শিশু কালের পর আসে কৈশোর কাল যখন কিশোরদের লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায়, আনন্দ ফুর্তিতে দিন কাটানোর কথা। বিশেষ করে গ্রামের কিশোরদের মাঠে ঘাটে, খালে বিলে, খেলাধূলা করে, মাছ ধরে এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে নিজেদের জীবনের শ্রেষ্ট সময় পার করার কথা। কিশোরীদের পুতুল খেলার কথা ঠিক সে সময়ে গ্রামের অধিকাংশ কিশোরী হচ্ছে বাল্যবিবাহের শিকার। তাঁরা জীবন কি তা বুঝার আগেই ঢুকে যাচ্ছে জগত সংসারের জটিল কুটিল ভুবনে। নিজেদের স্বপ্ন সাধ সবকিছু বলি দিয়ে পরিবারের আর সমাজের অশুভ বাল্যবিবাহের বলি হচ্ছে এরা। ভয়ংকর সত্য হচ্ছে যে কিশোর বয়সেই তাঁরা মা হয়ে যাচ্ছে। নিজের শরীর আর মাতৃত্ব কি জিনিষ তা বুঝার আগেই তাঁরা হয়ে যাচ্ছে মা জড় পদার্থের পুতুলের পরিবর্তে তাঁদের হাতে এসে পড়ছে রক্তমাংসের মানুষ। ফলশ্রুতিতে কিশোর বয়সে মা হওয়ার কারণে কঠিন এবং বিরাট স্বাস্থ্যের হুমকির মধ্যে পড়ছে কিশোর মায়েরা। অনেকে সন্তান প্রসবকালীন সময়ে বা পরবর্তীতে রক্তশূন্যতা এবং অপুষ্টির কারণে মৃত্যুর মুখে পড়ছে। বাংলাদেশ সারা বিশ্বে কিশোর মাতৃত্বে ৩ নম্বর স্থানে অবস্থান করছে। সম্প্রতি দেশে বাল্য বিবাহ আইনের বিশেষ ধারা পাশের ফলে বাংলাদেশে আশংকাজনকভাবে কিশোর মাতৃত্বের হার বেড়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বর্তমানে চলমান বৈশ্বিক মহামারি বা অতিমারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে গেল প্রায় ১৮ মাস স্কুল বন্ধ থাকায় মেয়ে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফী দিতে না পারার পাশাপাশি ভরণ পোষণ চালিয়ে নিতে না পারার কারণে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেক অভিভাবক তাঁদের মেয়েদেরকে বাল্যকালে বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। এবং এমন বিয়ের হার ভয়ংকর এবং উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
অনেক মেধাবী, খেলাধুলায় পারদর্শী, হস্তশিল্প, কারুশিল্প সহ বিভিন্ন আবহমান গ্রামীণ বিভিন্ন জীবনধারণ মূলক এবং পেশাধারী কাজে সিদ্ধহস্ত কিশোরীদের তাঁদের বিদ্যা, মেধা, বুদ্ধি, সৃষ্টিশীল ও মননশীল কাজ কর্মের বিকাশ আর প্রকাশের সুযোগ না দিয়ে তাঁদের লেখাপড়া আর খেলাধুলার স্বর্ণালী সময়টাকে পা দিয়ে গুড়িয়ে দিয়ে তাঁদেরকে বাল্যবিবাহে বাধ্য করা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে কিশোরী বয়সেই এরা মা হয়ে পড়ছে। এদের মধ্যে ১৯ বছর পার হওয়ার আগেই শতকরা আশি ভাগ কিশোরী গর্ভবতী হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে “কিশোরী মা” এর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেশী। আবার এদের মধ্যে শতকরা ষাট ভাগের বেশী রক্তস্বল্পতা এবং অপুষ্টিতে ভুগছে। ১৮ বছর পার হওয়ার আগে কিশোরী অবস্থায় মা হবার মতো মানসিক ও শারিরীক অবস্থা তৈরী হয়না এবং শিশুকে দুধ খাওয়ানো এবং লালন পালন করার মতো যথেষ্ট জ্ঞান আর বুদ্ধিও হয়না এদের মধ্যে। এ প্রসঙ্গে –বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেটোম্যাটার্নাল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. ফিরোজা বেগম বলেন, “যে তার নিজের যত্ন নিতেই ঠিকমতো শিখে নাই সে কি করে তার গর্ভাবস্থায় বাচ্চার যত্ন নেবে”। শঙ্কার জায়গা হচ্ছে কিশোরীদের গর্ভপাতের সংখ্যা এবং গর্ভপাতজনিত জটিলতায় অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ, ইনফেকশন বা সেপটিক হয়ে অনেক কিশোরী মায়ের মৃত্যু হয় আবার অনেকে বেঁচে গেলেও রক্তস্বল্পতা রোগে ভোগে ও প্রদাহের কারণে তাঁদের প্রজনন ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলতে পারে।
