রাতভর তুমুল বৃষ্টি। শান্তির ঘুমে প্রতিটা ঘর। চারদিকে শুনশান নিরবতা। এটা আসলে একেবারেই গ্রাম। মফস্বল ঠিক বলা যায় না। আকাশে একফোঁটা আলো নেই। সন্ধ্যাতারাও আজ সন্ধ্যাকাশে উঁকি মেরে ডুবে গেছে ঘন মেঘের অন্তরালে। শুধু মুখ থুবড়ে পড়ে আছি আমি। আমার মুখ ভরা মাটি। মাটির স্বাদ কেমন যেনো! না লবনাক্ত না পানসে। আমি এখন একটা লাশ মাত্র। পড়ে আছি নিথর। ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, কানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কেঁচো। পিঁপড়ের দল লাইন ধরেছে। বরষার ফোটার সাথে পাটগাছগুলো দারুন দোল খাচ্ছে। আমি বেঁচে থাকতে এমন সুন্দর দৃশ্য আগে কেনো উপলব্ধি করিনি! ওরা চলে যাবার আগে আমার চোখ দুটো খোলাই রেখে গেলো। নির্বাক অপলোক চোখের দুষ্টির সাথে মস্তিষ্কের যোগ আছে। আছে শ্রবনইন্দ্রিয়ের যোগ। তাই তো হৃদস্পন্দন থেমে গেলেও মস্তিষ্ক নামক কারিগর তখনও যেনো জেগে থাকে আরো কিছু সময়। আমি এখনও ক্ষীন জেগে। আমি টের পাচ্ছি সব। স্মৃতিতে উঠছে নামছে মায়ের মলিন শাড়ি, বেড়ার ঘর, আমি ছেলে না হয়ে মেয়ে হওয়ায় বাপের অকারণ আক্ষেপে আমাকে দিনরাত গালি বর্ষনের সে সব সময়। গরিবের ঘরে শ্যান্না মেয়ে বিয়ে না হওয়ার যন্ত্রণা। কোনোরকম স্কুল পাশ। কোনোরকম ভিটের উপর ভাঙা বেড়ার ঘরে মেট্রিক পাশ মেয়ের জন্য যে পাত্র আসে তা আধাবুড়ো, বউ মরা, বা সতীন আছে এমন।
মেট্রিক নামক সার্টিফিকেট নিজস্ব যে ব্যাক্তিসত্বা তাতে সে সব বিয়েতে হার মানা যেনো নিজের মৃত্যুর সনদ নিজেই লেখা।
আমার পরোনের পোষাক ঠিকঠাক আছে। পর্দার বিধান যাকে বলে তা সব ঠিকঠাক তখনও।
ছাই রঙামেঘের একটা বোরখা নতুন করে বানানো। গার্মেন্টস এর বেতন পেয়ে খুব শখ করে নতুন ডিজাইনের এ বোরখাটা করেছি।
কি যেনো নাম! ও হ্যাঁ, প্রজাপতি ডিজাইন। হাতটা মেলে ধরলে মনে হয় আমি যেনো সত্যিই এক প্রজাপতি।
নিত্য সংসারের এমন শব্দ দূষনে বাড়িতে মায়ের উপর অভিমান করে ঘর থেকে বের হয়েছিলাম।
মিস্ কলে পরিচয় সবুজের সাথে আমার। মুইটে বেঁচা টাকা দিয়ে এক বছর ধরে জমায়ে এগারোশো টাকা দিয়ে এ ফোনটা কিনেছিলাম। সারাক্ষণ তার ফোন আসতে থাকতো। রিংটোনের শব্দ পেয়েই গবরের মুইটে বানানো হাত কাপড়ে মুছে কানে ফোনে কথা বলতে বলতেই মুইটে বানাতাম। শতো অনুযোগ অভাবেও দিন রাত আমার সুখে ভাসতে লাগলো। সালনে(তরকারিতে) লবন বেশি না কম দিলাম তাতে আমার খেয়ালই থাকতো না।
আয়না দেখা বেড়ে গেলো আমার। সাজতে লাগলাম যেনো আরো সযতনে। মায়ের চোখ আমার এড়ালো না।
মা আমার হাতে ফোন দেখলেই নিত্য বকা শুরু করতো। বাগেরহাট যাত্রাপুর আমার বাড়ি। তাই সাতপাঁচ না ভেবে বাগেরহাট বাসে উঠে বসলাম। চলে এলাম সোজা ঢাকা। সে থাকে ঢাকা। গার্মেন্টস এ কাজ করে সে। আমাকেও তার গার্মেন্টসএ কাজ ঠিক করে দিলো।
আমি কাজ সেরে এলাকার এক বোনের ঘরে থাকতে শুরু করলাম।
