
দেখতে দেখতে ২০২০ সালের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। বিগত অন্য সকল বছরের ন্যায় ২০২০ সালকে একইভাবে বিশ্লেষণ করা যাবে না কোনভাবেই। এটি সারা বিশ্বকে তোলপাড় করা বছর। অসংখ্য পরিবারে প্রিয়জন হারানোর বছর। লক্ষ লক্ষ জীবনকে ভয়াবহ রূপে বদলে দিয়ে যাওয়া বছর। যে শিশুরা মা হারাল, তাঁরা আর তাঁদের গোটা জীবনেও জানবে না মায়ের আদর, স্নেহ, মমতা কী জিনিষ। যে শিশুরা বাবা হারাল,তাঁরা কোনদিনই জানবে না বাবা নামক বটবৃক্ষের শীতল ছায়ার অনুভূতি কেমন। তাঁরা বাকি জীবনের জন্যে বঞ্চিত হল মাথার উপরে নির্ভরতার হাত হতে। মানব জাতির ইতিহাসের অন্যতম এক বিপর্যয়কর বছর এটি।
অকোষীয় অণুজীব বিশ্বের মানবকূলকে অপূরণীয় এক ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। যে ফার্মেসী থেকে আমি নিয়মিত ওষুধ আনতে যাই, সেখানে কাজ করে মারিয়া নামের স্প্যানিশ মেয়েটি। দুইদিন আগে ওষুধ আনতে গেলে বেশ বিষণ্ণ কণ্ঠে জানালো মহামারীতে তার বড়ভাই হারানোর কথা। বেশ সপ্রতিভ, আমুদে আর সদা চঞ্চল ৩১ বছর বয়েসি বড়ভাইটি এপ্রিলের শুরুর দিকে অসুস্থবোধ করলেও কয়দিন বাড়িতেই সাবধানতা অবলম্বন করছিল। শারীরিকভাবে বেশি অসুস্থ বোধ করায় হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়েছিল। হাসপাতাল থেকে ফোন করে জানিয়েছিলেনও, ‘ কিচ্ছু হবে না। মনে হচ্ছে ডাক্তার চেকআপ করে ছেড়ে দিবে।’ কিন্তু তারপর আর কোনো যোগাযোগ হয়নি ভাইয়ের সাথে। পরে ফোনে জানতে পারে যে, তাঁর ভাইয়ের কোভিড-১৯ পজেটিভ রেজাল্ট আসার পর ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে। বারোদিন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে হেরে গিয়েছে। মারিয়া দীর্ঘশ্বাসের সাথে জানায়, আচমকা এমন দুঃসংবাদের জন্যে আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের সুখি সুন্দর পরিবারে ২০২০ সাল আকস্মিক ছন্দপতন ঘটিয়েছে। শীতের হিমেল হাওয়ায় বাড়ি ফিরছিলাম। বার বার মনে হচ্ছিল, মাইকেল মধুসুদন দত্তের কবিতার লাইন, ‘ জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে’। কিন্তু তাই বলে এমন মৃত্যু !
আমাদের প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরা ব্যস্ত, গতিশীল জীবনকে তছনছ করে দিয়ে গিয়েছে ২০২০ সাল’, বললেন আমার প্রতিবেশি মিস্টার চ্যাং। বছরের শুরুতে সে তার দেশ চায়নাতে পরিবারের সাথে সময় কাটাতে ভেকেশনে গিয়েছিলেন। সেখানে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ছুটি সংক্ষিপ্ত করে ফিরেও এসেছিলেন। মার্চে তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কন্যা ডরমেটরি থেকে ফিরে এলে তাঁর মাধ্যমে মিস্টার চ্যাং আক্রান্ত হন। তিনি বলেন, আমার উপসর্গহীন কন্যার মাধ্যমে আমি কোভিড-১৯ পজেটিভ হয়ে তিন মাস অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে ছিলাম। সে তাঁর হাতের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘এখনও সেইসব দিনের কথা মনে হলে আমার সর্বাঙ্গে এক হিমশীতল স্রোত বয়ে যায়। ভাইরাসটি বিশ্ববাসীকে শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগে ফেলে দিয়েছে, যার রেশ চলবে আগামী দিনগুলোতে।’