আমাদের উচিৎ মেয়েদেরকে ১৮ বছরের আগে বিয়ে না দেয়া এবং তাঁদেরকে লেখাপড়া শিখিয়ে বা হস্তশিল্প, কারুশিল্প বা অন্যান্য আবহমান বাংলার জীবন ধারণ মূলক কাজ কর্ম শিখিয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেয়া। পাশাপাশি স্বামীদেরও উচিৎ ২০ বছর আগে সন্তান নেয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত বা বাধ্য না করা। তাছাড়া যথাযথ জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করা যাতে গর্ভভজনিত কোন সমস্যার উদ্ভব না হয়। আমাদের পরিবার, সমাজ, রাজনীতিবিদ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান, এন জি ও, কমিউনিটি ক্লিনিক সহ সকলের সমন্বিত এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে উচিৎ নিষ্ঠা আর মমতার সাথে গ্রামীণ এবং শহুরে বস্তবাসী কিশোরীদের যথোপযুক্ত স্বাস্থ্য সেবা প্রদান আর নিশ্চিত করা। সর্বোপরি বাল্যবিবাহ নিরোধে তাঁদেরকে উৎসাহিত করা, প্রয়োজনে দরিদ্র পরিবারগুলোকে বাল্যবিবাহ নিরুৎসাহের জন্য বিভিন্ন আয় বর্ধক কাজে এবং সমাজ উন্নয়ন মূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকার হওয়া উচিৎ। যাতে করে সমাজে মেয়েদের মর্যাদা, সম্মান, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের সুযোগ বাড়ানো যায়। এই অবহেলিত কিশোরী মাদের মারাত্মক ও ঝুঁকিপূর্ণ নিরাপদ মাতৃত্ব হিসাবে গড়ে তোলার সাথে সাথে আমাদের দেশের জনসংখ্যার হার কমানোর জন্যেও দেশে বাল্য বিবাহ বন্ধ করা উচিৎ। জনসংখ্যার ভারে বাংলাদেশ এখন নানান সঙ্কটে জর্জরিত। সুন্দর, সুষ্ঠু এবং সুশৃঙ্খল জাতি গঠনের জন্য জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য বাল্য বিবাহ বন্ধ করা এবং তাঁদেরকে দুইয়ের অধিক সন্তান না নেয়ার জন্য সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালানো অতীব জরুরী। এবং তা সবার বিবেচনায় রাখা উচিৎ।
ছবিঃ সংগৃহীত ।
১৩টি মন্তব্য
আলমগীর সরকার লিটন
বেশ সচেতনামূলক পোষ্ট কবি দা অনেক শুভেচ্ছা রইল
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
ধন্যবাদ ভাইয়া।
ছাইরাছ হেলাল
আমাদের সমাজে বাল্য বিবাহের চল বহু পুরনো, চট করে এর প্রভাব থেকে৩ বের হওয়া কঠিন।
তবুও সবাই এখন ক্রমান্বয়ে সচেতন হচ্ছে, কিছু আইনি কার্যক্রম চালু হচ্ছে, মোটকথা সবার সজাগ সতর্কতা দরকার।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
সঠিক বলেছেন ভাইয়া — “তবুও সবাই এখন ক্রমান্বয়ে সচেতন হচ্ছে, কিছু আইনি কার্যক্রম চালু হচ্ছে, মোটকথা সবার সজাগ সতর্কতা দরকার”।
আপনার গুরুত্বপূর্ণ মতামতের জন্য ধন্যবাদ।
মনির হোসেন মমি
বাল্য বিবাহ নিয়ে চমৎকার একটা পোস্ট। এখন অনেকটা কমেছে।মানুষ যত সচেতন হবে ততই এর প্রভাব কমবে।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
মতামতের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
মোঃ মজিবর রহমান
জনসচেতনামুলক পোষ্ট। সমাজের আর্থিক স্বচ্ছলতা না আসলে আর সমাজের গরিবের নিরাপত্তা না থাকলে বাল্যবিয়ে বন্ধ হবএ না পরিপুর্ণ।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ অশেষ।
মোঃ মজিবর রহমান
আপনাকেও ধন্যবাদ ভাইজান।
হালিমা আক্তার
বাল্যবিবাহের প্রকোপ মাঝখানে কয়েক বছর মনে হয় কম ছিল। আবারে প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছুই করার থাকেনা। কষ্ট হয় যখন দেখি মেধাবী শিক্ষার্থী গুলো ঝরে পড়ছে। শুভ কামনা রইলো।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
হ্যাঁ আপা, দেড় বছরের করোনাকালে বাল্য বিবাহ আমার বৃদ্ধি পেয়েছে। ধন্যবাদ আপা।
নার্গিস রশিদ
সমাজে সচেতনা বৃদ্ধি খুবই জরুরী। দরিদ্র পরিবারে এই প্রকোপ আরও বেশী। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে মাথা থেকে বোঝা নামায়। চকরাকারে ঘুরতে থাকে একই সমস্যা। এই সমস্যা থেকে বের হতে হলে মেয়েদের কে যদি শিক্ষিত করা যেতো তারা তখন নিজেদের সমস্যা গুলো পরবর্তী জেনারেশনে নিয়ে যেতো না।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপা আপনি এ সমস্যার মূল জায়গায় হাত দিয়েছেন। নারী শিক্ষার আসলে বিকল্প নেই। অসংখ্য ধন্যবাদ।