গার্মেন্টস ছুটি হলে আমরা দুজনে একসাথে আসতাম। পথে রিক্সায় হাত ধরে কতো কথায় গা ভাসাতাম! এমন করে যাচ্ছিলো ভালো দিন আমাদের। আর হয় না এভাবে, সংসার বাঁধা দরকার। তাকে বললাম সব। সে তার বাড়িতে রাজি করানোর জন্য চলে গেলো। পাঁচ দিন দশদিন যায় সে আর ফিরে আসে না।
আমার অপেক্ষার প্রহর আর শেষ হয় না। বেতন পেয়ে তার মা বোনের জন্য কাপড় কিনে দিলাম। অথচ বাড়িতে আমার বৃদ্ধ বাবা মা আমার অপেক্ষায় চোখের পানি ফেলছে। হয়তো তিনবেলা খাওয়াও জুটছে না তাদের।
হায়রে মনের বেখেয়ালী আবেগ! কেনো যে তুই মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকিস না?
শুধু ভেসেই যাস, ভেসেই যাস। তোর যেনো কোনো শক্ত ঘাট নেই।
দিন যায় সপ্তাহ যায় সে আর আসে না। ফোন বন্ধ। বাড়ির ঠিকানা জানি শুধু। পাশে আর এক গার্মেন্টস এ কাজ করে তার আপন মামা। কয়েকদিন খোঁজ নিয়ে একদিন দেখা পেলাম তার।
খোঁজ নিয়ে জানলাম সবুজের অসুখ করেছে। ও, বলা হয়নি। আমার সে ভালবাসার নাম সবুজ। আমার যেনো বুকটা হাহাকার করে উঠলো তাকে দেখার জন্য।
মামার হাত ধরে অনুরোধ করলাম। তার বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। নতুবা আমি একাই চলে যাব বললাম। মামা রাজি হলো নিতে।
রাতের বাসের টিকিট করা হলো। ঢাকা থেকে চিনাখড়ার বাস। পৌছাতে পৌছাতে নাকি রাত তিন চারটা বাজবে।
আমার মনের মাঝে তখন নানান ভাবনা। তার বাড়িতে যাব। মেনে নিবে তো সবাই? গায়ের রঙ আমার একটু চাপা হলেও দেখতে কেউ কখনো খারাপ বলেনি। অজানা ভয়ের মাঝেও তাকে দেখার আকুলতা নিয়ে আমি এগোতে লাগলাম বাসের গতির সাথে।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হইছে। বাসের ভিতর গুমোট ভাবটা সরাতে জানলাটা হালকা খুলে দিলাম।
আহ! বৃষ্টির মৃদু ঝাঁপটা আমার মুখে। এ যেনো এক পরম পরশ ভালবাসার।
কন্ট্রাক্টতীব্র জোরে যেনো চেঁচিয়ে উঠলো, চিনাখড়া নামেন।
আমরা নেমে পড়লাম। নেমে দেখলাম মামার এক বন্ধু, সবুজ আর সবুজের ফুফাতো ভাই আমাদের জন্য ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবুজকে দেখে আমার বুকটা ধড়ফড় করে উঠলো। যেনো হাজার স্পিডে সে দৌড়াচ্ছে। খুব ইচ্ছে হলো ওকে একটু ছুঁয়ে দেখি। কিন্তু ওকে দেখে মোটেও অসুস্থ মনে হলো না।
আমি আর ভ্যানচালক সহ পাঁচজন। আমাদের যেতে হবে সুজানগর।
চিনাখড়ার থেকে সুজানগর আঁকাবাঁকা রাস্তা। মোড় ফেরে বারে বারে। রাস্তার দুই ধারে ঘন পাটখেত।
মাঝে মাঝে বিস্তর এলাকাজুড়ে বাঁশের ঝাড়।
হঠাৎ ভ্যান থামিয়ে সবাই নেমে গেলো রাস্তার নীচে।
আমাকে বলল, এখন এ পথ ধরে হেঁটেই যেতে হবে। আমি শান্তভাবে পরম নির্ভরতায় তাদের পিছনে পিছনে হাঁটছি।
হঠাৎ,,, পিছন থেকে আমাকে জাপটে ধরলো মামা। আমি বুঝে গেলাম আমার জীবনের অবসান হতে যাচ্ছে।
একে একে চারজন আমার উপর অমানুষিক তাণ্ডব চালালো।