গতবছর ইমিগ্রেন্ট হয়ে আমেরিকায় এসেছিলেন পরিচিত এক আঙ্কেল। জ্যামাইকায় কন্যা-জামাতা, নাতি-নাত্নিদের সঙ্গে অসাধারণ সময় কাটছিল তাঁর। জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি জব করতেন। কর্মস্থল থেকে বাসে বাড়ি ফিরতেন রোজ। পরিবারের ধারণা বাসের ভিড় ভাট্টা থেকে তিনি ভাইরাস বহন করে এনেছিলেন। একে একে পরিবারের সকলেই আক্রান্ত হয়েছিল। অন্যরা অল্পতে সেরে উঠলেও তিনি সেরে উঠতে পারেননি। হাসপাতাল, রিহাব শেষে দীর্ঘ চারমাস পর বাড়ি ফিরেন যদিও, কিন্তু জীবন ফিরে পায়নি তার স্বাভাবিক গতি। প্রতিদিন ছুটে চলে কর্মব্যস্ত কঠোর পরিশ্রমী মানুষটির এখন সময় অতিবাহিত হয় হুইলচেয়ারে। বাড়িতে নার্স এসে থেরাপি দিয়ে যায় নিয়ম করে। এখনো কথা বলতে গেলে জিভে জড়িয়ে যায়। কথা হচ্ছিল তার কন্যার সঙ্গে। বললেন, ‘ ডাক্তার বলেছেন, ফুসফুস ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে অনেক সময় লাগবে। তবুও আমরা খুশি যে, বাবা অন্তত আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন।’
লং আইল্যান্ডের আরেক বন্ধুর সাথে কথা হয় ফোনে, যে কোভিড-১৯ থেকে সেরে উঠেছে ছয় মাস আগে। এখনো কথা বলতে গেলে হাঁপিয়ে উঠে, খুক খুক করে কাশি হয় বিরামহীন। খুব কষ্ট করে ধীরে নিচু স্বরে যা জানায়, তার সারমর্ম হল, এপ্রিলের মাঝামাঝিতে কর্মস্থল থেকে সে ভাইরাসটি বহন করে নিয়ে আসে। সামাজিক রীতির মধ্য দিয়েই যাচ্ছিল। অর্থাৎ বাড়িতে আইসোলেশনে ছিল। শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। একদিন পর ভেন্টিলেটর দেয়া হয়। এর কয়দিন পরই কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়। একমাসেরও অধিক সময় হাসপাতালে ছিল। জ্ঞান ফেরার পর পঁয়তাল্লিশ দিন রিহাব শেষে বাড়ি ফিরেছে। সবই সে জেনেছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে। সেই সময়ের অনেক কিছুই তাঁর স্মরণে নেই। শুধু প্রতি মুহূর্তে বয়ে বেড়ানো শারীরিক কষ্টটুকু অনুভব করছে। এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। শারীরিক দুর্বলতা প্রকটভাবে পেয়ে বসেছে। প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তা, হতাশা আর রাজ্যের বিষণ্ণতা ভর করে থাকে তাঁকে। ফোন রেখে দেয়ার আগে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে অন্যপ্রান্ত থেকে বলেন, ‘ রাত বাড়ার সাথে সাথে অন্ধকারের ছায়া ক্রমশ বিস্তৃত হতে হতে যেন কেউ আমায় অন্ধকারেই তলিয়ে নিয়ে যায়…।’
২০২০ সালে বিশ্ববাসী শুধু শারীরিক, মানসিক ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং অনিশ্চয়তার বছর। এ বছরে চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। আসক্ত হয়েছে ইন্টারনেট গেইমসে। এতে তাঁদের অলসতা বেড়েছে। বেড়েছে দৈহিক ওজন। আমার টুয়েল্ভ গ্রেড পড়ুয়া সন্তানের জন্যে বছরটি যারপরনাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভাল কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে সে কঠোর পরিশ্রম করছিল। গাইডেন্স কাউন্সিলর এবং শিক্ষকের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে আলোচনা এবং সিদ্ধান্তের বছর ছিল এটি। দিনরাত খাটাখাটুনি করে স্যাট পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। একে একে পরীক্ষাগুলো বাতিল হয়ে যাওয়ায় সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। নানান মানসিক টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে কেটে গিয়েছে শিক্ষার্থীদের মূল্যবান শিক্ষা বছরটি।
আতংকঘন পরিবেশে বছরটি পার হলেও বছরের শেষপ্রান্তে এসে ভ্যাকসিন বিশ্ববাসীকে আলোর মুখ দেখিয়েছে। নতুন বছর এইসব স্থবিরতা কাটিয়ে অনাবিল আনন্দ আর স্বস্তি ফিরিয়ে আনুক। আবেগঘন ভালবাসায় মানুষ মানুষের পাশে এসে দাঁড়াক। ২০২০ সালে যারা প্রিয়জন হারিয়েছে, তাঁদের কাঁধে হাত রেখে বলুক, ‘আমরা এখনো বেঁচে আছি তোমাদের পাশে দাঁড়াবার জন্যে।
কুইন্স, নিউইয়র্ক
১০টি মন্তব্য
তৌহিদ
করোনার জন্যে ২০২০ সাল প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু না কিছু ক্ষতি এবং হারানোর বেদনা নিয়ে সবাই পার করলাম। আগত সালটি সকলে মানবতার অনন্য নিদর্শন স্থাপন করুন এটাই প্রার্থনা।
আপনিও ভালো থাকুন সবসময়। শুভকামনা আপু।
