
পৌরাণিক ও প্রাচীন যুগ হতে একাল পর্যন্ত মানুষের অন্তরঙ্গ জীবনের বিশেষ কোনো রূপান্তর হয়নি। দেশকালের পরিবর্তনে নর-নারীর অন্তরতম সত্ত্বার কোন পরিবর্তন হয় না। মানুষের সুখ-দুঃখ, কাম-প্রেম, দ্বেষ-হিংসা প্রভৃতি সহজাত বৃত্তিগুলি চিরন্তন মানব-প্রকৃতির অঙ্গ। পূর্বের যুগে সেগুলি মূলত যেমন যেমন ছিল, বর্তমানেও তেমনি আছে এবং ভবিষ্যতেও লুপ্ত হবে না। একালের প্রেমিকারাও সেকালের প্রেমিকাদের মতো বর্ষাসমাগমে বিরহ বেদনা অনুভব করে এবং প্রিয় মিলনের জন্য ব্যাকুল হয়।
ভারতীয় কাব্যে আদি কবি বাল্মীকির রামায়ণে আমরা সর্বপ্রথম বর্ষায় নরনারীর বিরহবেদনার এই চিত্র দেখতে পাই। তাঁর মধ্যে বর্ষা প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য, বর্ষার ফুলফল, পশুপাখির বর্ণনা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাল্মীকি বর্ষার আকাশ বর্ণনা করছেন – আকাশ কখনো পরিষ্কার, কখনো মেঘলিপ্ত, কখনো শান্ত সমুদ্রের মতো। বর্ষার সঙ্গে বিরহের সম্বন্ধের কথা ভারতীয় সাহিত্যে বাল্মীকির রামায়নেই প্রথম পাওয়া যায়।
অন্যদিকে কালিদাস যে বিশেষভাবে বর্ষাকে বিরহদুঃখের উৎসারক বলে বর্ণনা করেছেন তার পিছনে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কার ও প্রথা বর্তমান। বর্ষায় যে বিরহ উদ্দীপিত হয় তার স্বরূপটি কালিদাসই প্রথম আমাদের নিকট সুস্পষ্টরূপে উদঘাটিত করেন। প্রাচীন ভারতে বর্ষা ছিল কর্মবিরতির ঋতু। তখন সম্ভবত প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ভ্রমণ, যুদ্ধ, বাণিজ্য প্রভৃতি সমস্তকিছু বন্ধ থাকতো। বর্ষারম্ভে প্রবাসী স্বামীরা ঘরে ফিরতো, তাদের পত্নীরাও প্রিয় মিলনের প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে থাকতো। যদি প্রত্যাগমন বিলম্বিত হতো তবে বিরহবেদনা উভয়পক্ষেই দূর্বহ হতো।
রবীন্দ্রনাথের বর্ষা-কাব্যের উপর কালিদাস ও বৈষ্ণব পদাবলীর এই প্রভাব যথেষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতির বিচিত্র রূপ, ষড়ঋতুর লীলাবৈচিত্র্য চিরকাল কবি হৃদয়কে নিবিড় রস মাধুর্যে আপ্লুত করেছে। বর্ষা ঋতুর ঐশ্বর্য ও মাধুর্য, তার অন্তর্নিহিত নিবিড় ভাব-সম্পদ, তার মর্মের চিরন্তন বিরহবাণী কবির কাব্যে বিস্ময়কর রুপ পেয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ বর্ষা কাব্যকে অপরূপ সৌন্দর্য ও লোকোত্তর ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত করেছেন। রবীন্দ্রকাব্যের একটি উৎকৃষ্ট অংশই তাঁর বর্ষা সম্বন্ধে গান ও কবিতা। বর্ষা-প্রকৃতির বাহিরের বিচিত্র রুপে রবীন্দ্রনাথ আত্মহারা হয়ে গিয়েছেন-
“হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো
নাচেরে হৃদয় নাচেরে।”
এই রুপ দর্শনের তাঁর হৃদয় অপূর্ব পুলকে নৃত্য করে উঠছে। কখনো তিনি বর্ষাকে উদাত্ত আহ্বান করেছেন-
“ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে
জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে
ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা
শ্যামগম্ভীর সরসা!”