আমি চিৎকার করতে পারিনি। মুখের ভিতর আমার কাঁদামাটি গুজে দেয়া।
হাত মোচড় দিয়ে পিঠের দিকে বাঁকিয়ে রাখা। আমার শরীরে এতোটুকু মাংসপিণ্ডের এতো স্বাদ তাতো আমার জানাই ছিলো না! যে এমনভাবে খুবড়ে খাবে এ মানুষরুপি হায়নারা।
যাকে ভালবেসেছি প্রচন্ডভাবে সে সবার সাথে আমার শরীর নিয়ে মেতে উঠেছে উল্লাসে।
নিজেরা বলাবলি করছে, ‘সবুজের বউ মেয়েকে নিয়ে টেনশন খতম আজ। কতোবড় সাহস বাড়ি চলে আসে নষ্ট মেয়ে মানুষ! আমি নষ্ট মেয়ে মানুষ!!
আমার গায়ে কাপড় পরিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে ওরা। ব্যাগের ফোনটা নিয়ে গেলো শুধু দেখলাম।
সকাল হলো বৃষ্টি তখনও জোরালোভাবেই হচ্ছে।পুলিশ এলো। আমার লাশ আমার শরীর খুঁটিয়ে দেখছে। আমার যে আর কিছু করার নেই। বলার ভাষা নেই। নির্বাক চোখে শুধু বলছি যেনো, বিচার করো আমার হত্যার বিচার করো।
চাটাইতে শক্ত করে বেঁধে পুলিশ ভ্যানে আমার লাশটা উঠানো হলো।আমার লাশ এখন পোষ্টমর্টেম হবে। পুলিশ লাশকাটা ঘরে লাশ দিয়ে চলে গেলো।লাশকাটা ঘরে আমি পড়ে আছি। আমার আত্মা বসে আছে চুপচাপ।বড় হাতুড় সেনি দিয়ে আমাকে কাটা হবে কোনোরকম ব্যাথানাশক ইনজেকশন না দিয়েই।আমার শরীরে এতোটুকু কাপড় নেই এখন।ডোম, ডোমের সহকারির কথা আমাকে তীব্র কষ্ট দিচ্ছে। হাতুড়ির বাড়ির চেয়েও কষ্ট।খাতা কলমে আমার শরীরের প্রতিটা জখমের মাপকাঠি লেখা হচ্ছে।বুক চিরে আমার হৃদপিন্ড এখন ডোমের হাতে। মৃত্যুর সঠিক সময় নির্ধারণ কি হৃদপিন্ড বলে দেয়!কি রক্তলাল এ হৃদপিন্ড আমার। আস্ত একটা কৃষ্ণচূড়া যেনো। হৃদপিন্ডের এ রক্ত আমার বয়ে যাচ্ছে যে নালা বা ড্রেন দিয়ে তাতে মুখ দিচ্ছে বেওয়ারিশ কুকুর। অথচ তাকে না পাবার কষ্টে সে সব দিনগুলোতে আমার অবশ হয়ে যেতো। তীব্র কষ্টে যেনো আমি মরে যাচ্ছিলাম।
কাকও ড্রেন থেকে উঠিয়ে নিচ্ছে চর্বি কিছু মাংসের টুকরো যা বয়ে যাচ্ছে রক্তের সাথে। এ কাকগুলোর বসতি এখানেই। বড় দায় তাদের এ নর্দমা পরিষ্কার করার। যেনো বয়ে না চলে আরো বহুদূর অবধি।
ডোম- যেনো ভয়ঙ্কর কিছু। আসলেই তাই ভয়ঙ্করই কিছু। এতোটুকু যেনো দরদ নেই অনুভূতি নেই। গাল ভর্তি পান চিবোতে চিবোতে খোশ গল্পে মজে উঠেছে। আমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমার লাশের সঠিক সতকার না হওয়া পর্যন্ত, পরিচয় খুঁজে বের করার আগ পর্যন্ত আমি এখন ডোমঘর থেকে ফ্রিজে। আমি পড়ে আছি, ঠান্ডায় বড্ড ঠান্ডায়—–
#আমার_লেখা
,,রিতু জাহান,,রংপুর।
শুক্লপক্ষ।
১৩টি মন্তব্য
হালিমা আক্তার
মনটা খারাপ হয়ে গেল। এরকম হাজারো মেয়েদের স্বপ্ন দলিত হচ্ছে সবুজদের ছলনায়। এরা অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে। মেয়েরা বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পরে থাকবে। শুভ কামনা।
রিতু জাহান
জীবন কতো রকম রঙ যে খেলে যায়!!
