কথায় মানুষ খুব দ্রুত প্রভাবিত হয়, তবে সবার কথায় না। কিছু কিছু মানুষ আজীবন শুধু বলেই যায়, তাদের কথা কেউ বিশেষ কর্ণপাত পর্যন্ত করে না। কিন্তু এই কিছু মানুষের বাইরে আরও অল্প কিছু মানুষ থাকে, যাদের দীর্ঘশ্বাসও মানুষের মনে বিশেষ অর্থ জাগিয়ে তোলে। ঠিক কী কারণে কিংবা কেন এমনটা হয় তার সঠিক কোন ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব না। এমন না যে তারা দেখতে সুদর্শন কিংবা তাদের কণ্ঠ সুমধুর বলেই এমনটা হয়। অথবা তাদের চিন্তাভাবনা অন্য সকলের তুলনায় অনেক অনেক ভিন্নতর হয়, এমনও নয়। তারাও আর দশজন সাধারণের মতই চিন্তাভাবনা করে একদম সাধারণ কথাই বলে। তবুও এই সাধারণ কথাই অন্য সকলের কাছে অসাধারণ কিছু হয়ে উঠে।
এরকম একটা হিসেব কষে যদি ভাবা হয় তবে আমাকেও সে তালিকার একজন ধরা যেতে পারে। অবশ্য এর কৃতিত্ব একক ভাবে আমার নয়। এই ব্যাপারটার সাথে বংশানুক্রমিক জিনের কোন একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। একদম নিশ্চিত না হলেও আমার জন্যে এমনটা ভাবা একদম অমূলক বলা যাবে না। কারণ জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখেছি আমার বাবার কথায়ও মানুষ খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তার কোন একটা সিদ্ধান্ত বিনাবাক্যে সকলে মেনে নেয়। তার উত্তরসূরী হিসেবে আমার কথাতেও মানুষের গুরুত্ব কিংবা প্রভাবিত হবার ব্যাপারটা আমাকে কখনোই তেমন অবাক করত না।
হ্যাঁ, একটা সময় পর্যন্ত সত্যিই এই ব্যাপারটা আমায় মোটেই অবাক করত না। কিন্তু সব পরিবর্তন হয়ে গেল ছোট একটা দুর্ঘটনা ঘটবার পর। ঠিক কি কারণে জানা নেই, একদিন বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবার সময় শিমুল যখন ওর গার্লফ্রেন্ডের প্যারা নিয়ে আক্ষেপ করছিল তখন বলেছিলাম- ‘তোর উচিৎ সিলিং ফ্যানের তিন পাখায় তিনটা গামছা বেধে ঐ তিনটা একত্রে করে একটা ফাঁস বানিয়ে তারপর তা গলায় গলিয়ে ঝুলে পরা’।
ব্যাস ঐ ওটুকুই কথা, আসলে আমরা প্রতিদিন ওর ঐ এক ঘ্যান ঘ্যান শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই কিছুটা বিরক্ত আর মজা করার জন্যেই ও কথা বলেছিলাম। বাকি সবাইও ঐ মজার কথাটাকে মজা ধরে নিয়েই ওকে ক্ষেপাচ্ছিল। কেউ কেউ ঐ অবস্থাতে সেল্ফি তুলে ওর গার্লফ্রেন্ডকে পাঠানোর আইডিয়া দিচ্ছিল, আবার কেউ বলছিল গার্লফ্রেন্ডকে উদ্দেশ্য করে সুসাইড নোট লিখে তারপর ঝুলে যাবার জন্যে।
এরপরই দ্বিতীয় ভুলটা করলাম; অবশ্য তখন ওটাকে কোনভাবেই আমার ভুল মনে হচ্ছিল না। বললাম- ‘সবচেয়ে ভালো হয় তুই যদি ঝুলে যাবার পুরো ব্যাপারটা লাইভ করে দেখাস, তাতে জনগনের সাপোর্ট আর গার্লফ্রেন্ডের উপর প্যারার রিভেঞ্জ নেয়া, দুটোই হয়’। আর যায় কোথায়, সকলেই আমার আইডিয়াকে বাহ্বা দিতে দিতে শিমুলকে এই কাজ করার জন্যেই কথার খোঁচা মেরে যাচ্ছিল।
তারপর সন্ধ্যাটা ওভাবে শেষ করে যে যার বাসায় কিংবা মেসে ফিরে গেলাম। খুব ঘুম পাচ্ছিল বলে ফিরে এসে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেই ঘুম ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে একদম রাত আড়াইটা! মোবাইলটা সাইলেন্ট করা ছিল, তাই কিছুই টের পাই নি। স্ক্রিনে দেখলাম মিসকলের বিশাল এক নোটিফিকেশন লিস্ট দেখা যাচ্ছে। ৮৬টা মিস কল সেখানে! এক একজন গড়ে ৬~৭ বার করে কল করেছে। সবার উপরের নাম্বারটা ছিল সুমনের। তাই ওকেই কল ব্যক করলাম। রিং পুরোটা হবার আগেই ও প্রান্ত থেকে কলটা রিসিভ হয়ে গেল!
খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে সুমন বলল- ‘দেখেছিস?’। সুমনের এই উত্তেজনার জন্যে ওর সাথে কথা বলাই দুস্কর। ছোটখাটো থেকে শুরু করে গুরুতর সব কিছুতেই ওর সীমাহীন উত্তেজনা কাজ করে। তাই বোঝা দুস্কর কোনটা আসলে উত্তেজিত হবার মত ঘটনা, আর কোনটা সাধারন। তাই প্রশ্নের বিপরীতে ওকে প্রশ্নই করতে হল-‘কী?’
– কী মানে? তুই এখনো দেখিসনি? কোথায় তুই? কই ছিলি এতক্ষণ?
– আরে ব্যাটা ঘুমাচ্ছিলাম। এখন বল কি দেখবো? হয়েছে টা কি?
– তার মানে তুই কিচ্ছু জানিস না?
– আরে এত্ত না পেঁচিয়ে কি দেখব, আর কি জানতে হবে সেটা বলতে পারিস না?
– তুই দ্রুত ফেসবুকে লগইন কর, আর শিমুলের ওয়ালে ঢু মেরে আমাদের গ্রুপ চ্যাটে দেখ।
বলেই কলটা কেটে দিল। ব্যাটা আহাম্মকের আহাম্মক, কি হয়েছে সেটা না বলে আমাকে বলে কিনা ফেসবুকে ঢুকতে। তবে শিমুলের কথা বলায় একটু আগ্রহ হল। বিকেলেই গার্লফ্রেন্ডের প্যারা নিয়ে কান্নাকাটি করছিল। মনে হয় এবারে ব্যাটা ব্রেকআপ-ট্রেকআপ কিছু একটা করে ফেলেছে। আর সেটা নিয়েই সুগভীর কোন পোষ্ট দিয়ে বসে আছে ফেসবুকে। অবশ্য এমনিতেও এখন আমি ফেসবুকেই ঢু মারতাম।
ফেসবুক এ্যাপটা চালু করে শিমুল নামটা সার্চ দিয়ে ওর প্রোফাইলে গলাম। সেখানে একটা লাইভ ভিডিওর পোষ্ট রয়েছে। অবশ্য এখন আর লাইভ নেই, প্রায় ঘন্টাখানিক আগে সেটা শেষ হয়েছে। এখন ওটার ভিডিওটা পোষ্ট হিসেবে রয়ে গেছে। ব্যাটা নিশ্চিত গার্লফ্রেন্ডের প্যারার বর্ণনা দিয়ে কান্নাকাটি করতে করতে বিশাল কোন ইমোশনাল লাইভ ভিডিও করেছিল। ক্লিক করলাম ভিডিওটাতে, কিন্তু ক্লিক করে যা দেখলাম সেটার জন্যে আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।
শিমুল প্রথমে ক্যামেরাটা ওর রুমের বুকসেলফের কোথাও সেট করল, মোটামুটি ঐ পজিশন থেকে ওর রুমের বিশাল একটা অংশ তাতে স্ক্রিনে চলে আসে। এরপর একটু দুরত্বে দাড়িয়ে শুরু করল ওর গার্লফ্রেন্ডের প্যারার বন্দনা। এতটুকু অবশ্য আমি আশা করেই রেখেছিলাম। কিন্তু ঐ অবস্থাটা বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হল না, কথার মোড় ঘুরে গেল আমার নাম উচ্চারণের সাথে সাথে। নাম ধরেই বলল আজ বিকেলে কি আইডিয়া দিয়েছিলাম ওকে, আর সেই আইডিয়াই সে এখন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে বলে ঘোষনা করল!!
