ইদানিং প্রায়ই গেটের বাইরে এসে দাঁড়ায় বড় কোনো ভ্যান। আসবাব বোঝাই করে চলে যায় দূরের অচেনা স্থানে। প্রায়ই কেউ না কেউ বাড়ি বদলাচ্ছে। ঠিকানা পাল্টাচ্ছে। আজ দেখি প্রতিবেশি ফাং মালপত্র উঠানামায় তদারকি করছে। চলতি পথে থেমে জানতে চাইলাম, কই যাও ফাং? সে উত্তর দেয়, আয় রোজগারহীন এই সময়ে বাড়িটি ব্যয়বহুল হয়ে যায়। একটু দূরে কম ভাড়ার ছোট বাড়িতে উঠবো। রোদহীন দিন। অন্যদিনের মতো উঠোন জুড়ে ওলট-পালট রোদ্দুর নেই। কিন্তু মিস ফাং এর অবয়ব জুড়ে সোনালি রোদ্দুর খেলা করে। হয়ত বাড়ি বদলাবার স্বস্তি। বাতাসে স্নিগ্ধ সর্ষে ফুলের দোল খাওয়ার মতো করে দুলছে তাঁর রেশমের মতো ঝরঝরে চুল। ফাং পরিবার আমার কেউ নয়। তবুও গলার কাছে এসে আঁটকে থাকে একটা দমবন্ধ করা কষ্ট।
সপ্তাহ দুয়েক আগে উপরতলা থেকে চাংপুর ছেলে মেসেজ পাঠায়, তাঁদের এপার্টমেন্টটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরদিন গ্যারেজে, মেইন গেটে, রাস্তার মোড়ে ‘ For Sale”Open House’সাইনবোর্ড দেখতে পাই। যেহেতু আমরা দীর্ঘদিনের প্রতিবেশি, আমাদের সন্তানরা এখানেই জন্মেছে, বেড়ে উঠেছে,বিধায় অনায়াস আশ্বাসে একে অন্যের পাশে ছিলাম। একটি ভীষণ ভরসার জায়গা তো ছিলই। পরিবারটি চলে যাবে ভেবে কেনো যেন অযৌক্তিক অভিমান হয়। একদিন লনে চাংপুর পুত্রবধূর সঙ্গে দেখা। তাঁর ভাবলেশহীন মুখে সকালের মিঠে রোদ। জিজ্ঞেস করি, কই যাচ্ছ তোমরা ? পুবের হাওয়ায় কেঁপে উঠা পাতার মতো ওষ্ঠ কাঁপিয়ে বলল, শহরের কেন্দ্রস্থলে আর থাকতে চাইনা। ভিলেজের দিকে নিরিবিলি বড় পরিসরের বাড়িতে থাকতে চাই।
নির্জন দুপুর। রোজকার নিয়মে হাঁটতে বের হয়েছিলাম। হাঁটছি। ভাবছি, মানুষ কত সহজেই ঠিকানা বদলে ফেলে। চেনা মুখ ভুলে যায়। অচেনা পথে বাঁক নেয়। প্রবাস জীবনের শুরুর দিকে ছোট্ট এক রুমের বাড়িতে ছিলাম। সেটি ছেড়ে খোলামেলা উঠোনসমেত ডুপ্লেক্স এই বাড়িটিতে এসেছি ২২ বছর আগে। তখন বেশ অনেকগুলো রাত্রি ভালো ঘুম হতো না। রাতগুলো যেন আমায় ভোর দেখাবার গোঁ ধরে থাকতো। বিছানায় এপাশ ওপাশ করে ভোর অব্দি আমার সেই ছোট্ট রুমটির জন্যে হাঁসফাঁস লাগত। কতদিন পুরোনো ঠিকানায় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থেকেছি। মহাদেব সাহার কবিতার মতো…
তোমার একটু দেখা পাবো বলে
এককোটি বছর দাঁড়িয়ে আছি
এই চৌরাস্তায়।
পরিবর্তন মেনে নিতে পারি না সহজে। দেশ ছেড়েছি প্রায় ২৭ বছর আগে। এখানে স্বচ্ছ কাঁচের জানালার এপাশে বসে ওপাশের নাগরিক ব্যস্ততা দেখি। এখানে বাইরে সময় কাটাবার অবাধ স্বাধীনতা। তবুও আজও আমার দেশে রেখে আসা চার দেয়ালের সেই ঘরের জন্যে হাহাকার লাগে, যেখানে বিকেল শেষ হবার আগেই ঘরে ফেরার নিয়ম ছিল। যেখানে অপেক্ষায় থাকতো আমার মা, আমার বাবা। যেখানে ছিল আস্ত একটা স্বর্গ।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
৫টি মন্তব্য
তৌহিদ
আমরা সবসময় স্মৃতিকাতর। বস্তুগত মায়াকেও আঁকড়েধরে থাকতে ভালোবাসি।
ভালো থাকুন আপু। শুভকামনা জানবেন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
খুব সুন্দর লেখা কিন্তু ঠিকানা বদলের সাথে সাথে সম্পর্কের, পরিচিতদের দূরে সরে যাওয়াটা কষ্টের আপু। স্মৃতি বিজড়িত যেকোন কিছু আমরা আঁকড়ে ধরে রাখতে ভালোবাসি। একরাশ শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন
রোকসানা খন্দকার রুকু
বদল চিরন্তন। বাড়িঘর বদল হয় একসময় তাও বদলে যেতে হবে অন্যকোন ঘরে। শুভ কামনা আপু।
পপি তালুকদার
আপনার লেখাটি পরে থমকে গেলাম! মনে পরে গেল ছোটবেলার বাসা বদলের কথা যেখানে বাসা বদলের সাথে সাথে বদলে যেতো বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলো।তখন বুঝতে পারতামনা বদল টা চিরন্তন। শুভকামনা রইল।
আরজু মুক্তা
পরিবর্তন হয় ঠিকে কিন্তু মন পরে রয়। স্মৃতিকাতরতা