
বগা লেক বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতার স্বাদু পানির একটি হ্রদ। বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে বগালেকের অবস্থান কেওকারাডং পর্বতের গা ঘেষে, রুমা উপজেলায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ১,২৪৬ ফুট । ফানেল বা চোঙা আকৃতির একটি পাহাড়ের চুড়ায় বগা লেকের অদ্ভুত গঠন অনেকটা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মতো।
বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিকগণের মতে বগাকাইন হ্রদ মৃত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ কিংবা মহাশূন্য থেকে উল্কাপিণ্ডের পতনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে আবার ভূমিধ্বসের কারণেও এটি সৃষ্টি হতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন।
বগা লেক নিয়ে বম, মারমা, ম্রো, খুমি ও ত্রিপুরাদের পৌরাণিক কাহিনি বা মিথ রয়েছে। এমন একটি পৌরাণিক কাহিনি হল বগাহ্রদের পাশে একটি বম পাড়া (বগামুখপাড়া) এবং একটি মুরং পাড়া আছে। স্থানীয় আদিবাসীরা বম, মুরং বা ম্রো, তঞ্চংগ্যা এবং ত্রিপুরাসহ অন্যান্য আদিবাসী। স্থানীয় আদিবাসীদের উপকথা অনুযায়ী, অনেক কাল আগে পাহাড়ের গুহায় একটি ড্রাগন বাস করতো। বম ভাষায় ড্রাগনকে “বগা” বলা হয়। ড্রাগন-দেবতাকে তুষ্ট করতে স্থানীয়রা গবাদী পশু উৎসর্গ করতেন। কিন্তু একবার কয়েকজন এই ড্রাগন দেবতাকে হত্যা করলে চূঁড়াটি জলমগ্ন হ্রদে পরিণত হয় এবং গ্রামগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে। যদিও এই উপকথার কোনো বাস্তব প্রমাণ নেই, তবুও উপকথার আগুন উদগীরণকারী ড্রাগন বা বগা এবং হ্রদের জ্বালামুখের মতো গঠন মৃত আগ্নেয়গিরির ধারণাটির সাথে মিলে যায়।
অপর এক পৌরাণিক কাহিনীতে বলা হয়েছে বগা লেক ছিল একটি সমৃদ্ধ মুরং গ্রাম। গ্রামের পাশে একটি সুড়ঙ্গে বড় আকারের সাপ থাকত। এক দিন ওই সাপটি গ্রামবাসীরা ধরে খেয়ে ফেলে। ওই সাপ খাওয়ায় নাগরাজার প্রতিশোধের কারণে গ্রামবাসীসহ গ্রামটি দেবে গিয়ে বগা লেকের সৃষ্টি হয়। এখনো অনেক বম, ম্রোর বিশ্বাস, হ্রদের গভীরে থাকা নাগরাজ লেজ নাড়ালে হ্রদের পানি ঘোলাটে হয়ে ওঠে।
এই লেকটি তিনদিক থেকে পর্বতশৃঙ্গ দ্বারা বেষ্টিত। এর গভীরতা হচ্ছে ১২৫ ফুট। এটি সম্পূর্ণ আবদ্ধ একটি লেক, এখান থেকে পানি বের হতে পারে না এবং কোনো পানি ঢুকতেও পারে না। এর আশেপাশে পানির কোনো দৃশ্যমান উৎসও নেই। হ্রদের পানি কখনও পরিষ্কার আবার কখনওবা ঘোলাটে হয়ে যায়। কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন এর তলদেশে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ রয়েছে। এই প্রস্রবণ থেকে পানি বের হওয়ার সময় হ্রদের পানির রঙ বদলে যায়। সূত্রঃ
(২) আমাদের বহন কারী চান্দের গাড়ির রাস্তা এটা, রুমা থেকে সরাসরি বগামুখপাড়ায় জীপ (চান্দের গাড়ি ) চালু হয়েছে। তবে যারা রোলার কোস্টারে ভয় পান তারা চান্দের গাড়িতে না উঠাই শ্রেয়, কারণ এই গাড়ি রোলার কোস্টারের চেয়ে অনেক বেশী ভয়াবহ। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে ঝিরিপথে। এ পথে হাঁটলেই বগা লেক যাওয়ার আসল মজাটা পাওয়া যায় । প্রায় পঞ্চাশবারেরও বেশি ঝর্ণা আর ঝিলের পথ পার হতে হবে। সময় লাগবে ৬ থেকে ৭ ঘন্টা। এ পথে সামান্য ঝুঁকি আছে। তবে দুঃখের বিষয় হলো ওপথে যাওয়া হলো না সময় স্বল্পতার জন্য ।
