
সোনালী আঁশের দেশ- বাংলাদেশ। দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল পাট থেকে এদেশ এবং কৃষক একসময়ে যে লাভের মুখ দেখতেন সেটি বর্তমানে আর নেই। অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত দেশের পাটশিল্প এখন ধ্বংসের মুখে। যে পাটকে একসময় সোনার মুল্যমানে তুলনা করা হতো বৈশ্বিক বাজারে এর চাহিদা পূরণ করতে না পারায় লোকসানে থাকা পাটকলগুলোতে এই পাটশিল্পের সাথে জড়িত সকল কৃষক ও শ্রমিক উভয়েই আর্থিকভাবে চরম সংকটে দিনানিপাত করছে।
বিজিএমসি এর অধীনে একসময় দেশে পাটকলের সংখ্যা ছিল ছিয়াত্তরটি। নানাবিধ টানাপোড়েনে সে সংখ্যা এখন পঁচিশে নেমে এসেছে। বছরের পর বছর লোকসান গুণতে থাক রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল গুলো এতদিন ধরে টালমাটাল অবস্থায় চলছিল। বছরের নানান সময়ে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ না করা, পাটের ন্যায্যমূল্য না দেয়া, অসময়ে বেশিমুল্যে পাটকেনায় বেশি লোকসান হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে বার বার মালিক শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
এ অবস্থায় ধারাবাহিকভাবে লোকসানে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত্ব পাটকলগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। সেই সাথে এসব কারখানার প্রায় পঁচিশ হাজার শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় স্থায়ীভাবে স্বেচ্ছা অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে জনমনে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এর বাইরেও এসব কারখানায় দৈনিক মজুরিভিত্তিক আরো প্রায় পঁচিশ হাজার শ্রমিকদের বেতন-ভাতাও প্রদান করা সম্ভব হচ্ছেনা।
গত দশ বছরে পাটকলগুলো প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। শ্রমিকদের বেতন ও অন্যান্য খরচ মেটাতে বছর বছর ভর্তূকিই ছিল একমাত্র ভরসা। এমনভাবে আর পাটকল চালাতে চায় না সরকার। যার কারণেই সকল শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় আনা হয়েছে। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো সংস্কারের জন্য চীনের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান CDEXIC এর কারিগরি সাহায্যও নেওয়া হয়েছিল। তারা সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পিপিপি’র ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলো পরিচালনা করার পরামর্শ দেয়।
তারই ধারাবাহিকতায় পাটশিল্পের সুদিন ফেরাতে বর্তমানে পাটকলগুলোকে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবলের মাধ্যমে সরকারি এবং বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে আবারো ছয় মাসের মধ্যে এসব কারখানা চালু করতে চায় সরকার। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে স্বেচ্ছা অবসরে পাঠানো সকল শ্রমিকদের পাওনা মজুরিও দিয়ে দেবে সরকার। ফলে প্রত্যেক শ্রমিক পাঁচ থেকে চুয়ান্ন লাখ টাকা করে পাবেন।
শ্রমিকরা যাতে সে অর্থ দ্রুতই পায় বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে সেটি বিবেচনায় নিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়েছে এবং জুলাইয়ের শেষ নাগাদ শ্রমিকদের পাওনা এই অর্থ পরিশোধ করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এমনকি যারা পূর্বে অবসরে গিয়ে এখন অর্থাভাবে দিন অতিবাহিত করছেন তারাও যাতে এর সুফল ভোগ করতে পারেন এবং কোন শ্রমিক যাতে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের বাইরে না থাকেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের ফলে সাময়িকভাবে অনেক শ্রমিক বেকার হচ্ছেন বলে মনে হলেও আদতে এতে শ্রমিকরাই লাভবান হবেন। কারণ দক্ষ জনবল এবং সু-ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই দেশে সোনালী আঁশের সুদিন ফিরে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পাটকলগুলো চালু হলে পাটশিল্পের লোকসান পুষিয়ে নেয়া সম্ভব বলে মনে করছেন কর্তাব্যক্তিরা। পাটকলগুলো পুনরায় চালু হলে পূর্বে কাজ করেছেন এমন দক্ষ শ্রমিকরা আবারো পাটকলগুলোতে কাজের অগ্রাধিকার পাবেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
