবে, জানি।
তবে, আমি আমার বাচ্চাদের কোন চাওয়া অপূর্ণ রাখি না। ওদের চাওয়াগুলো পূর্ণ করার চেষ্টা করি। কোন কিছুতে বিরক্ত হই না। বকাঝকা করি না। জীবন থেকে শিখে নিয়েছি সব। কোন হাহাকার কিংবা অতৃপ্তি যেন না থাকে।
ভাল থাকুন আপু। আপনার বাপীকে সময় দিন যতটুকু সম্ভব। আর কিছু না পারলে অন্তত ফোনে কথা বলুন। এতেই খুশি হবেন খুব।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু হুম আগে রোজ ফোন দিতাম। কিন্তু অভ্যাসের অভ্যস্ততা হয়ে ২/৩ মাস বড়ো অনিয়মিত ফোন দেয়া হতো। কাজে হেঁটে হেঁটে ওদের সাথেই কথা বলা। কি অদ্ভূত লাগে ওই একাকী পথে সঙ্গ পেয়ে যেতাম। ঠিকই বলেছেন আপু আবার রোজ ফোন দেবো। কেউ থাকেনা পাশে, আর ওরা কাছে না থেকেও জড়িয়েই আছে।
কষ্ট হচ্ছে খুব এখন। জানিনা কবে আর যাওয়া হবে। তবে আবারও দেশে গেলে যতোদিন থাকবো, ওদের সাথেই। কোত্থাও যাবোনা।
ভালো থাকুন আপনিও। -{@
ছাইরাছ হেলাল
না পাওয়ার , না দেওয়ার বোঝা আমাদের তারিত করে ই।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। এর থেকে মুক্তি নেই। তবুও আরেকটু সতর্ক তো আমরা হতেই পারি চাইলেই। ভাল থাকুন।
নীতেশ বড়ুয়া
“না পাওয়ার , না দেওয়ার বোঝা আমাদের তাড়িত করেই।” -হেলাল ভাইয়ার এই মন্তব্যের সাথে সাথে বলতে চাই যদিস অম্ভব হয় তবে যেন আমরা সবাই সবাইকে সাহায্য করি যে কোন প্রয়োজনে তবে ভুল মানুষের জন্য নয় অবশ্যই।
রিমিপু, কিছুই বলার নেই। আপনার বাবার শান্তি আর আনন্দ কামনা করছি। -{@
রিমি রুম্মান
আমার বাবা ধরা ছোঁয়ার বাইরে অন্য জগতে আছেন। আল্লাহ্ তাঁকে শান্তিতে রাখুক। ভাল রাখুক। ভাল থাকুন আপনিও।
নীতেশ বড়ুয়া
জানা ছিলো না। বাবা মায়ের আনন্দ সন্তানেরা সুখে থাকলে। ভুল করেও হলেও আবারো তাই।
ভালো থাকুন রিমিপু। -{@
তানজির খান
লেখটা পড়ে অনেক কিছু মনে পড়ে গেলো। লেখার অনেক কিছুই আলাদা কিন্তু আবেগটা এক।
আব্বা কে খুব মনে পড়ে গেলো।অনেক কিছুই আর পাওয়া হবে না। অনেক সখ আর মেটানো হবে না।
রিমি রুম্মান
অনেক শখ আর মেটানো হবে না আমারও। 🙁
স্বপ্ন
আপনার জীবন উপলব্দি খুবই সুন্দর,আপনার লেখা গুলো পড়ি, আর বাবা,মা,ভাই,বোন,আত্মীয় সজন চেনা মানুষদের প্রতি পুর্বের তুলনায় দায়িত্ববান হই।আপনার লেখাগুলো অন্য রকম,আমাকে অনেক পালটে দিয়েছে। ধন্যবাদ আপু আপনাকে।
জিসান শা ইকরাম
মায়াবতীর পোষ্ট দেয়া সার্থক 🙂
লীলাবতী
আপু মায়াবতী? বাহ! মায়াময় যেভাবে পোষ্টের পর পোষ্ট দিয়ে যাচ্ছেন,তাতে মায়াবতী বলাই যায় 🙂 -{@
রিমি রুম্মান
মায়াবতী নামটা পছন্দ হইসে। নিজেকে লীলাবতী আপু’র বোন মনে হইতাসে। 🙂
রিমি রুম্মান
আমাদের জীবন থেকেই আমরা শিখি একটু একটু করে। সতর্ক হই। প্রিয় মানুষগুলোর প্রতি যত্নবান হই। ভাল থাকুন সবাইকে নিয়ে। শুভকামনা রইলো। -{@
জিসান শা ইকরাম
আপনার লেখা গুলো মানুষে মনে দাগ রেখে যায়
ভাবায়……
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন সবসময়। শুভকামনা নিরন্তর।
লীলাবতী
