
সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি আর সামাজিক উঁচু-নীচুর বিচার আমার চারপাশে শেওলাপূর্ণ বদ্ধ জলাধারে কামার্ত ব্যাঙের মত কর্কশ স্বরে ডেকে ওঠে বারংবার। প্রেম-প্লাবনে বদ্ধ জলাশয়ে যে জোয়ার-ভাটা এসেছে কোন মাঝির সাধ্য নেই সে ঘাটে নৌকা ভেড়ায়। ডুবে যাবার সম্ভাবনা শতভাগ জেনেও ঘাটে পানি খেতে আসে সব প্রবঞ্চকের দল। আমার কি দোষ! নিজের পূর্বপুরুষরা আগেই যে স্খলিত হয়েছে নিষিদ্ধ গন্ধমের মোহে!
গুরুদেব বলেছিলেন নশ্বর পৃথিবীতে গ্লানি, কদর্যতা দেখে মানুষকে এত ছোট ভেবোনা; তাদের মহান বলেই জেনো। ক্রমে ক্রমে মেঘ সরে যাবে, নবযুগের প্রভাত আসবে; তোমরা যাত্রা করো। এ কথার অর্থ আমরা কেউই বুঝিনি সেদিন। কেউই বিশ্বাস করতে চায় না তাঁর কথা। বলে এসবই আত্মপ্রবঞ্চনা। আমি নিশ্চিত ছিলাম গুরুদেবই সঠিক পথ দিশারি অথচ গুরুদেবের বর্ণিত সে মানবতা আজ আর বেঁচে নেই।
রাজশক্তির দম্ভ, হিংসা যথেচ্ছচারিতায় আমাদের নৈতিক অধঃপতনের যে বীজ বপিত হয়েছে যুগে যুগে সে বৃক্ষের ফল গলাধঃকরণে সব পথিক আজ বিপর্যস্ত। মানবতা এখন স্বার্থপর কুহকের মত দিবানিশি আমাদের স্বপ্নে আসে। কেবল প্রভাতের প্রাণচাঞ্চল্যের মধ্যে এক অশরীরী সুক্ষ্ম স্বর যেন আমার কানে কানে বলে গিয়েছিল- চলো সবে সার্থকতার তীর্থে। অগন্য মানুষ নারী-পুরুষ, শিশু, রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, মূর্খ-পন্ডিত, ইমাম-পুরোহিত সকলের সম্মিলিত সীমাহীন শোভাযাত্রা সেই যে শুরু হল সেটাই ছিল মানুষের সত্যান্বেষণের প্রথম যুগ।
দুর্গম পথ অতিক্রম করতে করতে কত দিনরাত চলে গেল, হতাশায় ডুবে আত্মপ্রবঞ্চকেরা গুরুদেবকেও হত্যা করে বসলো একদিন। শোভাযাত্রীদের মধ্যে দেখা গেল তীব্র প্রতিক্রিয়া। সেদিন আমি আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের বলেছিলাম তোমরা যাকে হত্যা করেছ তার বীজ প্রোথিত রয়েছে আমাদের মাঝেই। আমরা যে মৃত্যুঞ্জয়! চলো এবার ইহলোক জয় করে ফিরি লোকান্তরে। কিন্তু কি আশ্চর্য! আদর্শের অভিধানের পথ খুঁজতে গিয়ে যেন আজ নিজেই আমি প্রবঞ্চিত।
শুনেছি মহাপুরুষেরা সকলেই শিশুরুপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। এই শিশুর জন্মেই এক নব যুগের সৃষ্টি হয়। মানবতার গৌরব প্রতিষ্ঠিত হয়, মানুষ ফিরে পায় নিজের সত্যদর্শন আর সনাতন আদর্শ। তাদের আগমনী বার্তার নতুন বানীতে মুখরিত হয় করুণা মৈত্রী; রচিত হয় প্রেম উপাখ্যান। অথচ শোভাযাত্রী প্রবঞ্চকেরা নিজেদের মাঝে পশুশক্তির বিকাশে অন্তরস্থিত লোভ, হিংসা, কামে ভেসে গুরুদেবরুপে জন্মান্তরিত সে শিশুটিকে তারা নিজেরাই বিনষ্ট করেছে।