কখনো আমাদের দেশের প্রাচীন কবিদের সঙ্গে মিশে তাঁদের মুখপাত্র হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে অভিনন্দন করছেন এভাবে –
“শতেক যুগের কবিদলে মিলি আকাশে
ধ্বনিয়া তুলিছে মত্তমদির বাতাসে
শতেক যুগের গীতিকা
শত শত গীত-মুখরিত বনবীথিকা।”
বর্ষার অবিরল জলধারাচ্ছন্ন নির্জন নিভৃত অবসর প্রেমের গূঢ় অনুভূতি প্রকাশের, প্রেম নিবেদনের চরম ক্ষণ মনে করে কবি অনুভব করেছেন-
“এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘনঘোর বরিষায়।”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বর্ষাকাব্যে প্রেমের লৌকিক স্তরের ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছেন। সেখানে পার্থিব ও অপার্থিব একসাথে মিলন হয়েছে। কালিদাসের সময় হতে বর্ষাঋতুতে যে বিরহ বেদনা জেগেছে লৌকিক প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে অনেকক্ষেত্রে সেই বিরহ বেদনা জেগেছে অন্তরের অন্তরতম প্রিয়ার জন্য। বর্ষায় কবির চিত্ত তাঁর হৃদয়বিহারীর জন্য অশান্ত হয়ে উঠেছে-
“গগনতল গিয়েছে মেঘে ভরি,
বাদল জল পড়িছে ঝরি ঝরি।
এ ঘোর রাতে কিসের লাগি
পরাণ মম সহসা জাগি
এমন কেন করিছে মরি মরি।
বাদল জল পড়িছে ঝরি ঝরি।”
রবীন্দ্রনাথকে নিঃসন্দেহে বর্ষার পরিপূর্ণ একজন কবি বলা যায়। কেবল বাংলা সাহিত্যে নয়, মনে হয় বিশ্ব সাহিত্যেও বর্ষার বাহির ও অন্তরের সমস্ত সৌন্দর্য-মাধুর্য রুপ রহস্য এমনভাবে গানে ও কবিতায় প্রকাশ করে আর কেউই সাহিত্য সৃষ্টিরুপে পরিবেশন করেননি।
(সাহায্যকারী কাব্যগ্রন্থ – মানসী)
২১টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
ঠিক আছে, বুঝছি তো, ম্যালা খাটুনি দিছেন আমাদের জন্য
তা বর্ষা আপনাকে কী কী দিল, তার তো কোন নমুনা দেখাইলেন না!!
দ্রুত ব্যবস্থা নিন।
তৌহিদ
আপনার মত গুনি পাঠকের মন্তব্যে লেখাটি পূর্ণতা পেলো তবে। এতটুকু কষ্ট সার্থক হলো ভাইয়া।
বর্ষা দুইটা কদম ছাড়া আর কিছু দেয় নাই।ভালো থাকুন সবসময়।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বাহ্ চমৎকার ভাইয়া। বর্ষা আর রবীন্দ্রনাথ একই সূতোয় গাঁথা, একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত। বর্ষা নিয়ে এমন সুন্দর উপস্থাপনার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। ভালো থাকবেন সবসময় শুভ কামনা রইলো
তৌহিদ
সুন্দর মন্তব্যে প্রীত হলাম দিদিভাই। রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে নিয়ে এত ব্যঞ্জনা করেছেন যা আর কেউ করেননি।
আপনিও ভালো থাকুন সবসময়।
প্রদীপ চক্রবর্তী
রবীন্দ্রনাথকে নিঃসন্দেহে বর্ষার পরিপূর্ণ একজন কবি বলা যায়। কেবল বাংলা সাহিত্যে নয়, মনে হয় বিশ্ব সাহিত্যেও বর্ষার বাহির ও অন্তরের সমস্ত সৌন্দর্য-মাধুর্য রুপ রহস্য এমনভাবে গানে ও কবিতায় প্রকাশ করে আর কেউই সাহিত্য সৃষ্টিরুপে পরিবেশন করেননি।