রিমি রুম্মান
আমরা সকলে সকলের জন্যে দোয়া করবো। শুভকামনা রইল।
জিসান শা ইকরাম
কি যে অসহনীয় একটি বছর প্রায় শেষ হতে যাচ্ছে তা লিখে প্রকাশ করা যাবে না। মানুষের অসহায়ত্ব উপরের ঘটনাবলিতে ফুটে উঠেছে। মানুষ অসহায় হয়ে গিয়েছে করোনার কারণে।
আমার মেঝ ভগ্নী পতির করোনা হয়েছিল। ভেন্টিলেটর দিয়ে হাসপাতালে রাখা হয়েছিল প্রায় এক মাস। আমরা আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। আল্লাহর অসীম দয়ায় সে আবার আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে। তবে ফুসফুস আবার কবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে তা বলতে পারেনা কেউ। ঠিক ভাবে হাটতে পারেনা এখন।
আমার সন্তানেররা ইন্টারনেট গেমসে আসক্ত হয়ে গিয়েছে। কোন ভাবেই তাদের আর ফেরানো যাচ্ছে না।
সারাদিন বাসায় থাকে আর গেমসের মাঝে ডুবে থাকে।
প্রবাসে ভালো থেকো দিদি ভাই।
শুভ কামনা।
রিমি রুম্মান
আমার ছেলের শারীরিক ওজন বেড়ে গিয়েছে। নেট আসক্তি তো আছেই। ভাল থেকো দাদাভাই।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপু খুব খারাপ গেল বছর টা। জানিনা নতুন বছর কেমন যাবে । আশা করি সবাই ভাল থাকুক নতুন বছরে। অনলাইন বিষয়টি সাধারণ, মধ্যবিত্ত দের জন্য বিষফোঁড়া। সবকিছুর বাড়তি দাম, আয় কমেছে তার উপর এসব খরচ বাহুল্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা নিরন্তর
রিমি রুম্মান
সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক মন্দা, পারিবারিক সহিংসতা সবই বেড়েছে ২০২০ সালে। আমাদের অনেক কিছুর সাথেই অভ্যস্ত হতে হচ্ছে। অনেক ভাল থাকুন প্রিয়।
মোঃ খুরশীদ আলম
উপর থেকে টেনে তোলার যে প্রতীকি ছবিটি ব্যবহার হয়েছে সেটা একটা নিরব ম্যাসেজ আমদের জন্য। দুর্ভাগ্যবশত আমরা সব সময় নৈতিকতা বিবর্জিত জীবনযাপনকে আকড়ে ধরেছি। বাংলাদেশের জন্য 2020 ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ। মানষ্যত্ব এবং পশুত্বের প্রকাশের বছর। করোনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে শিখিয়ে গেছে (যাচ্ছে) অনেক কিছু। চোর, বাটপার আর স্বার্থন্বেষী মহলের অবয়ব আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছে করোনা। পাশাপাশি লাশের মিছিলেও নিজের ও পরিবারের মায়া ত্যাগ করে মানবতার জন্য কাজ করা একদল মানবতার সৈনিককেও আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছে।
খাদ্য সামগ্রী, ঔষধ, পিপি’র অপ্রতুলতা, চিকিৎসকদের অবহেলাকে পাশ কাটিয়ে ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নামক জনগণের টাকা তছনত করার আর অপব্যায় করার প্রতিযোগিতা দেখানো বছর।
2021 আসছে, ভাল কাটুক সেই পত্যাশা করি না। কেননা আমি-আমরা, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের প্রায় সকলেই ভন্ড। আমাদের জন্য শুভ কামনা করা নিজের সাথে প্রবঞ্চনা করার শামিল।
রিমি রুম্মান
শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা বিশ্বের জন্যেই ২০২০ সাল বড় চ্যালেঞ্জ। পশুত্বের কথা বলছেন, বিধায় নিউইয়র্কের একটি উদাহরণের কথা বলি। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসাকে বাঁচিয়ে রাখবার উদ্দেশ্যে সরকার করোনাকালে পিপিপি (পারসনাল পেরোল প্রোটেকশন ) লোণ দিয়েছে। একজন ভুয়া ডকুমেন্ট সাবমিট করে ব্যবসার উদ্দেশ্যে প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার লোণ নিয়েছে। সেই ডলার দিয়ে দামী মডেলের ২টি ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি কিনেছেন। তারপর প্রশাসনের টনক নড়ে। এবার যে তাকে শ্রীঘরে যেতে হয়!
আরজু মুক্তা
সামনের দিনগুলি ভালো কিছু নিয়ে আসুক
রিমি রুম্মান
অনেক ভাল থাকুন। অনাবিল আনন্দের হোক অনাগত বছর।