সংসারের নানান আবিলতায়, বিভৎসতায় সে রুদ্ধদৃষ্টি তবুও মাঝে মধ্যে আলোকের ইঙ্গিত খোঁজে। জানি একদিন সব কদর্য কুয়াশা কেটে যাবে। গুরুদেবের কথায় বিশ্বাস করেছিলাম, আত্মপ্রবঞ্চকের কালিমা আমার দেহ থেকেও হয়তো একদিন মুছে যাবে। যুগ যুগান্তরের এই বিশ্বাস পূর্ণতা লাভ করেছে অসীমের যাত্রায়। আমার মাঝে বেঁচে থাকা শিশুটিকে আমিও যে অঙ্কুরেই গলাটিপে হত্যা করেছি নিজের হাতে।
২৮টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
এই গুরুদেব কে, সেটি কিন্তু লেখায় উঠে আসেনি।
সত্য সুন্দরের পথ চিরকালই কঠিন, তবুও আমাদের বাঁচার স্বপ্ন থাকে।
তৌহিদ
গুরুদেব মতান্তরে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। নিজের অন্তরস্থ অদৃশ্য শক্তি যার প্রেরণায় বেঁচে থাকি সবাই। আমরা মুখে বলি এক কিন্তু বিশ্বাস করি অন্যকিছু। একারনেই প্রবঞ্চক আমরা।
সত্য সুন্দরগুলোকে নিজেরাই যখন অঙ্কুরে বিনষ্ট করি মানুষ হিসেবে আমার আর কোন মুল্যায়ন হতে পারেনা বলেই মনে করি। নিজের মাঝে শুভ্র সুন্দর নিস্পাপ শিশুটিকে লালন করা উচিত যত্ন নিয়ে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া।
ফয়জুল মহী
একদিন সব অন্ধকার দুর হবে । সব গ্লানি সব কদর্যতা দুর হবে। মানুষ মানুষকে ভালোবাসা দিয়ে সতেজ সজীব , মননশীল ও সৃজনশীল পৃথিবী গড়বে।
তৌহিদ
ধন্যবাদ মহী ভাই।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ভাইয়া একদম ঠিক আত্ন-বিশ্লেষণ করেছেন। আমরা প্রত্যেকেই মুখোশধারী, প্রবঞ্চক। নিজেরাই নিজেদের সত্য-সুন্দরকে ধীরে ধীরে গলা টিপে হত্যা করি আর হয়ে উঠি পূর্ণবয়স্ক এক একজন প্রবঞ্চক। নিজে যা বিশ্বাস করি না তাই অন্যকে জোর করে বিশ্বাস করাই তাতে করে কিন্তু দু’জনেই ঠকছি। ভালোবাসা অবিরাম। অনিন্দ্য সুন্দর একটি লেখা পেলাম। শুভ কামনা রইলো
তৌহিদ
বাহ! চমৎকার! লেখার সারকথা ধরে ফেলেছেন দেখছি। আপনার মত গুনী পাঠক পেয়ে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে।
ধন্যবাদ আপু।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
ভাল লাগা, সুন্দর লেখা। শুভ কামনা রইল। ভাই
তৌহিদ
ধন্যবাদ ভাই।
প্রদীপ চক্রবর্তী
দারুণ বিশ্লেষণ করেছেন দাদা।
নিজের সৌন্দর্য নিজেকে তৈরি করতে হবে। তাহলে অন্যের সৌন্দর্য প্রয়াস পাবে।
এরজন্য আত্মা উপলব্ধি প্রয়োজন।
.