(৩) এই গ্রামটার নাম নাংলে পাড়া, অত্যন্ত চমৎকার এই পাড়ায় অবশ্য আমাদের নামার সুযোগ হয়নি। নাংলে পাড়ার পরের পাড়ার নামই হলো বগামুখ পাড়া। চান্দের গাড়ি থেকে ওখানেই আমাদের নেমে যেতে হবে। কিন্তু রোলার কোস্টার থেকে আমাদের একটু আগেই নেমে যেতে হয়। শীতকালে যতটা পথ গাড়ি দিয়ে যাওয়া যায় বর্ষাকালে ততটা যাওয়া যায় না, সুতরাং আজ একটু বেশীই হাটতে হবে।
(৪) এবার শুরু হলো আমাদের হাটা পথ, বগামুখ পারা থেকে বলে লেকে উঠার পথটা অনেক কঠিন। এখানকার চড়াই বেয়ে উঠার সময় বিপরিত দিক থেকে আশা বাতাস শরীরে কোনভাবেই না লাগার কারণে ঘেমে নেয়ে একেবারে একাকার। তখন যদি বলা হয় আর দুই স্টেপ দূরেই স্বর্গ তবু ওই দুই স্টেপ দিতেই যেন জান বের হয়ে যায়।
(৫/৬) কষ্টের এই সময়গুলো অবশ্য আমাদের সাহস যুগিয়েছিলো নাম না জানা পাহাড়ি এই ফুলগুলো।
(৭) জুম চাষঃ তিল এবং ধান।
(৮) আর্মি ক্যাম্পে সবার নাম ঠিকানা পরিচয় পত্রাদি লিখে দিয়ে তারপরই বগালেকে ঢুকতে হবে।
(৯) এটা বগালেক আর্মি ক্যাম্প।
(১০) আর্মিদের কাছে রিপোর্টিং শেষে অল্প পথ আগালেই আমাদের গন্তব্যের শেষ পথ এবং এক রাতের ঠিকানা ওই তো সামনেই দেখা যাচ্ছে।
(১১/১২) এই সেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থিত আমাদের কাঙ্খিত বগা লেক। তিন দিকেই সবুজ পাহাড়ে ঘেরা অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন।
(১৩) এখানে পর্যটকদের থাকা খাওয়ার জন্য বমদের নির্মিত অনেকগুলো রেষ্ট হাউজ আছে, ইদানিং সরকারী রেষ্ট হাউজও নাকি তৈরি করা হয়েছে বলে শুনেছি। পাহাড়ি আবহে আদিবাসী ঘরানার এই রেষ্ট হাউজে রাত কাটানো অভিজ্ঞতা সত্যিই অনন্য।
(১৪) লেকের পাড়ে এটা বমদের প্রার্থনা গৃহ।
(১৫) বগা লেকের ইতিহাস যেখানে লিখা।
(১৬) সুতা দিয়ে কিছু তৈরি করছে একজন বম আদিবাসী ও তার ছোট্ট মেয়েটি।
(১৭) কিছু রেষ্ট হাউজ এমন লেক ঘেষেও তৈরি করা আছে।
(১৮) বগালেক থেকে কেওকারাডাং এর পথে কিছুটা উপরে উঠলেই দেখা মেলে এমন মেঘের অন্য এক লেক। যেখানে পাহাড়ের চুড়াগুলোও শুধু দৃশ্যমান হয়। বাকি সবই মেঘের নীচে ঢাকা পড়ে আছে।
(১৯) আশে পাশের পাড়ায় কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে এভাবেই পাহাড়ের চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে ওরা ছুটে যায় রুমা হয়ে বান্দরবানের দিকে।
(২০) বগা লেকে ছিলাম এক রাত্র, তারপরই আবার এমন পথ ধরে আমাদের রুমার দিকে ফিরে চলা।
২২টি মন্তব্য
তৌহিদ
বগালেক সম্পর্কে আপনার এই লেখা এবং ছবি পড়ে একটি গান গাইছি- এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবেনাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।
সুন্দর একটি পোষ্ট দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ কামাল ভাই। শুভকামনা সবসময়।
কামাল উদ্দিন
আমি ভ্রমণে বের হলে মনের ভেতর সব সময় এই গানটা বাজতেই থাকে তৌহিদ ভাই, ভালো থাকবেন সব সময়।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
