
প্রিয় শহর,
কেমন আছো তুমি? আজ তোমার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। খুব ইচ্ছে করছে তোমায় নিয়ে লিখতে। বলতে পারো তোমাকে ঘিরে থাকা স্মৃতি রোমন্থন করতে ইচ্ছে করছে। কতদিন হলো। কতদিন হলো দুচোখ ভরে তোমায় দেখিনি, হাঁটিনি তোমার অলিগলি পথে। তোমার ধূলোমাখা হাওয়ায় প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেইনি কতদিন। খুব মিস করছি তোমাকে। মিস করছি তোমার সাথে জড়িয়ে থাকা সবাইকে। সবচেয়ে বেশি মিস করছি সেই বয়স্ক রিক্সাচালক চাচাকে। যে ভাড়ার থেকে পাঁচটা টাকা বেশি পেয়ে দুহাত তুলে দোয়া দিয়েছিল আমাকে। আশেপাশে যতো রিক্সা চালক ছিলো সবাইকে ডেকে বলেছিল মা আমাকে টাকা বেশি দিয়েছে। পাঁচটাকা বেশি পেয়ে যে পরিমাণ খুশি হয়েছিল তা লিখে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। সেদিন আমার চোখের কোণা চিকচিক করে উঠেছিল অশ্রুবিন্দুতে। সেদিন প্রথম অনুভব করলাম কারো কারো কাছে পাঁচটাকাও অনেক বেশি। মাত্র তিরিশ টাকা ছিল আমার কাছে তাই নিয়ে বের হয়েছিলাম। পনেরো টাকা যাওয়ার ও পনের টাকা আসার ভাড়া ছিল। ঐ চাচাকে বিশ টাকা দিয়েছিলাম আর মনে মনে ভেবেছিলাম কিছুটা পথ না হয় হেঁটেই যাব। সেদিন মনে হলো ইশ্ যদি আরও কিছু টাকা বেশি থাকত দিয়ে দিতাম অথবা কোনো হোটেলে নিয়ে গিয়ে ভাত খাওয়াতাম। ঠিক করে নিলাম এবার যেদিন দেখা হবে অবশ্যই কিছু টাকা দিয়ে দিব। দেখা অবশ্যই হবে যদি রোজ এই শহরে রিক্সা চালায়। আমিও রোজ বের হই আড্ডা দিতে। দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। গন্তব্যে পোঁছার পর হঠাৎ কি মনে হলো! মোবাইল ব্যাকপাট খুললাম। অবাক আর কষ্ট পেয়েছিলাম খুব। মোবাইলের কভারের মধ্যে ছিলো একশত পঁচাত্তর বা পঁচাশি টাকা। টাকা গুলো কোন একদিন রেখেছিলাম কিন্তু মনে ছিল না। হায়রে! যদি আগেই ব্যাকপাটটা খুলতাম তবে চাচাকে দিতে পারতাম। নিজেই নিজের কপাল চাপড়াতে লাগলাম। তার পর অনেক খুঁজেছি ঐ চাচাকে আর দেখতে পাইনি। জানি না আজ ঐ বৃদ্ধ চাচার সংসার কি করে চলছে, কেউ তার প্রাপ্য খাবারটুকু পৌঁছে দিয়েছে কি না? আজ আবার সেই চাচার জন্য চোখ ভিজে যাচ্ছে।
বৈরাগী মোড়ের সেই কফি শপটাকেও ভীষণ মিস করছি। মিস করছি ওখানকার কোল্ড কফি, হট কফি, লাচ্চি, তেহারী, চিকেন ফ্রাই, হালিম, নুডুলস। যদিও নুডুলস টা ভালো রান্না করত না। যদিও প্রতিবার খাওয়ার পর থাকত গাদা গাদা অভিযোগ তবুও মিস করছি। মিস করছি ওয়েটারদের। চিৎকার চেঁচামেচি করে রোজ যাদের মাথা খেতাম। আমি যতক্ষণ থাকতাম কফিশপে ততক্ষণ ওরা থাকত দৌড়ের উপর। এটা দেন, ওটা দেন,সস দেন, শশা দেন, পানি দেন, কফি এতো কম কেনো, কফিতে এতো মিষ্টি বেশি কেনো, কাপ এতো ছোট কেনো, কফি পাউডার একটু বেশি করে দিতেন পারেন না। আপনাদের এখানে আর আসবই না খেতে যান। পরের দিন সময় মতো ঠিকই পৌঁছে যেতাম কফি শপে। আমার অত্যাচারে তারা একটুও অতিষ্ঠ হতো না। হাসি মুখে সব শুনতে। জানেই আধপাগল প্রতিদিনের কাস্টমার। খাওয়া শেষে মন চাইলে হালকা পাতলা বকশিসও দিয়ে দিতাম।
যাদের ছাড়া আমার প্রতিদিনের আড্ডাই জমতো না তাদেরকেও ভীষণ ভীষণ মিস করছি। টগর আপু, সুইম, তামান্না তোমাদের সবাইকে মিস করছি। খুব খুব মিস করছি সুগার মিলের মাঠ, পুকুর পাড়, নারিকেল তলা আমাদের আড্ডা আর সেলফি তোলার যোগ্যস্থান।