শুভকামনা দাদা।
তৌহিদ
ধন্যবাদ দাদা, শুভকামনা সবসময়।
আরজু মুক্তা
কোন ধর্মেই খারাপ বলেনা। আমরাই এক একটা শয়তান
তৌহিদ
হ্যা, নিজেদের মনকে কলুষমমুক্ত করতে হবে।
খাদিজাতুল কুবরা
আপনার একান্ত অনুভূতির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছি।
সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন।
আমরা নিজে স্বার্থপর, কিন্তু চাই যে ত্যাগটা অন্য কেউ করুক ।
গোলযোগটা এখানেই।
যদি ভুল বলে থাকি বলবেন।
শুভেচ্ছা রইলো।
তৌহিদ
ঠিক বলেছেন, ত্যাগ স্বীকারের পাশাপাশি নিজের অন্তরস্থ অদৃশ্য শক্তি যার প্রেরণায় বেঁচে থাকি সবাই সে বিশ্বাসকে অন্তরে লালন করতে হবে। আমরা মুখে বলি এক কিন্তু বিশ্বাস করি অন্যকিছু। একারনেই প্রবঞ্চক আমরা।
সত্য সুন্দরগুলোকে নিজেরাই যখন অঙ্কুরে বিনষ্ট করি মানুষ হিসেবে আমার আর কোন মুল্যায়ন হতে পারেনা বলেই মনে করি। নিজের মাঝে শুভ্র সুন্দর নিস্পাপ শিশুটিকে লালন করা উচিত যত্ন নিয়ে।
ভালো থাকুন আপু, মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
নিতাই বাবু
কবির কথা কবির লেখা, “কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক, কে বলে বহুদূর; মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক–মানুষ মানুষে সুরাসুর”।
নাম শুনেছি ‘শয়তান’! কিন্তু কেউ কি কখনো শয়তান চোখে দেখেছে? উত্তর আসবে না।
নাম শুনেছি ‘ফেরেস্তা’! কিন্তু ফেরেস্তা কি কেউ কখনো চোখে দেখেছে? উত্তর আসবে না।
তাহলে মানুষেই শয়তান, মানুষেই ফেরেস্তা। অর্থাৎ–আমিই ফেরেস্তা, আমিই শয়তান।
আপনার লেখা পড়ে নিজের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতকুর নিয়ে ভাবছি। ওঁরা যে নতুন পৃথিবী।
তৌহিদ
নিজের অন্তরস্থ অদৃশ্য শক্তি যার প্রেরণায় বেঁচে থাকি সবাই তাকে লালন করতে হবে। আমরা মুখে বলি এক কিন্তু বিশ্বাস করি অন্যকিছু। একারনেই প্রবঞ্চক আমরা।
সত্য সুন্দরগুলোকে নিজেরাই যখন অঙ্কুরে বিনষ্ট করি মানুষ হিসেবে আমার আর কোন মুল্যায়ন হতে পারেনা বলেই মনে করি। নিজের মাঝে শুভ্র সুন্দর নিস্পাপ শিশুটিকে লালন করা উচিত যত্ন নিয়ে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ দাদা।
ইঞ্জা
সুন্দর আত্ম বিশ্লেষণ, এইভাবে সবাই প্রকাশ করতে পারেনা ভাই, স্যালুট আপনাকে।
তৌহিদ
ধন্যবাদ ভাই। নিজেদের নিয়ে কিছুটা ভাবতে হবে। মানুষ হিসেবে এটি সবারই দায়িত্ব।
ভালো থাকুন সবসময়।
মোহাম্মদ আলী
দুর্গম পথ অতিক্রম করতে করতে কত দিনরাত চলে গেল, হতাশায় ডুবে আত্মপ্রবঞ্চকেরা গুরুদেবকেও হত্যা করে বসলো একদিন। শোভাযাত্রীদের মধ্যে দেখা গেল তীব্র প্রতিক্রিয়া। সেদিন আমি আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের বলেছিলাম তোমরা যাকে হত্যা করেছ তার বীজ প্রোথিত রয়েছে আমাদের মাঝেই। আমরা যে মৃত্যুঞ্জয়! চলো এবার ইহলোক জয় করে ফিরি লোকান্তরে। কিন্তু কি আশ্চর্য! আদর্শের অভিধানের পথ খুঁজতে গিয়ে যেন আজ নিজেই আমি প্রবঞ্চিত।