করোনার এই দুঃসময়ে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের ফলে মজুরিভিত্তিক শ্রমিকরাও চরম আর্থিক সংকটে পড়বেন। এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিশেষ যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। শ্রমিক ছাঁটাই এবং পাটকল বন্ধের এই সিদ্বান্ত বর্তমান সময়ে কতটুকু যৌক্তিক সেটাও বিবেচ্য বিষয়। পাশাপাশি শ্রমিকদের এই দুঃসময়ে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাদের পাশে থাকবেন বলেই বিশ্বাস করি। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের প্রাপ্য অর্থ শ্রমিকরা যাতে সহজেই পান সেদিকে সুদৃষ্টি রাখতে হবে। দেশে সোনালী আঁশের সুসময় ফিরিয়ে আনতে এসব শ্রমিকদের প্রতি সদয় হওয়া অবশ্য কর্তব্য। শ্রমিক বাঁচলেই বাঁচবে দেশ।
১৯টি মন্তব্য
সুপায়ন বড়ুয়া
সহমত ভাইজান।
সময়টা করোনা কাল এখন বেছে নেয়ার কারন বোঝা যাচ্ছে না। এটা কি মধ্যসত্তভোগীদের আন্দোলনের ভয়ে
নাকি শ্রমিকদের হাতে টাকা পৌছানোর জন্য সময়ই বলবে।
শ্রমিকদের প্রতি সদয় হওয়া অবশ্য কর্তব্য। শ্রমিক বাঁচলেই বাঁচবে দেশ।
ভাল থাকবেন। শুভ কামনা।
তৌহিদ
শ্রমিকরা সবসময়েই অবহেলিত। এই টাকা তারা যেন সুষম আকারে পায় এটাই কাম্য।
ধন্যবাদ ভাই।
ইঞ্জা
বেশ তাৎপর্যপূর্ণ এক লেখা দিলেন ভাই, ‘৮০ পরবর্তীতে রেলওয়েতে এমন গোল্ডেন হ্যান্ডসেইক দেখার অভিজ্ঞতা আমি দেখেছি এবং শুনেছি, এই হ্যান্ডসেইকের আন্ডারে যারা এসেছিলো তারা পরবর্তীতে অনেকেই ভালো এবং ক্ষুদ্র ব্যাবসা করে এখন পর্যন্ত সফল হয়েছে।
আশা করি পাটখাতের এই উদ্যোগ শ্রমিকদের দিন ফেরাবে।
তৌহিদ
আমারও মনে হচ্ছে ন্যায্য টাকা পেলে প্রত্যেকের উপকারই হবে। সরকার আর একটি ভালো কাজ করেছে সেটি হলো অর্ধেক নগদ দেবে বাকি অর্ধেক সঞ্চয়পত্র হিসেবে দেবে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ দাদা।
প্রদীপ চক্রবর্তী
মরার উপর কামান দাগ!
শ্রমিক আগে বাঁচুক তারপর শিল্প। অতএব দুটির প্রাধাণ্য রয়েছে। তা না হলে অচিরে বাংলাদেশ তার সোনালী অর্জন পাটশিল্পকে হারিয়ে ফেলবে।
এ ব্যাপারের সরকারের সদয় হওয়া উচিত।
ভালো উপস্থাপন করলেন দাদা।
তৌহিদ
অবশ্যই শ্রমিকদের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তারা না হলে পাটকল চালাবে কে?
ভালো থেকো দাদা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এমন দূরাবস্থা। প্রতিটি সেক্টর করোনাকালে শোচনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। পাটশিল্প আমাদের দেশে ডুবতে বসেছে এখন এই সরকার অনেক ভর্তুকি দিয়ে নতুন করে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে আপ্রান চেষ্টা করছে। বেসরকারি খাতে গেলে আমার মনে হয় খুব ভালো হবে। আধুনিক যন্ত্রপাতি , দক্ষ জনবল, পাটের ব্যবহারকে নতুন রুপ দানই পারে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে।
তৌহিদ
আপাত দৃষ্টিতে লাভজনক হবে বলেই মনে হয়। দেখা যাক, শ্রমিকেরা যদি প্রাপ্য টাকা ঠিকভাবে পায় তবেই আসবে এর সুফল।
শুভকামনা জানবেন দিদিভাই।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