তারপর বিছানার উপর হতে কিছু একটা তুলল, হাতে নেবার পর বুঝলাম ওগুলি আসলে গামছা। ওর স্টাডির চেয়ারটা বিছনার উপর তুলে তার উপর ও দাড়াল। এরপর ঠিক যেভাবে বলেছিলাম ওভাবেই তিনটি গামছা সিলিং ফ্যানের তিন পাখায় বাধল। আর তারপর গামছা গুলি একত্র করে ওটা দিয়ে একটা ফাঁস তৈরি করল। আমি নিশ্বাস চেপে ওর কাণ্ডকারখানা দেখছি। তবে মনে মনে ক্ষীণ একটা আশা চেপে ধরে আছি যে শেষ পর্যন্ত ও আসলে ওরকম কিছু করবে না।
তারপর আবার চেয়ার হতে বিছানা আর বিছানা হতে নেমে স্ক্রিনের সামনে এসে দাড়াল। সত্যি সত্যি এর পরে যা কিছু ঘটবে তার জন্যে সকল দায়ভার ও ওর গার্লফ্রেন্ডের উপর দিল আর আমাদের সবাইকে বিদায় জানাল।
এবার আমি সত্যি সত্যি ঘামতে শুরু করলাম। অন্য মোবাইলটা দিয়ে ততক্ষনে আবারও সুমনকে ফোন করতে শুরু করেছি। রিং হচ্ছে কিন্তু ব্যাটা এখন আর ফোন উঠাচ্ছে না। আর এদিকে মোবাইল স্ক্রিনে দেখছি শিমুল আবারও বিছানার উপর দাড় করানো চেয়ারটাতে উঠে দাড়িয়েছে। এরপর কাঁপা কাঁপা হাতে তিন গামছা দিয়ে তৈরি ফাসটা গলায় পড়ে নিচ্ছে।
গামছার ফাসটা গলায় গলিয়ে দেবার পর ঐ অবস্থাতেই চিৎকার করে বলল- “দোস্ত তোকে ধন্যবাদ চমৎকার এই আইডিয়াটা দেবার জন্যে”। এরপর বাকিটুকু আর দেখা হল না, হাত থেকে মোবাইলটা খসে পড়ল আপনা-আপনি।
তারপর কিভাবে কি হয়েছে তা আর আমি তেমন পরিস্কার ভাবে বলতে পারছি না। ঘোরের মাঝে সময়টা পার হয়েছে আমার। মাথাটা পুরো ঝিম মেরে ছিল পরের পুরোটাা সময়। তবে এখন মাথাটা আবার পরিস্কার ভাবে কাজ করতে শুরু করেছে। আর কিছুক্ষন পরেই কয়েকজন গার্ড আসবে আমাকে এই সেলটা থেকে নিয়ে যেতে।
ঠাণ্ডা মাথায় উদ্দেশ্যপ্রনেদিত ভাবে বন্ধুকে আত্মহত্যা করার নিমিত্তে প্রভাবিত করার জন্যে কোর্টে বিজ্ঞ বিচারক আমার ‘মৃত্যুদণ্ডাদেশ’ কার্যকর করার রায় দিয়েছেন…..
– গল্পঃ আত্মহত্যার প্রভাবন
– নভেম্বর ০৩, ২০১৬
৪টি মন্তব্য
শুন্য শুন্যালয়
রুদ্ধশ্বাসে পড়লাম। পড়তে পড়তে সত্যিই মনে হচ্ছিল, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ। আপনার লেখা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই, অলিভারের লেখা দেখলেই চাংগা হয়ে যাই।
অনেক বড় একটা মেসেজ দিলেন। আন্তর্জালে আমরা এমনই জড়িয়ে গেছি যে এরকম অভিনব ভাবে চমকে দিতেই আনন্দ, যত অভিনব হবে, ততো চমক।
বন্ধুদের সাথে আমরা অনেক সময় দিলেও অনেক সময়ই বুঝতে পারছিনা, সে কতোটা মানসিক প্রেশারে যাচ্ছে।
লেখাটা পেইন দেবে কিছুদিন বুঝতে পারছি।
মোঃ মজিবর রহমান
আমরা আড্ডা ছলে অনেক কিছুই বলি যেগুলো কে কি ভাবে নিচ্ছে বা নেবে তা কিন্তু বলা কারও পক্ষেই সম্ভব না। তাই আড্ডা দেবার সময় হিতা হিত গ্যান থাকে না। তবে এইরকম ঘটনা মানুষকে আজিবন কষ্ট দেই।
নীলাঞ্জনা নীলা
উফ শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী। টানটান উত্তেজনা একেই বলে। বর্তমানের প্রেক্ষিতে দারুণ একটি গল্প লিখেছেন। গল্প নয়, আসলে এমন তো হরহামেশাই হচ্ছে। কী ভয়ঙ্কর!
আপনার গল্পের কথা কী বলবো? মুগ্ধ হই বারবার।
জিসান শা ইকরাম
পড়তে পড়তে গাঁয়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো,
গল্পের কাহিনী বুনন অত্যন্ত দৃঢ়।