
নিউইয়র্কে লক ডাউনের অষ্টম সপ্তাহ চলছে। গৃহের অভ্যন্তরে অস্থির মন আমাদের। প্রতিক্ষণ বাইরের পরিস্থিতি জানার জন্যে উদগ্রীব থাকি। মানুষজন কি বাইরে বেরুচ্ছে ? দোকানপাট খুলেছে ? খুললে খুব কি ভিড় সেখানে ? ভালোবাসার শহরটা কেমন আছে ? এমন নানান প্রশ্ন ভর করে থাকে প্রতিনিয়ত। বন্ধুদের কেউ বাইরে যাচ্ছে জানলে অপেক্ষায় থাকি ফিরে এসে সে কি আপডেট দিবে। গ্রুপ ভিডিও কলে সবাই মিলে অস্থিরতার সাথে জানতে চাই, বাইরে লোকজন কেমন ছিল ? কম না বেশি ? গাড়ি বেশি ছিল ? আমাদের তীব্র কৌতূহল মেটাতে বাইরে যাওয়া বন্ধুরা আবার শহরটা আংশিক ভিডিও করে নিয়ে আসে। আমরা মনোযোগ দিয়ে দেখি। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি।
এ সপ্তাহে হুট করে একদিন উষ্ণ আবহাওয়া আর ঝলমলে রোদ বিরাজ করছিল। প্রায় দুইমাস যাবত বাড়িতে সচেতনতার সাথে সময় পার করে হাঁপিয়ে উঠা আমার এক বন্ধু সপরিবারে গিয়েছিল বাড়ির পাশেই ‘ করোনা পার্ক’ এ একটু বুক ভরে খোলা বাতাসে শ্বাস নিবে বলে। গিয়ে দেখে বিশাল এই পার্কটির পার্কিং লট কানায় কানায় পরিপূর্ণ। তিল পরিমান জায়গা ছিল না। শেষে অনেকটা সময় অপেক্ষার পর একটি গাড়ি বেরিয়ে এলে তাদের গাড়িটিকে লটে যাবার অনুমতি দেয়া হয়। ভেতরে গিয়ে বিস্ময়ে হতবাক সে। চারিদিক লোকে লোকারণ্য। শিশুরা খেলছে, তরুণরা বল নিয়ে ছুটোছুটি করছে, বড়রা এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্পে মশগুল। যেন কিছুই হয়নি পৃথিবীতে। সবকিছু আগের মতোই ঠিকঠাক চলছে! তবে প্রায় অধিকাংশ মানুষই মুখ ঢেকেছে সচেতনতা স্বরূপ। সকলেই হয়তো ঘরবন্দি থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছে।
ক’দিন আগে আমরা নিজেরাই হাঁপিয়ে উঠে মধ্যরাতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সেদিন ছিল ‘ ফ্রাইডে নাইট’। এই শহর রাতভর মানুষের কোলাহলে মুখর থাকার রাত। সড়কে শতশত গাড়ির ছুটে চলার রাত। উচ্চ শব্দে মিউজিক বাজার রাত। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। করোনা ভাইরাসকে ঘিরে বাড়তি ভীতি মানুষের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের ওপর প্রভাব ফেলেছে। আমরা যখন বাসা থেকে বের হই, তখন ঘড়িতে রাত ২ঃ৪৫। ‘ করোনা এভিনিউ’ থেকে কুইন্স ব্লুবার্ড ধরে যাচ্ছিলাম। দীর্ঘ পথটুকুতে কোন জনমানুষের চিহ্নটি পর্যন্ত দেখা যায়নি। কুইন্স ব্রিজে আমাদের পাশাপাশি লেনে প্রথমবারের মত একটি এমটিএ এর বাস দেখতে পাই। ভাল করে তাকিয়ে দেখি যাত্রী মাত্র একজন। উল্টো দিকের লেনে আরো দুটি বাস ছুটে চলছিল। ম্যানহাঁটন থেকে কুইন্স অভিমুখে ফিরছিল একেবারেই যাত্রীবিহীন। সম্ভবত শহরের শেষ বাস। শেষ বাসটি চলে যাবার পর শহরের নিস্তব্দতা আরো গাঢ় হয়। ম্যানহাঁটন যেতে যেতে দেখছিলাম চারপাশটা। পেন স্টেশন, গ্র্যান্ডসেন্ট্রাল সহ বিভিন্ন বড় বড় হোটেল, অর্থাৎ যেসব স্থানে অগনিত ট্যাক্সি ক্যাব লাইন ধরে যাত্রীর অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকতো, সেইসব স্থানে খাঁখাঁ শূন্যতা। নির্জন রাতের নিস্তব্দতা যেন গিলে খায় পুরো শহরকে।