ভালোবাসা রইল
তৌহিদ
ধন্যবাদ, ভালো থাকুন।
হালিম নজরুল
চমৎকার সাহিত্যরসে পূর্ণ লেখা। একরাশ মুগ্ধতা।
তৌহিদ
পড়ার জন্য ধন্যবাদ ভাই।
সুপায়ন বড়ুয়া
এত ভাব গম্ভীর ভাবে আত্নপ্রবঞ্চনা লিখতে গিয়ে জটিল বিষয়ের অবতারনা করলেন।
“আমার মাঝে বেঁচে থাকা শিশুটিকে আমিও যে অঙ্কুরেই গলাটিপে হত্যা করেছি নিজের হাতে।”
সবার মাঝে সুন্দর মঙল ময় সব বাস করে হারিয়ে ফেলি
অনাদর অবহেলায়।
ভাল লাগলো। শুভ কামনা।
তৌহিদ
একদম ঠিক, লেখার মূলভাব আপনি ধরতে পেরেছেন দাদা। আপনারমতন গুনী পাঠক পেয়ে ধন্য মনে হচ্ছে।
সাধুবাদ জানাচ্ছি। শুভকামনা সবসময়।
জিসান শা ইকরাম
আমাদের বেঁচে থাকাটাই একটি দ্বন্দ। ভিতরের এবং বাইরের মানুষ যেন আলাদা আমরা। মন বলে সত্য পথে চলি, কিন্তু সেই মনকেই হত্যা করে অসত্যের দিকে ধাবিত হই।
এটিই আত্মপ্রবঞ্চনা।
ব্লগার তৌহিদ তার খোলস খুলে নিজকে প্রকাশ করছেন।
অত্যন্ত উচু মানের একটি লেখা এটি।
শুভ কামনা।
তৌহিদ
আপনার মত গুনি পাঠক খুব কমই পেয়েছি ভাই। লেখার অন্তঃস্থিত ভাব ধরতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়। আসলে প্রত্যেক মানুষই নিজেকে একটা খোলসে আবদ্ধ রাখতে ভালবাসে। এর কারন নিজের কলুষতা সে অন্য কাউকে দেখাতে চায়না। যারা এই খোলস ভেঙে ফেলেছে জীবনে মহান হয়েছে তারাই।
এটা সবারই করা উচিত। কতজনাই বা পারি! আমি কিঞ্চিত চেষ্টা করলাম। কেউ একজন অন্তত বলুক- আমার একটা ভালো গুন তাহলেও স্বার্থকতা।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাইজান। ভালো থাকুন সবসময়।
সাবিনা ইয়াসমিন
নিজের মাঝে অবস্থিত শুদ্ধতা, পবিত্রতা জলাঞ্জলি দেয়ার পর বাকি সব কিছুই কদর্যরূপে ধরা পড়ে। যার মাঝে আত্মশুদ্ধির মৃত্যু ঘটে সে আর কাউকেই নতুন জীবন দিতে পারে না। তাই সকল প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে, প্রবঞ্চনার পথ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় নিজেকে। তাহলেই বেঁচে থাকা যায়। বাঁচিয়ে রাখা যায় প্রজন্মের ধারা।
জানিনা কি বুঝলাম, রুপক লেখা গুলোর সঠিক মর্ম বোঝার মতো পাঠক এখনো হতে পারি নি।
ভালো থাকুন,
শুভ কামনা 🌹🌹
তৌহিদ
অন্য লেখার কথা জানিনা তবে এই লেখার মুলভাব সঠিক রুপেই ধরতে পেরেছেন আপু। পাঠক হিসেবে আপনি অনন্য। আমার সকল লেখায় আপনার বিশ্লেষণী মন্তব্য আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়।
আসলে নিজের খোলস থেকে বেড়িয়ে এসে নিজেকে জানতে হবে, নিজের স্বরুপ বুঝতে হবে। ভালোমন্দ মিলেয়েই মানুষ, কেউ ফেরেশতা নয়। আমাদের নিজের মাঝে একজন নিষ্পাপ শিশু বসবাস করে যার যত্ন নিতে হবে। না হলে শিশুটি দিনে দিনে কদর্যরুপে ধরা দেবে সকলের কাছে। আমার মৃত্যুর পরে কেউ একজন অন্তত বলুক আমি ভালো ছিলো। এটাই পরম প্রাপ্তি।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ, ভালো থাকুন আপু।