চমৎকার বর্ণনা সহ ছবি ব্লগ। ১১, ১৮ নং ছবি দেখে মন , চোখ জুড়িয়ে গেলো। ধন্যবাদ ভাইয়া। শুভ কামনা রইলো সবসময়ের জন্য
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ আপু, আপনার জন্যও শুভ কামনা সব সময়।
সাবিনা ইয়াসমিন
মিথ গুলো চমকপ্রদ। বগা লেকে পানির মূল উৎস এবং নির্গমনের কোন পথ দৃশ্যগত না থাকার কারণেই হয়তো আদিবাসীরা মিথ গুলোর উপর এখনো বিশ্বাস রাখে।
সব গুলো ছবিই সুন্দর। ১৯ নম্বর ছবিটি বেশি মনোযোগ কাড়লো। দূর্গম স্থানে অসুখ বিসুখে, অসহায় সময়ের ভাতৃত্ব বন্ধনের সুন্দর একটা ছবি এটি। মানুষ মানুষের জন্য, এটি সব জাতি-উপজাতিদের মাঝেই প্রতিষ্ঠিত সত্যি।
কামাল উদ্দিন
এমন মিথগুলো যেখানেই শুনি সেখানেই ছুটে যেতে ইচ্ছে, ইচ্ছে করে ওসব ছুয়ে দেকে শিহরিত হতে। শুভ কামনা জানবেন আপু।
জাহাঙ্গীর আলম
আপনার পোষ্ট বরাবরই অসাধারণ। ছবিগুলো আরো অসাধারণ। ছবি যেন কথা বলে। ধন্যবাদ + শুভকামনা কামাল ভাই।
কামাল উদ্দিন
জাহাঙ্গীর ইচ্ছে করলে কিন্তু দুয়েকটা পোষ্ট দিতে পারো সোনেলা ব্লগে।
সুপায়ন বড়ুয়া
ওয়াও ! মিটা পানির বগা লেকের সাথে
মেঘের লেক দেখাও সৌভাগ্যের ব্যাপার।
ভাল লাগলো। শুভ কামনা।
কামাল উদ্দিন
হুমম, ঠিক বলেছেন দাদা, ভালো থাকবেন সব সময়।
জিসান শা ইকরাম
এত উচুতে লেক! ভাবাই যায় না।
পানির উৎস হয়ত বৃষ্টির পানি। গভীরতা বেশি থাকায় যা সারা বছয়ে শুকিয়ে যেতে পারে না।
অনেক কিছু জানলাম আপনার এই পোস্টের মাধ্যমে।
ধন্যবাদ আপনাকে।
শুভ কামনা।
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ ইকরাম ভাই, আপনার তথ্য সঠিক হতে পারে। তবে মাঝে মাঝে নাকি এর পানি একেবারে ঘোলা হয়ে যায়, এর ও একটা ব্যখ্যা দরকার……..শুভ রাত্রী।
সুরাইয়া পারভীন
অদ্ভুত সুন্দর আর সবুজে ঘেরা এই বগা লেক স্বচোখে না জানি দেখতে কত সুন্দর। সবুজে সবুজে ভরে আছে চতুর্দিক। যেনো চোখ জুড়িয়ে যায়
আহা! দারুণ দারুণ
আপনার বদৌলতে এত সুন্দর সুন্দর জায়গা সম্পর্কে জানা যায়।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ আপু, ভ্রমণের নেশাটা আমার কাছে হেরোইনের নেশার থেকে একটুও কম নয়…….ভালো থাকবেন সব সময়।
ফয়জুল মহী
আপনি ভ্রমণ প্রিয় মানুষ। সুখে থাকুন আনন্দে থাকুন
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ ভাই, আপনি সব সময় ভালো থাকুন।
নিতাই বাবু
বগা লেক বা বগাকাইন হ্রদ বিষয়ে অনেককিছু জানা হলো, দেখাও হলো। সোনেলা ব্লগে আপনার মাধ্যমে অনেক নাম না জানা জায়গার নাম-সহ জায়গার বিস্তারিত তথ্যাদি জানা যায়। ধন্যবাদ-সহ শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয় দাদা।
কামাল উদ্দিন
মনের ভেতর যাযাবরের বসবাস হলে যা হয় দাদা। খাওয়ার টাকা না থাকলে নেশার টাকা যোগাতে হয়……শুভ কামনা সব সময়।
ছাইরাছ হেলাল
১১/১২ সত্যি-ই সুন্দর, প্রকৃতির মাঝে একটুকরো স্বচ্ছ-শীতলতা।
কামাল উদ্দিন
ধন্যবাদ বড় ভাই, শুভ কামনা জানবেন।
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ ভাই। আপনার কল্যাণে প্রথমবারের মত জায়গাটা সম্পর্কে জানলাম।
কামাল উদ্দিন
আন্তরিক শুভেচ্ছা জানবেন ভাই।