যে কোনো কাজ করবো বলে একবার মনস্থির করলে কাজটি করতে সহজ হয়ে যায়। লকড ডাউনের শুরু থেকেই আমরা দীর্ঘদিনের জমে থাকা কাজগুলো করছিলাম একটু একটু করে। পড়ে থাকা রাজ্যের গুরুত্বহীন চিঠি এক নজর দেখে ফেলে দেয়া, পুরনো কাপড়, জুতা, বই সহ অব্যবহৃত সব ফেলে দেয়া, ধুয়ে, মুছে ঘরকে জীবাণুমুক্ত করা… ইত্যাদি। সবশেষে বাকি রইলো বেইজমেন্ট।
ঘুম ভেঙ্গে জানালায় চোখ যায়। বাইরে বেশ উজ্জ্বল আলো। গাছের পাতা নড়ছে না। স্থির বাতাস। ঈষৎ শীত অনুভূত হচ্ছে। উঠে ফ্রেশ হয়ে বেইজমেন্টে যাই। সেখানে বয়লার রুমে শীতের দিনে মাঝে মধ্যে যেতে হয় হিটিং পাইপে জমে থাকা গ্যাস নির্গমন করতে। স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। গভীর এক নির্জনতা। হাত চালাই। কাজ শেষ করে দ্রুত চলে যাওয়া ভালো। আলো-বাতাসহীন গভীর নির্জন স্থানে বেশিক্ষণ থাকলে দমবন্ধ লাগে। সুইচ অন করে বাতি জ্বালাই। চাবি দিয়ে স্টোররুমের দরজা খুলতেই চোখে পড়ে নতুন চকচকে হুইলচেয়ার। এটি ফেলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আগেই। রুমের বাইরে টেনে বের করে আনি। আচমকা কেউ যেন বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে উঠে, ‘ ভাবী, আমি মইরা গ্যালে আমার পোলাটারে দ্যাখবেন না ?’
দিনের উজ্জ্বল আলোর ন্যায় মনে পড়ে যায়, এইতো সেদিনের কথা। এখনো বছর গড়ায়নি। সেদিন ছিল হিমাংকের নিচে তাপমাত্রা। আমরা সন্ধ্যাকালীন পারিবারিক গল্পে মশগুল। আচমকা কলিংবেল বেজে উঠে। দরজা খুলে দেখি দেশ থেকে অতিথি এসে হাজির বিনা নোটিসে। এই অতিথি বরাবরই না জানিয়ে এমন হুটহাট চলে আসেন। তিনি একসময় আমার ভাড়াটিয়া ছিলেন। তারপর একদিন কথা প্রসঙ্গে জানা যায় উনি একরকম আত্মীয়ও। সেই আবদারেই জানান না দিয়ে আসেন হয়তো।আমেরিকার নাগরিক। যৌবনে টানা ২৫ বছর কাটিয়েছেন নিউইয়র্ক শহরে। স্ত্রী কিছুতেই এদেশে আসতে সম্মত নয়। তাই শারীরিক নানাবিধ জটিলতায় যখন আর কাজ করতে পারছিলেন না, তখন সংগ্রামী জীবনের ইতি টেনে তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশে ফিরে যান পরিবারের কাছে। সে-ও আজ থেকে প্রায় দেড় যুগ আগের কথা। এরই মাঝে বেশ কয়বার নিউইয়র্ক এসেছেন সোশ্যাল সিকিউরিটি অফিসের কাজ, ডাক্তার দেখানোসহ আরও নানাবিধ কারণে। প্রতিবার তিনি আমার স্বল্পকালীন অতিথি ছিলেন। সপ্তাহখানেক থেকে কাজ শেষে ফিরেও গেছেন। কিন্তু এবারের আসাটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুলে দেখি পিতা-পুত্র একটিমাত্র লাগেজ আর হুইলচেয়ার সমেত দাঁড়িয়ে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। কাঁপছেন, চোখ লাল, শ্বাস নিচ্ছেন টেনে টেনে। বুকের ভেতরে শো শো আওয়াজ। ২/৩ জন মিলে ধরে ভেতরে আনা হলো। আমরা হতভম্ব এই ভেবে যে, এমন শারীরিক অবস্থায় কেমন করে এত দীর্ঘ উড়াল-যান ভ্রমন করলেন ! আমাদের কপালের ভাঁজ গভীর হয়। আমরা খানিকটা বিব্রত হই। কিন্তু তিনি নির্বিকার। শ্বাস টেনে টেনে জানালেন, লিভার, হার্ট, কিডনি কিছুই নাকি কাজ করছে না। একাধিক সার্জারিও হয়েছে শরীরে। বাংলাদেশে হাসপাতালে আইসিইউতে ছিলেন। ডাক্তাররা সমস্ত আশা ছেড়ে দিয়েছেন। শেষবার বাঁচার চেষ্টা করতে তো দোষ নেই। হুইলচেয়ার কিনে হাসপাতাল থেকে সরাসরি এয়ারপোর্টে। নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে আসেন।
রাতেই হাসপাতালে নিতে চাইলাম। রাজি হলেন না। নানান দুশ্চিন্তা আর আশংকায় সে রাত আমাদের নির্ঘুম কাটে। কোথাও কাছে ধারে একটি রুম ভাড়া নিতে চাইলেন। কেননা ২০/২২ বছরের পুত্রসহ তিনি এবার দীর্ঘদিন নিউইয়র্কে থেকে চিকিৎসা নিবেন, এমনটি আশা করেছিলেন। ভাগ্যক্রমে জ্যাকসন হাইটসে একটি পরিবারের সাথে থাকার জন্যে রুম পাওয়া গেলো। সব ঠিক হবার পর তিনি হাসপাতালে যেতে রাজি হলেন। বয়সে আমি উনার অনেক ছোট, তবুও সবসময় ভাবী বলে ডাকতেন। বাইরে তখন অঝোর তুষারপাত। ছলছল চোখে বললেন, ‘ ভাবী, আমি মইরা গ্যালে আমার পোলাটারে দ্যাখবেন না ?’
উনাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হলো। চিকিৎসা চলল। অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হলে নার্সিং হোমে রাখা হয়। অবনতি হলে হাসপাতালে আইসিইউতে। কিছুদিন অচেতন এক অন্ধকারে ডুবে ছিলেন। যমে-মানুষে লড়াইয়ের আগে মাসখানেক চেতন আর অচেতনের লড়াই চলে। সেই কঠিন সময়ে থাকা মানুষদের কি বিস্তীর্ণ সমুদ্রে একাকি ভাসমান নৌকার মতো মনে হয় ? কে জানে ! ভাড়া বাসায় আর থাকা হলো না উনার। ছেলেটি একা থাকলো সেখানে। আমরাও ব্যস্ত হয়ে উঠলাম আমাদের রোজকার জীবনে।
একদিন ছেলেটি ফোন করলো, কীভাবে লাশ দেশে পাঠাবে সেইসব জানতে। ডাক্তার নাকি জানিয়ে দিয়েছেন, যে কোনো সময় লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলতে হতে পারে। মৃত্যুর আগেই কাউকে লাশ ভাবাটা ক্যামন অপরাধি লাগলো। বাস্তবতা বড় বেশি নির্মম। সহসাই তিনি খুব একাকি নীরবে পৃথিবী ছেড়ে গেলেন। শেষ সময়ে শিয়রে ছিল না কোনো মমতার, ভালোবাসার হাত। কিংবা দু’ফোঁটা তৃষ্ণার জল মুখে দেবার। এমন চলে যাওয়া বুকের ভেতরে এক রকম চাপ সৃষ্টি করে। মানুষবিহীন নিকষ অন্ধকার মাটির ঘরে মানুষ ক্যামন করে থাকে ? একাকি বিষণ্ণ লাগে না ? ভয় লাগে না ?