হ্যাঁ দাদা রবীন্দ্রনাথ সর্বদা সমস্ত সৌন্দর্য ও রূপরহস্য নিয়ে তাঁর গান ও কবিতায় তা প্রকাশ করেছেন।
যথার্থ উপস্থাপন দাদা।
ভালো লাগলো।
তৌহিদ
হ্যা দাদা, ঠিক তাই। ভালো থাকুন সবসময়।
ফয়জুল মহী
চমৎকার উপস্থাপন
অতুলনীয় লেখা শুভ কামনা রইলো
তৌহিদ
আপনার জন্যেও শুভকামনা রইলো ভাইয়া।
মাহবুবুল আলম
তৌহিদ ভাই অনেক অনেক ভাল লেগেছে বর্ষা নিয়ে
আপনার এ লেখাটা। এতে বর্ষার বিভিন্ন কবিদের কবিতার উদ্ধৃতি লেখার আঙ্গিককে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তোলেছে।
শুভেচ্ছা জানবেন! ভাল থাকবেন।
তৌহিদ
ধন্যবাদ ভাইয়া। আসলে আমরা সাহিত্য বিমুখ হয়ে পড়ছি দিনে দিনে। আমি চেষ্টা করছি সোনেলায় সাহিত্য নিয়ে লিখতে।
ভালো থাকুন ভাইয়া।
ইঞ্জা
রবীন্দ্রনাথকে নিঃসন্দেহে বর্ষার পরিপূর্ণ একজন কবি বলা যায়। কেবল বাংলা সাহিত্যে নয়, মনে হয় বিশ্ব সাহিত্যেও বর্ষার বাহির ও অন্তরের সমস্ত সৌন্দর্য-মাধুর্য রুপ রহস্য এমনভাবে গানে ও কবিতায় প্রকাশ করে আর কেউই সাহিত্য সৃষ্টিরুপে পরিবেশন করেননি।
সম্পূর্ণ একমত ভাই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে বর্ষা বন্দনা করেছেন তার বিভিন্ন গল্প, কাব্য ও গানে, সেইভাবে আমি তো আর কাউকে তেমন দেখিনা।
এমন একটি লেখা দেওয়ার জন্য আপনাকে স্যালুট ভাই।
তৌহিদ
সোনেলায় ইদানিং সাহিত্য বিভাগে লেখা আসছেনা। তাহলে কি আমরা সাহিত্যবিমুখ হয়ে পড়ছি? তাই নিজেই সাহস করে উদ্যোগ নিলাম। সুদিন ফিরবেই।
অনেকদিনপরে আমার লেখায় আপনার মন্তব্যে প্রীত হলাম দাদা। শুভকামনা সবসময়।
ইঞ্জা
কি বলেন, গতকাল, গত পরশুর লেখাতেও কমেন্ট করেছি আপনার লেখাতে, এর আগেও যা চোখে এসেছে তাতেই কমেন্ট করেছি।
উদ্যোগটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক, ভালো লাগলো ভাই।
নাজমুল হুদা
বর্ষার আবহাওয়া সত্যিই মুগ্ধকর। বর্ষাকে ঘিরে সজীবতার ঘ্রাণ পাওয়া যায়। অসাধারণ ভালো লেগেছে।
তৌহিদ
আপনার মন্তব্য পড়ে প্রীত হলাম প্রিয়। অনেকদিন পরে আমার লেখায় আপনি মন্তব্য করে আমাকে সম্মানিত করলেন। শুভেচ্ছা সবসময়।
নাজমুল হুদা
এভাবে বললেও লজ্জা তো লাগে তাই না!
গুণী মানুষদের সংস্পর্শে গিয়ে সম্মান করতে হয় না, মনে মনে দূর থেকে অনেক সম্মান করি।
হালিম নজরুল
বর্ষাকে নিয়ে আগে যতটা সাহিত্যকর্ম হতো, এখনো বোধ হয় সেখানে যথেষ্ট ভাটা পড়েছে।
তৌহিদ
আসলেও তাই। এর কারন আমরা সবাই লিখি কিন্তু পড়াশুনা করে কতজনে?
ভালো থাকুন ভাইয়া।
আরজু মুক্তা
বর্ষা আর রবীন্দ্রনাথ একে অন্যের পরিপুরক।
দালান জাহান
বর্ষা রবীন্দ্রনাথের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত আর রবীন্দ্রনাথ প্রবাহিত বর্ষায়। সুন্দর বিষয়ে লিখেছেন। ধন্যবাদ
তৌহিদ
পড়ার জন্য ধন্যবাদ ভাই। ভালো থাকুন।