টাইমস স্কয়ারে একটি হলুদ ট্যাক্সি থেকে যাত্রী নামতে দেখে সমান্তরালে থামি আমরা। জানালার কাঁচ নামিয়ে জানতে চাই, সেদিন শহরে কী পরিমান যাত্রী ট্যাক্সিতে চলাচল করছে। প্রগাঢ় বিষণ্ণতায় দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আফগান এই ট্যাক্সি ড্রাইভার জানালেন, বিকেল ছয়টা থেকে রাত তিনটা অব্দি তিনি ছয়জন যাত্রী বহন করেছেন। সকলেই আশেপাশে যাতায়াত করেছে। দূরের পথের যাত্রী নেই। টাইমস স্কয়ারের মতো তুমুল ব্যস্ততম সড়কের মাঝে পথরোধ করে দুটো গাড়ি সমান্তরালে থেমে গল্প করছে, অথচ কেউ হর্ন দিয়ে বিরক্তির সাথে বলে না, ‘ পথ ছাড়ো, তাড়া আছে’! কোথাও কেউ নেই। নেই কারো কোথাও যাবার তাড়া। রাস্তার একপাশে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ি আমরা। লক ডাউনের পর দ্বিতীয়বারের মতো টাইমস স্কয়ারে আসা আমাদের। কণকণে শীতল বাতাসে জবুথবু হয়ে উদ্দেশ্যহীন ঘুরাফেরা করছে কিছু হোমলেস। কেউ বুকের উপর দুইহাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে ঠায়। তাদের একজনকে অর্থসাহায্যের আশায় এগিয়ে আসতে দেখে থমকে দাঁড়াই। বিষাক্ত ভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে পাশ কেটে চলে যাই অন্যপাশে।
কোভিড-১৯ ভাইরাস আমাদের মানবিক মনকেও অমানবিক করে দিয়েছে যেন। আলো ঝলমলে টাইমস স্কয়ারে আলোর কমতি হয়নি এক তিলও। আগের মতোই টিভি স্ক্রিনে বিরামহীনভাবে জ্বলজ্বল করছে বিজ্ঞাপন। একপাশে নির্জন সড়কের দিকে কোন এক টিভি চ্যানেলের ফোটোসাংবাদিক তাক করে আছে তার বিশালাকার ক্যামেরাটি। সামনেই ভাষ্যকার বর্ণনা করে চলছেন পর্যটকহীন সুনসান নীরব টাইমস স্কয়ারের বর্তমান পরিস্থিতি। কণকণে শীতে তার নিঃশ্বাসে একদলা ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে বাতাসে মিশে শূন্যে মিলিয়ে যায়। আমরা গাড়িতে গিয়ে বসি। অন্য সময় হলে ট্রাফিক পুলিশ এসে জরিমানা করে বসতো। টিকেটের কমলা খাম ধরিয়ে দিয়ে যেতো নিশ্চিত, ব্যস্ততম রাস্তায় গাড়ি পার্ক করার অপরাধে। কিন্তু এবার তেমন কিছুই ঘটলো না।
নিউইয়র্ক আবার কবে আগের মতো সচল হবে সেই প্রতীক্ষায় শহরের মানুষজন। যদিও মেয়র বিল ডি ব্ল্যাসিও মনে করেন সেপ্টেম্বরের আগে এই শহরের জনজীবন পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে না। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্টেট ইতিমধ্যে সচল হতে শুরু করেছে , কিন্তু নিউইয়র্ক আসছে জুনেই আংশিক খুলে দেয়া হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেননা আমরা নিউইয়র্কের বাসিন্দারা সাত সপ্তাহ কঠোরভাবে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মেনে চলার পরও অনেকে আক্রান্ত হচ্ছি। তাই এই সাবধানতা।
শীতপ্রধান এই দেশে বাইরে চমৎকার আবহাওয়া দেখলে আমাদের মন আনন্দে নেচে উঠে। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে চমৎকার আবহাওয়া আমাদের মনকে আরো বিষণ্ণ করে তোলে। কেননা এখন ধীরে ধীরে শীত কাটিয়ে উঠছে এই শহর। এমন নাতিশীতোষ্ণ দিনে, সবুজ পাতা আর ফুলের দিনে নিজেকে ঘরে বেঁধে রাখা সত্যিই বড় কঠিন। নিজের সাথে নিজের এ এক নির্মম যুদ্ধ! বিকেল কিংবা সন্ধ্যায় নয়, দিন দুপুরের জনমানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলবো বলে প্রয়োজনীয় কাঁচা বাজার সারতে মধ্যরাতে বের হওয়া আমাদের। সেইসাথে শহরও ঘুরে দেখা। এমন মুক্ত বাতাসে ঘুরে আসাটা আগামী বেশ কিছুদিন আমাদের মনকে ঘরেই প্রফুল্ল রাখবে।