সোনালী আঁশ নিয়ে সময়োপযোগী এবং বস্তুনিষ্ট লেখা খুব ভালো লেগেছে। দুঃখ হয় এই অর্থকরীর ফসলের দুর্দশা দেখে। প্রত্যাশা দেশের পাটশিল্প আবার পুনরুজ্জীবিত হবে এটাই প্রত্যাশা। গোল্ডেনহ্যান্ডশেকের অর্থগুলো শ্রমিকরা নির্বিঘ্নে পায় সেটাই আমাদের কাম্য। ঠিকই বলেছেন — ” দেশে সোনালি আঁশের সুসময় ফিরিয়ে আনতে এসব শ্রমিকদের প্রতি সদয় হওয়া অবশ্য কর্তব্য। শ্রমিক বাঁচলেই বাঁচবে দেশ”।
ভালো থাকবেন। শুভ কামনা ।
তৌহিদ
সুসময় ফিরে আসুক এটাই কাম্য। শ্রমিকদের দিকে যত্নবান হতে হবে। সোনালি আঁশ আবারো বিশ্ব বাজারে তার সুনাম ফিরিয়ে আনবে এটাই কাম্য।
ধন্যবাদ দাদা। ভালো থাকুন।
ছাইরাছ হেলাল
সময় বলে দেবে এই পিপিপি ই কতটা কার্যকর শ্রমিক ও দেশের কল্যানে।
সমসাময়িক আলোচনার জন্য ধন্যবাদ।
তৌহিদ
পাটকলগুলো পুনরায় পিপিপি এর আওতায় চালু হলে তবেই আসলে বোঝা যাবে কতটা কার্যকর হচ্ছে এই পন্থা। শ্রমিকেরা প্রাপ্য মজুরি ঠিকঠাক পাক এটাই কামনা।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
জিসান শা ইকরাম
গোল্ডেন হ্যান্ডশেক কতটা সুফল বয়ে আনবে বুঝা যাচ্ছে না। অবশ্য পুরাতন যন্ত্রপাতি বাদ দিয়ে আধুনিক ও কার্যকরী যন্ত্রপাতি দিয়ে পাটকল গুলো আধুনিকায়ন করলে ভালোই হবে দেশের। সেক্ষেত্রে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে বিদায় নেয়া কর্মচারীরা আর ফিরতে পারবে না।
সমসাময়িক বিষয়ে ভালো লেখা।
শুভ কামনা।
তৌহিদ
জ্বী ভাই, সুফল কতটা বয়ে আনবে তা এখনই বলা যাচ্ছেনা। তবে আজ প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব বলেছেন- পাটকল পুনরায় চালু হলে পুরনো শ্রমিকরা অগ্রাধিকার পাবে।
এখন শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য টাকা ঠিকঠাক পেলেই হয়। পাটশিল্পের সুদিন ফিরে আসুক এটাই কাম্য।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাই।
খাদিজাতুল কুবরা
পাট-শিল্পের বিকাশ হোক আমরা সবাই চাই, সেই সাথে এ শিল্প বন্ধ হয়ে যেসব শ্রমিকরা বেকারত্বের শিকার হয়েছিলেন এবং বর্ণনাতীত দুর্ভোগ সয়েছেন তারা তাদের ন্যায্য পাক এটাই পত্যাশা।
বিষয়টি নিয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ।
তৌহিদ
সেটাই আপু, পাট এবং পাটশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত সকলেই যেন আলোর মুখ দেখে এটাই কাম্য। বিশ্ববাজারে এদেশের পাটজাতপণ্য তখনই লাভের মুখ দেখবে যখন শ্রমিকরা ভালো থাকবে। তাদের প্রতি যত্নবান হতে হবে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপু। ভালো থাকুন।
সাবিনা ইয়াসমিন
আপাত দৃষ্টিতে সবকিছু শুনে ভালো মনে হলেও গোল্ডেন হ্যান্ডশেক প্রজেক্ট কার্যত কতটা পরিনতির মুখ দেখবে সেটা সরকার এবং কতৃপক্ষের প্রতিশ্রুতি রক্ষার উপর নির্ভর করে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী কখনোই সঠিকভাবে আদায় হয়নি, অথচ ভর্তুকির হিসাবে পাহাড় গড়েছে। এই দুঃসময়েই সরকার এমন একটা পদক্ষেপ কেন নিতে গেলো সেটা আমার মতো আমজনতার মাথায় ঢুকছে না। যাইহোক, সোনালী আঁশের সুদিন ফিরে আসুক, গোল্ডেন হ্যান্ডশেক সফল হোক, শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা পেয়ে খুশি থাকুক, এটাই প্রত্যাশা করি।
সমসাময়ীক পোস্ট অত্যন্ত ভালো লাগলো তৌহিদ ভাই। প্রতিদিন পোস্ট দিলে আমরাও একটু শিখতে পারতাম।
ভালো থাকুন,
শুভ কামনা 🌹🌹
তৌহিদ
ভয়টাতো সেখানেই, শ্রমিকরা সবসময় নিগৃহীতই থেকে যায়। আসলে আমার মনে হচ্ছে সরকার নতুন করে সবকিছু ঢেলে সাজাতে চাচ্ছে। সে যাই হোক শ্রমিকরা উপকৃত হলে তবেই পাটশিল্প লাভের মুখ দেখবে।
প্রতিদিন কি আর আমার একার পক্ষে সমসাময়িক পোস্ট দেয়া সম্ভব কবিতা আপু? ঘরসংসার অফিস কি আছে না নাই বলুনতো! 😃😃
ভালো থাকুন আপু।☺
আরজু মুক্তা
আপনি কি ৃননে করবেন জানিনা। কিছু ভারতীয় দালালের কারণে এদের এই অবস্থা। যেখানে বাংলাদেশে পাট স্বর্ণ ছিলো। এখন পুরা বাজারটাই ভারতের দখলে