যখন আমরা সবাই বসতাম মাঠে প্রচণ্ড হাসাহাসি করতাম। আমাদের ঝংকার তোলা হাসির ফোয়ারা সুগার মিলের মাঠের আকাশ মাটিকে একাকার করে ফেলতো। সুগার মিলের মাঠের এক পাশে বরই গাছ ছিল। সুইম গিয়ে ঢিল ছুড়ে মারলো বরই গাছে। আমিও দৌড়ে গেলাম বরই কুড়িয়ে নিলাম। আর সুযোগ বুঝে এই ঘটনাটা টগর আপু ক্যামেরা বন্দী করলো। পরে যখন দেখালো আমরা অনেক আকুতি মিনতি করে বললাম ফেইসবুকে ভিডিও টা যেনো না দেয়। সুইমকে আমার মোটেও ভরসা নেই। বললাম ঐ সুইম এই ভিডিও টা দিস না রে। সুইম বললো আপনি কি যে বলেন আপু, নিজের অপকর্ম কেউ ভাইরাল করে নাকি? প্রচণ্ড হাসিতে ফেটে পরি আমরা। মিস করছি তামান্নার পিছনে লেগে থাকা। আমি সুইম সবসময় তামান্নার পিছনে পড়তাম। অকারণেই জ্বালাতাম তামান্নাকে। রাস্তার মাঝখানে টগর আপুর জুতা ছিঁড়ে যাওয়া নিয়ে কত হাসাহাসি করলাম আমরা। আজ আবার যেতে ইচ্ছে করছে পছন্দের জায়গা গুলোতে। খুব খারাপ লাগছে সবাইকে ছেড়ে থাকতে। কিন্তু নিরুপায় হয়ে ঘরে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
কোন এক কারণে তোমাকে নিয়ে প্রচণ্ড অভিমান জমেছিল আমার মনে। সেদিন তো ঠিক করে নিয়েছিলাম আর থাকবো না এ শহরে। কিন্তু আজ দেখো সেই তোমার জন্য চোখে বইছে অশ্রু সাগর। জানি না আবার কবে নিঃসঙ্গ, নিস্তেজ প্রাণ হয়ে উঠবে প্রাণবন্ত, উচ্ছল। আদৌও হবে কি না জানি? জানি না সেই সময় গুলো কি আর ফিরে পাবো আমরা? প্রিয় শহর তুমি ভালো থেকো। ভালো রেখো তোমার বুকে আশ্রয় নেওয়া সমস্ত সৃষ্টিকে। যদি আর কখনও না ফিরি তোমার কোলে ভুলে যেওনা আমাকে। মনে রেখো আমিও ছিলাম তোমার বুকে।
২৬টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
খুব খুব ভালো লেগেছে। সবাই সবার শহরকে, ফেলে আসা দিনগুলোকে কখনো কখনো খুব বেশি মিস করে। ধন্যবাদ আপু। শুভ কামনা রইলো
সুরাইয়া পারভীন
একদম সঠিক বলেছেন দিদি
কৃতজ্ঞতা সহ আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন।
ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন সবসময়
ফয়জুল মহী
ফেলে আসা স্মৃতি ভুলে থাকতে হয় সত্য । কিন্তু একটা চাপা কষ্ট নিয়ে
সুরাইয়া পারভীন
একদম সঠিক বলেছেন
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন
ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন সবসময়
নিতাই বাবু
লেখা পড়ে নিজের স্মৃতিতে হারিয়ে গেলাম! লেখা খুব ভালো লেগেছে।
শুভকামনা থাকলো।
সুরাইয়া পারভীন
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন দাদা
ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন সবসময়
কামাল উদ্দিন
দেশ গৃহবন্ধি আছে কিন্তু মনকে বন্ধি করা তো আর সম্ভব নয়। এমন ছোট বড় ঘটনাগুলো সবারই মনটাকে উতলা করে। বেঁচে থাকলে একদিন হয়তো আরা আবার ফিরবো স্বমহিমায়…….শুভ সকাল আপু।
সুরাইয়া পারভীন
শুভ দুপুর।
সেই আশায় তো এখনো গৃহবন্দী হয়ে আছি।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন ভাইয়া
ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন সবসময়
ছাইরাছ হেলাল
বাহ্, অনেক সুন্দর লেখা। স্মৃতি একমাত্র অমোঘ সত্য যা আমরা নেড়েচেড়ে উল্টে-পাল্টে দেখি,
দেখতে পারি। আমাদের বেঁচে থাকার বেঁচে যাওয়ার, শিক্ষা নেয়ার হাতের কাছে থাকা একমাত্র অকৃত্রিম বাস্তবতা।
শিলিগুড়িতে রিক্সায় শহর ঘুড়ে, নেমে যাওয়ার সময় রিক্সাওয়ালা টাকা নিতে চায়নি, আমাকে তার ভালোলেগেছে বলে,
তাঁকে মনে রেখেছি আজঅব্দি। মোবাইলের যুগ ছিল না, আপসোস।
সুরাইয়া পারভীন
স্মৃতি কখনও ম্লান হয়ে না
স্মৃতিতে কখনও জমে না ধূলিকণা
চমৎকার মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া
কৃতজ্ঞতা অশেষ
ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন সবসময়
সুপায়ন বড়ুয়া
আপনার শহর আজ শুনশান নিরবতায়
সবুজ পত্রপল্লবে অপরূপ সাজে সজ্জিত।
জন কোলাহল ও শহরের প্রাণ ফিরে আসুক
এই কামনায়।
সুরাইয়া পারভীন
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন দাদা
ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন সবসময়
সুরাইয়া নার্গিস
চমৎকার লিখছেন আপু।
প্রিয় শহরকে কখনো ভুলা যায় না, তার স্মৃতিতে মিশে থাকে।
শুভ কামনা রইল আপু।
সুরাইয়া পারভীন
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন আপু
ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন সবসময়
আপনার জন্যও রইলো অসংখ্য শুভকামনা
প্রদীপ চক্রবর্তী
ফেলে আসা স্মৃতি অনেককিছু মনে করিয়ে দেয়।
বেশ ভালো লেখনী দিদি।
সুরাইয়া পারভীন
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন দাদা
ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন সবসময়
জিসান শা ইকরাম
শহরকে নিয়েও এমন সুন্দর লেখা লেখা যায় ধারনাই ছিলনা আমার।
প্রিয় শহরের সাথে জড়িয়ে থাকে কত স্মৃতি, কত জনেই বা আপনার মত এত আবেগ দিয়ে তা প্রকাশ করতে পারে?
ভালো থাকুন।
শুভ কামনা।
সুরাইয়া পারভীন
কৃতজ্ঞতা সহ আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন ভাইয়া। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন সবসময়
সাবিনা ইয়াসমিন
দৈনন্দিন ব্যস্ততায়, শত কোলাহলের মধ্যে ভুলে যাই নিজেকে সহ আরও কত কিছু। ঠিক তখনই একলা থাকার সময় গুলো মাঝে মাঝে আমাদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে আসে। স্মৃতিরা ঘুরেফিরে ধরা দেয় মনের পর্দায়। কিছু ভুল, সেই সাথে ভুলে যাওয়া ক্ষণ, দুঃখ-আনন্দ গুলো নিজেদের মেলে দেয় একান্ত অবসর মূহুর্তে। প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসেব ছাড়িয়ে শুধু স্মৃতি গুলোকেই খুব আপন মনে হয়।
খুব ভালো লাগলো পড়ে,
শুভ কামনা অবিরত 🌹🌹
সুরাইয়া পারভীন
এতো সুন্দর মন্তব্য লেখাটাকে আরও সুন্দর করে তুলেছে।
কৃতজ্ঞতা সহ আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন আপু
ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন সবসময় 💜💜
সঞ্জয় মালাকার
চমৎকার লিখছেন দিদি,
প্রিয় শহরকে কখনো ভুলা যায় না।
সুরাইয়া পারভীন
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন দাদা
ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন সবসময়
তৌহিদ
চমৎকার লেখা পড়লাম। স্মৃতিচারনায় জীবনের উপলব্ধিগুলো দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। এই লেখায় আপনার লেখনশৈলীতে মুগ্ধ হলাম আপু।
ভালো থাকবেন।
সুরাইয়া পারভীন
কৃতজ্ঞতা সহ আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন ভাইয়া
ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন সবসময়
হালিম নজরুল
স্মৃতির শহর মানুষকে সুখ ও দুঃখ দুটোই দান করে।
সুরাইয়া পারভীন
একদম সঠিক বলেছেন ভাইয়া
ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন সবসময়
ধন্যবাদ অশেষ