এদিকে আমাদের বন্ধু রহমান ভাই অনেকটাই সেরে উঠেছেন। কোভিড-১৯ পজেটিভ হওয়া সত্ত্বেও শক্ত মনোবলে থেকেছেন। হাল ছাড়েননি। ডাক্তারের নির্দেশ অনুযায়ী ওষুধ খেয়েছেন, বাড়িতে থেকেছেন। হাসপাতালে যাননি। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, মার্চের শুরুর দিকের সময়ে তিনি কাজে গিয়েছেন যদিও, কিন্তু গনপরিবহন ব্যবহার করেনি। ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাচল করেছেন। মার্চের মাঝামাঝিতে ওয়ালমার্টে গিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে। তুমুল ভিড়ভাট্টা ঠেলে সেদিন বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। ধারণা করছেন, সেখান থেকেই ভাইরাসটি বহন করে নিয়ে এসেছিলেন। প্রথমে গায়ে ব্যাথা, তারপর পর্যায়ক্রমে মাথা ব্যথা, জ্বর এবং কাশি জেঁকে বসে শরীরে। সে এক দুঃসহ সময়! নিজেকে ভালো রাখার জন্য সর্বোত্তম প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। অসহায়ত্ব, হতাশা কিংবা উদ্বিগ্নতা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছেন। এমন যুদ্ধজয়ের গল্প আমাদের মনে সাহস যোগায়। আর তাই আমরা অপেক্ষায় থাকি পৃথিবী থেকে অদ্ভুত আঁধার সময় কেটে গিয়ে পৃথিবী হয়ে উঠুক করোনাভাইরাসমুক্ত।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক।
* ছবিটি নির্জন টাইমস স্কয়ারের। সোনেলার জন্যে তুলেছি।
১২টি মন্তব্য
ফয়জুল মহী
অসাধারণ লেখা। অপরিসীম ভালো লাগলো।
রিমি রুম্মান
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আমরা সেই শুভক্ষণে র অপেক্ষায় আছি। এই মহামারী, ক্রান্তিকাল থেকে মুক্তি পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। প্রকৃতির বুকে ফিরে যেতে মন আনচান করছে। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন
রিমি রুম্মান
শুভকামনা আপনার জন্যে। অনেক ভালো থাকুন।
কামাল উদ্দিন
আপনার লেখনি বরাবরই মনোমুগ্ধকর। নিউইয়র্কে না গিয়েও যেন চোখের সামনে ফুটে উঠল। আচ্ছা আপু করোনা পার্ক, করোনা এভিনিউ নামগুলো কি সদ্য দেওয়া? নাকি আগেই ছিল, আগে এমন নাম কখনো শুনিনি তো।
রিমি রুম্মান
নামগুলো বহু বছর আগে থেকেই। আমি গত বিশ বছর যাবত যে এলাকায় থাকি, তার নাম ‘করোনা’। পার্কটি করোনা এলাকায় অবস্থিত। বাসার পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে যে রাস্তাটি বহুদূর পর্যন্ত চলে গেছে, তার নাম করোনা এভিনিউ।
কামাল উদ্দিন
তার মানে করোনাতেই আপনার বসবাস, জটিল তো
তৌহিদ
সবাই যেন চরম বিষণ্ণতায় ভুগছে। ঘরবন্দি জীবন আর কতই ভালো লাগে! করোনার এই দুঃসময় একদিন কেটে যাবে, মানুষের মুখে হাসি ফুটবে এটাই কাম্য। করোনা থেকে মুক্ত হচ্ছেন যারা তাদের অটুট মনোবলের তুলনা নেই। মনোবল দৃঢ় রাখাই আসল কাজ।
করোনা পার্ক! এই নাম কেন?
সোনেলার পাঠকদের জন্য টাইমস স্কয়ারের এমন বিরল এবং অপরুপ নির্জন এই ছবিটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপু। মুগ্ধ হলাম।
ভালো থাকুন সবসময়।
রিমি রুম্মান
আমি গত বিশ বছর যাবত যে এলাকায় থাকি, তার নাম ‘করোনা’। পাৰ্কটি করোনা এলাকায় অবস্থিত। বাসার পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে যে রাস্তাটি বহুদূর পর্যন্ত চলে গেছে, তার নাম করোনা এভিনিউ। নামগুলো কে কতোকাল আগে রেখেছে, জানা নেই। লেখার সাথে সাথে সোনেলার পাঠকরা যেন সেই স্হান ঘুরে আসতে পারে, তাই ছবি তুলে আনা!
আরজু মুক্তা
আবারও সবকিছু প্রাণ ফিরে আসুক।
সবাই ভালো থাকেন। নিরাপদে থাকেন।
হালিম নজরুল
এই ক্রান্তিকাল কেটে যাক, আমরা প্রকৃতির কাছে ফিরে যাই।
জিসান শা ইকরাম
কোভিড-১৯ ভাইরাস আমাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে ছন্দ পতন ঘটিয়েছে।
আর কি আমরা সবাই পূর্বের মত স্বাভাবিক হতে পারবো? কিছু অভ্যাস পালটে যাবেই আমাদের। প্রচুর ভিড়ভাট্টায় গেলে আমাদের অবচেতন মনেই সামাজিক দূরত্বের কথা জেগে উঠতে পারে।
ভালো লেগেছে দিদি ভাই লেখাটি।
শুভ কামনা।