ছোটবেলা থেকেই গাছে ওঠার অভ্যাস আমার।কারনটা অবশ্যই অন্য।গাছে উঠে আম ,জাম ,লিচু ,পেয়ারা খাওয়ার মজা,আনন্দ একটু আলাদাই।
সেদিনও উঠছিলাম সুপারী গাছে।পেয়ারা গাছের একটা ডাল সুপারী গাছের সাথে লেগে আছে।বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও ওঠতে পারছিলাম না।একটু ওঠার পরেই পিছলে পড়ে যাচ্ছি॥বুকের কয়েক জায়গায় ছিলেও গেছে তবুও”একবার না পারিলে দেখ শতবার”।হঠাৎ আর পিছলে পড়ে যাচ্ছি না।আমার পায়ের নিচে কেউ হাত দিয়ে আমায় উঁচু করে তুলে ধরেছে।স্বল্পভাষী একজন চুপচাপ মানুষ।আমার বাবা।
সাল ২০০৭।আমার পড়াশুনা তখন শেষের দিকে। রংপুরে একটা স্কুলে চাকুরী করি।আমরা অনেক ভাইবোন এবং ভাইয়েরা বড় বড় হওয়ায় সংসার আলাদা হয়ে গেছে॥তাই আমাকে অনার্স সেকেন্ড ইয়ার থেকে চাকুরী করে নিজের পড়াশুনা করতে হত।আমি বাড়ি যেতে পারতাম কম এ কারনে খুব কম সময়ই বাবা মাকে কাছে পেয়েছিএবং সময় দিতে পেড়েছি।তাদের সুস্থতা অসুস্থতা কমই জানি। বা জানলেও হয়ে উঠতনা,কুলিয়ে উঠতে পারতামনা। চাকুরী,পড়াশুনা আবার বিসিএসের প্রস্তুতি।
ফোনে জানলাম আব্বা ভীষন অসুস্থ॥তাকে রংপুর নিয়ে আসছে।আব্বার জন্ডিস হয়েছে এবং সেটার পর্যায়ও অনেক খারাপ।পেট ফুলে গেছে।
হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে আমার উপর তাকে দেখা শোনা করার দায়িত্ব দিয়ে সবাই বিদায় নিল।দিনের বেলা রংপুরে আমাদের যারা আত্মীয় আছেন তাঁরা আব্বাকে দেখতে আসেন। কিছু সময় কাউকে রেখে আমি বাসায় গিয়ে গোসল করে আসি।
এভাবে বারো দিন চললো।অনেকদিনের গল্প জমেছিল বোধহয় আমাদের। সারাদিন বসে বসে আব্বা গল্প বলত আমি শুনতাম। আমার যখন জন্ম হয় সবাই ভীষন অখুশি ছিল। আব্বা বলেছে,”ভালোই হয়েছে শেষ বয়সে সুপারি বেটে খাওয়াবে”।
আম্মা খুব অসুস্থ ছিল আমার জন্মের আগে। বাড়ি নিয়ে যাবার সময় অনেকখানি কাঁচা রাস্তা ছিল।মা খুব দুর্বল ছিল তাই তাকে পিঠে নিয়ে পার করতে হয়েছে।
তুমি তো তোমার মায়ের চল্লিশ এর পরে জন্ম ।তোমার মা কম বয়সে খুব সুন্দরী ছিল। লম্বা পাতলা মেদহীন।আমি তো পেটলু কালো।
আমিও সুযোগ বুঝে বলে ফেললাম আব্বা আমি একজনকে পছন্দ করি।সে একটা গভর্মেন্ট কলেজের টিচার।আমার ভালো জব হলে আপনি সুস্থ হলে তার সাথে বিয়ে দেবেন।এক বিকেলে আমার ভালোবাসার মানুষটি দেখাও করে গেল। আব্বা তাকে ভীষন পছন্দ করলেন।
পরের দিন কোরবানি ঈদ। আব্বা একটু ভালোর দিকে।বাবা মেয়ে গল্প করছিলাম কাল হাসপাতাল যেহেতু বেশ ফাঁকা তাই তাকে নিয়ে ব্যালকনিতে বসে ঈদ দেখব।
সকালে ডাক্তার রাউন্ডে এল এবং আমায় বলল তারা বোর্ডমিটিং করে একটা সিদ্ধান্ত নেবেন।১১ টার দিকে আব্বাকে স্যালাইন লাগাল। ঘন্টা খানেক পর আব্বা ভীষন ছটফট করতে লাগলো। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।আমি নার্সকে বললে,তারা বলে ডাঃ এর অর্ডার খোলা যাবেনা।
বিকেল হতে হতে আরও অসুস্থ হল। সন্ধ্যার দিকে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো মা আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না ।আমি আর বাঁচব না।পুরো হাসপাতাল জুড়ে ডাঃ নেই সবাই ঈদ করতে গেছে। রাত সারে বাড়োটার দিকে আব্বা সুরা পড়তে পড়তে মারা গেলেন।