চকচকে নতুন হুইলচেয়ারটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে যেন। মাথার ভেতরে ক্যামন ফাঁকা ফাঁকা মনে হলো। নির্জন স্যাঁতসেঁতে বেইজমেন্টে গাঢ় অন্ধকার নেমে এলো। আমি কি মোহাচ্ছন্ন সেই অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি, যেখানে শুধুই অসীম শূন্যতা ? এখানে কি বাতাসে অক্সিজেন ফুরিয়ে এসেছে ? শীতল এক অনুভূতি বয়ে গেলো শিরা-উপশিরায়। অবশ হয়ে আসছিলো শরীর। এমন অনুভূতির কোনো ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। অথচ আমার সবসময়ই নিজেকে পর্বতচুড়া মনে হতো। মনে হতো সমুদ্রের বিশাল কোনো ঢেউ।
হুইলচেয়ারটি ফেলে দেবার সিদ্ধান্ত বড় বেশি ভারি মনে হলো। থাকুক। দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। শ্বাস নিতে হবে। দ্রুত উপরে উঠোনে এসে দাঁড়াই। যেখানে দীর্ঘ শীতের শেষে আড়মোড়া ভেঙে সদ্য সতেজ হয়ে উঠেছে প্রকৃতি।
পৃথিবীর সব বাবা-ই কি এমন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অতল সাগরের মতো গভীর চাহনিতে বলে উঠে, ‘ আমি মইরা গেলে আমার পোলাটারে দেখবেন না ?’
মা দিবসে জগতের সকল বাবার প্রতি অন্তহীন শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।
অত্যন্ত বেদনাময় একটি লেখা পড়লাম আপু। আসলে লাইফ সাপোর্টে থাকা ব্যক্তির সাপোর্ট খুলে নেয়া কিন্তু ডাক্তারদের জন্যও অনেক কষ্টকর একটি কাজ।
যার জন্য হুইল চেয়ার সে মানুষটিই নেই। কত সহানুভূতি আবেগ জন্মালে এমনটা হতে পারে তাই ভাবছি। আপনার স্বচ্ছ মনের প্রশংসা না করে পারছিনা।
মা দিবসে সকল মায়েদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জ্ঞাপন করছি। আর সন্তানের জন্য পিতার অক্লান্ত পরিশ্রম যেন সন্তানেরাও ভুলে না যায় সেটি মনে রাখতে হবে সন্তানদের।
শুধু হুইলচেয়ারই নয়, আমার ফ্রিজে তাঁর রেখে যাওয়া ইনসুলিনের ব্যাগও রয়ে গেছে। রোজ কতবার যে ফ্রিজ খুলতে হয় নিত্য প্রয়োজনে ! প্রতিবার মানুষটির কথা মনে পড়ে যায়। ফেলে দিলেই পারি। কিন্তু কেনো দিচ্ছি না, সে ব্যাখ্যাও আমার জানা নেই। এভাবেই বুঝি চলে যাওয়া মানুষেরা মায়া রেখে যায় বেঁচে থাকা মানুষদের জন্যে !