আপনার জন্যও শুভকামনা রইলো আপু।
ছাইরাছ হেলাল
সমাজের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন, হরহামেশা যা হচ্ছে এখানে সেখানে।
নিয়মিত চর্চায় থেকে আরও লিখুন।
রিতু জাহান
ধন্যবাদ প্রিয় কবি।
মন অস্থির অস্বীকার করতে পারি না। তবে চেষ্টা করছি লেখায় পড়ায় শান্ত হতে।
ভালো থাকবেন
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
একটা বিয়োগান্তক সুন্দর গল্প লিখেছেন যেখানে আমাদের দেশের নারীদের একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখার অধিকার পর্যন্ত নেই। সবাই চায় দেহ প্রেম আছে নাটক সিনেমায়। নিজেদের নষ্টামি ভ্রষ্টামি ছাপিয়ে দিচ্ছে নিরীহ নারীর ওপর — “যাকে ভালবেসেছি প্রচন্ডভাবে সে সবার সাথে আমার শরীর নিয়ে মেতে উঠেছে উল্লাসে।
নিজেরা বলাবলি করছে, ‘সবুজের বউ মেয়েকে নিয়ে টেনশন খতম আজ। কতোবড় সাহস বাড়ি চলে আসে নষ্ট মেয়ে মানুষ!
আমি নষ্ট মেয়ে মানুষ”! —- তুমি নও আমরাই নষ্ট মানুষ আমরা যে তোমাদের মর্যাদা দিতে এখনো শিখিনি। সুন্দর গল্পের জন্য ধন্যবাদ।
রিতু জাহান
আপনাকেও ধন্যবাদ ভাই,, ভালো থাকুন সব সময়।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
প্রীতিময় শুভেচ্ছা আর শুভ কামনা অবিরাম।
আলমগীর সরকার লিটন
চমৎকার লেখেছেন আপু একদম বাস্তবমুখি অনেক শুভেচ্ছা রইল
রিতু জাহান
আপনার জন্যও শুভকামনা রইলো,, ভালো থাকুন সব সময়।
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা পড়ার জন্য
আরজু মুক্তা
চরম বাস্তবতা।
আরও লিখুন। শুভ কামনা
রিতু জাহান
ধন্যবাদ,,,
তৌহিদুল ইসলাম
ভালোবাসাযুক্ত প্রেম এখন নোংরামিতে পরিনত হয়েছে। আগেও ছিলো কিন্তু এখন যেন নোংরামি প্রকাশ করছেই সবাই নিজেকে বাহাদুর মনে করে।
সমাজে নারীদের নিজের ভালোবাসার মুল্যটুকুও আমরা দিতে পারিনা অনেকেই। সমাজের কালো অধ্যায় ফুটিয়ে তুলেছেন লেখায়। ভালো লাগলো আপু।
শুভকামনা জানবেন।
রিতু জাহান
হুম, ধন্যবাদ ভাই,,, ভালো থাকুন সব সময়।