অভাবনীয় ক্ষতি আমার হয়ে গেল।ভাইবোনরা নিজের মত করে তাদের গুছিয়ে নিয়েছে আর আমার তো বাবামা ছাড়া কেউ নেই। আমি এটা আমার যথাযোগ্য প্রাপ্তি হিসেবে নিলাম।কারন দু মাস আগের রমজানে আব্বা আমার কাছে এসেছিল॥ তেমন কিছুই খেতে পারেনা।বমি করে। আমি তাকে ডাঃ দেখাতে চাইলাম।হিসেবী মানুষটা আমার টাকা খরচ করার ভয়ে না করে দিল।আমিও সময় হিসাবী মানুষ তাঁকে জোর করলাম না।সেদিন যদি আমার কাছে জোর করে রেখে প্রপার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতাম তাহলে আজ বাবা হারাতে হত না। সারাজীবন কাঁদব বলে সেদিন কাঁদতেও ভুলে গেলাম।
আজ তের বছর ধরে আমি ঈদ আনন্দ বুঝি না। ভালো লাগে না। অনুভূতি কাজ করেনা,মরে গেছে।কেউ হয়ত বুঝতে পারেনা বা আমি বুঝতে দেইনা।
কেউ একজন ছিল যে নিজের পাতের কলিজা আমায় দিয়ে বলত,”মেয়েদের তো শশুর বাড়িতে কলিজা খেতে দেয়না তাই বাপের হাতে খেতে হয়”।
আমি অপরাধী,পাপী সঠিক সময় তার পাশে থাকিনি, খেয়াল করিনি।নিজের কাছে রীতিমত ঢং মনে হয় কারন নিজের বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছি আর ভেবেছি বাবা তো আছেই।এইতো ভালো জব হয়ে গেলেই তাঁদেরকে পুরোপুরি সময় দেব। ভালো চিকিৎসা করাব। ভালো রাখব যেটা আমার ভাইয়েরা করেনি।
বাবা না থাকলে মেয়েদের পৃথিবীতে আপন বলে কেউ থাকেনা।বোঝার মানুষ থাকেনা। আমিও তার অভাবে আমার ভালোবাসার মানুষটাকে বিয়ে করতে পারিনি।সেই মানুষটির অভাব কোনদিন কেউ পুরন করতে পারবেনা। কোরবানি হয় রান্না হয় সবাইকে খাওয়াই হাসতে হলে হাসি আনন্দও করি কিন্তু সব একটু শান্ত হবার পর বাথরুমে ঢুকে মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদি।সে সময় যা করতে পারিনি বা করিনি আজ তার জন্য চিৎকার করে কাঁদা মানায় না।নিজের সাথে লড়াই করা ছাড়া আর কিছু নেই।
আজ তের বছর পর আবারও ঈদের দিন একজন অতি প্রিয় মানুষ হারিয়ে ফেললাম।আমার মেজ খালা।যাকে আমি মায়ের চেয়েও বেশি পছন্দ করতাম। জানিনা কেন বারবার আমার সাথেই এমন হয়।
তারপরও ঈদ আসবে আমিও আনন্দের ঢং করব কিংবা হয়ত একসময় ভুলেই যাব।সবাইকে নিয়ে ঈদ আনন্দ করব।
১৮টি মন্তব্য
ফয়জুল মহী
পৃথিবীর সব কিছু মনে হয় থামানো যায় । তবে মৃত্যু থামানো যায় না । ঈদের দিন এক মেয়ের বাবা হারানো হৃদয় ভাঙ্গা লেখা । আপু তুমি সংগ্রামী মানুষ তোমাকে স্যালুট । যেতে হবে বহু দুর কারণ পাশে যে অপেক্ষামান তোমার সেই রকম সন্তান ।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
কোনকিছুই থেমে থাকে না কিন্তু বাবা হারানো মেয়ে পথহারা পথিকের মত। ধন্যবাদ ভাইয়া।
রেজওয়ানা কবির
Apu kosto peo na,allah vorosha,jani e ovab opuronio tobu ki r korar evabei bakita potha katate hobe.allah uncle k jannat nosib koruk.amin
রোকসানা খন্দকার রুকু।
হ্যাঁ তাই। তুমিও ভালো থেকো। ধন্যবাদ দিপ্তী।
সুপায়ন বড়ুয়া
আপু এত সুন্দর করে জীবনের গল্পটা শুরু করলেন ? সত্যি তো বাবারা সন্তানদের নিজহাতে উপড়ে তুলে দেয়।
বাবা বোধ হয় লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন।
এই ঈদের দিন নার্স দিয়ে স্যালাইন লাগিয়ে ডাক্তাররা ঈদ করতে যায়।
এই ব্যাপারটা মানা বড় কষ্ট। যেটা আমার জীবনেও আছে।
যাক আপু এইটাই জীবন !