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এমন দিনে বাবার ভালোবাসা টা তুলে আনলেন। বাবার ভালোবাসা, দায়িত্ব কে সবাই বুঝতে পারেনা। মাটির ঘরে একা থাকার বিষয়টি সত্যিই ভয়ংকর, ভয়াবহ। তখন শরীর আপনা আপনি ই শীতল হয়ে যায়, বেঁচে থাকার বিষয়টি কেমন জানি রহস্যময় হয়ে ওঠে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা রইলো
১৮টি মন্তব্য
তৌহিদ
অত্যন্ত বেদনাময় একটি লেখা পড়লাম আপু। আসলে লাইফ সাপোর্টে থাকা ব্যক্তির সাপোর্ট খুলে নেয়া কিন্তু ডাক্তারদের জন্যও অনেক কষ্টকর একটি কাজ।
যার জন্য হুইল চেয়ার সে মানুষটিই নেই। কত সহানুভূতি আবেগ জন্মালে এমনটা হতে পারে তাই ভাবছি। আপনার স্বচ্ছ মনের প্রশংসা না করে পারছিনা।
মা দিবসে সকল মায়েদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জ্ঞাপন করছি। আর সন্তানের জন্য পিতার অক্লান্ত পরিশ্রম যেন সন্তানেরাও ভুলে না যায় সেটি মনে রাখতে হবে সন্তানদের।
শুভকামনা রইলো আপু।
রিমি রুম্মান
শুধু হুইলচেয়ারই নয়, আমার ফ্রিজে তাঁর রেখে যাওয়া ইনসুলিনের ব্যাগও রয়ে গেছে। রোজ কতবার যে ফ্রিজ খুলতে হয় নিত্য প্রয়োজনে ! প্রতিবার মানুষটির কথা মনে পড়ে যায়। ফেলে দিলেই পারি। কিন্তু কেনো দিচ্ছি না, সে ব্যাখ্যাও আমার জানা নেই। এভাবেই বুঝি চলে যাওয়া মানুষেরা মায়া রেখে যায় বেঁচে থাকা মানুষদের জন্যে !
তৌহিদ
ক্ষণিক সময়ে কত আবেগ কাজ করে মানুষের মনে।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এমন দিনে বাবার ভালোবাসা টা তুলে আনলেন। বাবার ভালোবাসা, দায়িত্ব কে সবাই বুঝতে পারেনা। মাটির ঘরে একা থাকার বিষয়টি সত্যিই ভয়ংকর, ভয়াবহ। তখন শরীর আপনা আপনি ই শীতল হয়ে যায়, বেঁচে থাকার বিষয়টি কেমন জানি রহস্যময় হয়ে ওঠে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা রইলো
রিমি রুম্মান
বাবাদের চিরকাল দূরের মানুষ মনে হয়। অথচ তাঁদের ভেতরটা বড় কোমল। সন্তানের জন্যে ভাবনাটা তাঁদের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি তাড়া করে ফিরে।
ফয়জুল মহী
শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা
রিমি রুম্মান
অনেক ভাল থাকুন। শুভকামনা জানবেন।
আরজু মুক্তা
দায়িত্ব টা সবাই বুঝেনা।
ভালো থাকবেন।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন, নিরাপদ থাকুন, প্রার্থনা।
শামীম চৌধুরী
এখন অযত্নে পড়ে থাকবে হুইল চেয়ারটি। তার মানুষটি যে নেই। ভালো লিখেছেন।
রিমি রুম্মান
তবুও কেন যেন খুব যত্নে মুছে রেখে এসেছি। অনেকটা বেঁচে থাকা মানুষটিকে যেমন সম্মান করেছি, তেমন। মায়া খুব খারাপ, তাই না ? ভাল থাকুন খুব।
কামাল উদ্দিন
হৃদয় ছোয়া লেখা, আপনি কি পরে ছেলেটার খোজ খবর রেখেছেন আপু?
রিমি রুম্মান
হ্যাঁ। ছেলেটি ভালো আছে।
কামাল উদ্দিন
জেনে ভালো লাগলো
জিসান শা ইকরাম
লেখাটি অন্তর ছুয়ে গেলো।
মানুষের প্রতি মায়া সহজে কাটানো যায় না। যেকারনে এই হুইল চেয়ার ফেলে দিতে পারবেনা তুমি।
ভালো থেকো দিদি ভাই।
শুভ কামনা।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছ দাদা ভাই। থাকুক না হয় !
হালিম নজরুল
আবেগাপ্লুত হলাম।
রিমি রুম্মান
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।