‘ ভিন্ন ভিন্ন দেশে, ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন সময়ে জন্মানো আমরা দু’জন মানুষ। অথচ কতোই না মিল !’…… দুজনের মনে একই শূন্যতা।পুরো লেখার অতৃপ্তি যেন আমার নিজেরই।কত কিছু ভাবেন আপনি আপু।নিজের উপলব্দি গুলো আপনার মত গুছিয়ে লিখতে পারবো না কোনদিন।
রিমি রুম্মান
আমরা একে অপরের লেখার ভক্ত। আমি আপনার মত করে লিখতে পারবোনা যেমন, তেমনি আপনিও আমার মত। ভিন্ন রকম লেখার স্বাদ পাওয়া আমাদের। ভাল থাকুন। শুভকামনা রইলো।
শুন্য শুন্যালয়
দেশ ভিন্ন হলেও মানুষের অনুভূতিগুলো সব একই আপু। একজন অসির সাথে গল্প করতে গিয়ে একদিন আমার হাজব্যান্ড বলছিল, তাদের আর আমাদের কালচার আলাদা। কথা শেষ হবার পর মিষ্টি করে সে হেসে বললো, আমার বাবা মা আমার কাছে থাকে। আমি তাদের ছেড়ে থাকার কথা কখনো ভাবিনি। আসলে শুনে খুবই অবাক হয়েছিলাম সেদিন।
অতৃপ্তি থাকবেই আপু, সেগুলো ভেবে মন খারাপ হয় খুব। তবে বাবা মা কখনো আমাদের চাওয়া অপূর্ন রাখেনি, কষ্টটা সেখানেই। আমরা আমাদের সাধ্যে যা কুলায় তাতে সবাইকে যেন খুশি রাখতে পারি। ছোট্ট ছোট্ট ঘটনাগুলো আপনার হাতে অসাধারন হয়ে ওঠে, ভাবায়।
রিমি রুম্মান
ছোট ছোট চাওয়াগুলো আমরা কত সহজেই এড়িয়ে যাই, তাই না ? ভাল থাকুন আপু।
মরুভূমির জলদস্যু
## আমার সময় ফুরিয়ে আসে। “গুড বাই” বলে বাইরে খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়াই। ##
সব সময়ই এমন হয়…..
রিমি রুম্মান
সময়গুলো একটা সময় শেষ হয়ে আসে। আমরা আবারো ব্যস্ত হয়ে উঠি …
ভাল থাকুন। শুভকামনা রইলো।
মেহেরী তাজ
এতো সুন্দর করে গুছিয়ে লেখেন আপু। ঘটনা গুলো মনে থাকে বেশ কিছু সময় ধরে। বেশ ভালো লাগে আপনার লেখা। -{@
রিমি রুম্মান
পড়া শেষ হবার পরও যে লেখার রেশ থেকে যায়, সে লেখার সার্থকতা সেখানেই। ভাল থাকবেন সব সময়।
আগুন রঙের শিমুল
জীবন আমাদের সাথে কখনোই ফেয়ার প্লে নীতিতে খেলেনা , আফসোস
রিমি রুম্মান
তবে আমরা কিন্তু চাইলেই এখন থেকেই সতর্ক হতে পারি। সম্পর্কগুলোর প্রতি যত্নবান হতে পারি। তাই না ?
ভাল থাকুন সবসময় প্রিয় মানুষগুলোর সান্নিধ্যে …
আবু খায়ের আনিছ
সময় গেলে সাধন হবে না……..
কি বলব বুঝতে পারছি না, আমি নিজেও যে বড় বেশি স্বার্থপর। অনেকগুলো হাত, চোখ আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকে, আমি কি করে সবার চাওয়া পূর্ণ করব।
রিমি রুম্মান
আমরা আমাদের সাধ্যের মাঝেই ছোট ছোট চাওয়াগুলোর প্রতি যত্নবান হতে পারি চাইলেই।
ভাল থাকবেন প্রিয় মানুষগুলোকে নিয়ে, সম্পর্কগুলোকে নিয়ে। -{@
আবু খায়ের আনিছ
সম্পর্ক! ছোট্ট জীবনে এত হারিয়ে যাওয়া দেখেছি যে একটা প্রশ্নের উত্তর একটা সময় খুব জানতে ইচ্ছা করলেও এখন আর করে না। তবু মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্নটা করি, সম্পর্ক কোথায় হারিয়ে যায়?
রিমি রুম্মান
সম্পর্ক হারায় না। আশেপাশেই থাকে। শুধু খুঁজে পাওয়াটাই বড় ব্যাপার। ভাল থাকুন সবসময়।