তবু বলি ঈদ মোবারক !
রোকসানা খন্দকার রুকু।
ডাঃ দেরও তো ঈদ আছে। হ্যাঁ লিভার সিরোসিস ॥দোষ আসলে সবটাই আমাদের মত সন্তানদের যারা বাবামাকে বোঝা মনে করি আর নিজের পেছনেই সমস্ত সময় ব্যয় করি। ধন্যবাদ দাদাভাই।
আলমগীর সরকার লিটন
সুন্দর লেখেছেন অনুগল্প পড়তে পড়তে আমরাও বাবার কথা মনে পড়ে গেলো
অনেক অনেক ঈদ মোবারক জানাই
নিশ্চিয় ভাল ও সুস্থ আছেন—–
রোকসানা খন্দকার রুকু।
ধন্যবাদ ভাইয়া। ভালো তো থাকতেই হবে। আপনিও ভালো থাকবেন।।।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বাবার কাছে মেয়েরা রাজকন্যা। বাবা বটগাছের ছায়া। প্রথমেই খেয়াল করলে সঠিক ট্রিটমেন্ট করাতে পারলে তাকে হয়তো বাঁচাতে পারতেন। যদি জীবন মৃত্যু বিধাতার হাতে। মন খারাপ করে থাকবেন না। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। ঈদের শুভেচ্ছা রইলো
রোকসানা খন্দকার রুকু।
আপনাকেও ঈদের শুভেচ্ছা আপুনি। ভালো থাকবেন।
সঞ্জয় মালাকার
দিদি গল্প পড়ে, অতীত গুলো মনে পড়েলো ,
বাবা সন্তানকে নিজহাতে ইপরে তুলে দেন,
বাবা হলেন বটবৃক্ষ, ছাঁয়া দিয়ে চলেন আজীন।
ধন্যবাদ আপু ভালো থাকবেন সবসময় শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
সবার জীবনেই কষ্ট থাকে তারপরও দাদাভাই আপনিও ভালো থাকবেন।ঈদ মোবারক।
খাদিজাতুল কুবরা
বাবার মতো করে মেয়েদেরকে কেউ ভালোবাসেনা।
কেউ বোঝেনা। চোখে পানি এসে গেল আপু গল্প পড়ে।
কয়েক বছর আগে আমিও বাবাকে হারিয়েছি। বাবাহীন জীবন ভালো লাগেনা।
তবুও জীবন চলে জীবনের নিয়মে।
আমরা আমাদের সন্তানদের ভালো রাখার নিরন্তর চেষ্টা করি, একদিন সে সন্তান আবার নিজের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
এটাই জীবন।
অনেক শুভেচ্ছা জানবেন আপু।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
আপু আপনার বাবা নেই জেনে কষট হল।বাবামা তো থাকে না॥ কিন্ত নিজেকে সময় দিতে গিয়ে যে অবহেলাটুকু তাদের দেই সেটা পরে কাটার মত বিঁধতে থাকে। ভালো থাকবেন।
তৌহিদ
আপ্লুত হলাম লেখাটি পড়ে। আপনার বাবা এবং খালার জন্য দোয়া রইলো আপু। প্রিয়জন আমাদের ছেড়ে চলে জীবনটাই বিস্বাদ লাগে। তবু অন্য সবার দিকে তাকিয়ে নিজেকে ভালো রাখতে হয়।
ভালো থাকুন সবসময়।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
হ্যাঁ ভালো থাকা ছাড়া আর উপায় নেই। আপনিও ভালো থাকবেন ভাইয়া।।ঈদ মোবারক।।।
আরজু মুক্তা
অণুগল্প না, জীবনের গল্প। খারাপ লাগলো
রোকসানা খন্দকার রুকু।
ধন্যবাদ আপু॥