কিশোর গল্প – বগা ভাই ও আমরা (২য় পর্ব)

আতা স্বপন ১১ এপ্রিল ২০২০, শনিবার, ০২:৫৩:৪৫অপরাহ্ন গল্প ১০ মন্তব্য

চার.

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আকাশে তারা আছে । তবে চাদেঁর দেখা নেই। আবছা অন্ধকার আর আলোর খেলা চারপাশে। আমরা আছি গ্রাম থেকে অনেক দুরে জঙ্গলের ভিতরে অভিশপ্ত ভুতুরে মাঠে। কুকুরের তারা খেয়ে দিশে হারা হয়ে কখন যে আমরা ভুতুরে মাঠে এসে পড়েছি বলতে পারব না। এ জঙ্গল আর মাঠ নিয়ে অনেক কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে আমাদের গ্রামে। এ মাঠে কেউ একবার এলে সে আর জ্যান্ত ফিরে যেতে পারে না।

মাঝে মাঝে ভুতুরে মাঠ থেকে ভেসে আসে নানা ধরনের শব্দ। যা সবার কাছে ভৌতিক এক শংকা। এদিকটাতে তাই কেউ আসে না। এমন পরিস্থিতিতে এমন জায়াগায় আমাদের উপস্থিতিতে আমরা হতবিহবল হয়ে পড়লাম। এর মধ্যে নেই বগা ভাই। কি হবে ? কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমরা।
নিস্তব্দতা ভেঙ্গে আমি বললাম, আমরাতো সবাই নিরাপদে আছি। বগা ভাই গেলো কোথায়?
তাইতো বগা ভাইকে তো দেখছি না। বলল পল্টু।
আমরা বগা ভাইকে খোঁজ করতে লাগলাম। সন্ধ্যা হয়ে রাত আসি আসি করছে। বগা ভাইয়ের কোন খবর নেই। ভুতুরে মাঠ থেকেও বেড় হতে পারছিনা। অন্ধকার গাড়ো হচ্ছে।
এক বিপদ গেলোতো আরেক বিপদ। অন্ধকারে থাকব কিভাবে? পল্টু।
লিটু আমাদের মধ্যে সবসময় উদ্ভট কল্পকাহিনি বিশ্বাস করে আর কোন কিছুতে ভৌতিক বিষয় আচ করে ঘাবরে যায়। এখনো পল্টুর কাথা শুনে ঘাবরে গেল-
শুনেছি এই মাঠে রাতের বেলা ভুতের আনাগোনা! হায় আল্লাহ আমাদের রক্ষা কর।
রাখ তোদের ভুতটুত। দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। চল ঐ তালগাছ তলায় যেয়ে বসি।


তোরা বসলে বস। আমি মরে গেলেও বসব না। ওখানে পেত্নী আছে। বলল লিটু।
আমি বললাম , পেত্নীর আর খাইয়া দাইয়া কাজ নাই। যতসব ফাউচিন্তা সবসময়।
কেন, বাগভাই যে তার একটা কবিতায় লিখেছিলো- (ছন্দে ছন্দে কবিতা আবৃতি করে লিটু)
বটগাছে বহ্মদত্য
তাল গাছে পেত্নী
এতো ডাকি তুব কথা
কয় না শাকচুন্নি।
বগা ভাই কি মহা পুরুষ। সে যা বলবে তা বানী হয়ে যাবে। বগা ভাই এক আতেল। তুই তার চেয়ে বড় আতেল। বলল পল্টু।
দেখ বগা ভাই ভুত বিষয়ে অনেক কিছু জানে । তার ভুত বিষয়ে অনেক গুলো ছড়া আমি পড়েছি । আবারো আবৃতি করতে লাগলো-

ঐ দেখা যায় তাল গাছ
ঐটা ভুতের গাঁ
ঐখানেতে বাস করে
গেছো ভুতের ছা।
তোদের বকবক বন্ধ করবি! বগা ভাইয়ের খবর নাই। মহাটেনশন এ আছি। আর তোরা যতসব রাবিশ বিষয় নিয়ে তর্ককরছিস।
যাহোক আমরা সবাই তালগাছ তলা বসলাম। লিটুও গাইগুই করে অনিচ্ছাসত্তে বসল। বুঝলাম ক্লান্ত দেহ আরাম চাইছে। একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

হঠাৎ মাঝরাতে আওয়াজ শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে গোলো। চেয়ে দিখি জঙ্গলের ভিতর থেকে আলো এসে ভুতুরে মাঠ আলোকিত করে ফেলেছে। আমি নিজেকে খুব বেশী সাহসী মনে করিনা। তবে বগা ভাই লিটু পল্টু থেকে সাহসী। কিন্তু আওয়াজটা শুনে আর আলোর হঠাৎ আবিভাবে অজনা শংকায় আমার অন্তর কেঁপে উঠলো। কোথা থেকে শব্দ আসছে খোঁজ করতে লাগলাম। লিটু আর পল্টু তখনো ঘুমে অচেতন। ব্যাপরটা কি দেখার জন্য একা একা অগ্রসর হলাম। একবার অবশ্য ভেবেছিলাম লিটু –পল্টু কে জাগিয়ে একসাথে যাই। পরে ওদের পুরো ব্যপার জেনে সারপ্রাইজ দেবো ভেবে জাগাইনি। জংগলে ভিতর থেকে দুরে আলোর উৎস ধরে গুটি গুটি পায়ে আমি এগুতে এগুতে আমি লক্ষস্থলে পৌছে গেলাম।

কিন্তু এ আমি কি দেখছি! কগুলো গুন্ডা শন্ডা লোক বসে বসে নেশা করছে। এদের মধ্যে দুজন আমার চিনা। আমার কেন আমাদের সবারই চেনা। পিস্তল নিয়ে এরাইতো দৌড়ে চলে গিয়েছিল। পাসে নর্তকিরা নাচছে। নর্তকিদের ঘুংঘুরের আওয়াজ রাতের নিস্তব্দতায় ভৌতিকভাবে আমি শুনেছিলাম।

কিন্তু এরা কারা? কি করছে এই ভৌতিক জংগলে? মনে নানা কৌতুহল নিয়ে আরেকটু সামনে অগ্রসর হলাম। ঠিক তখনই আমার পিঠের উপর একটি হাতে স্পর্শ অনুভব করলাম। ভয়ে আমার সারা শরির শিয়রে উঠল। পিছনে ফিরে তাকাতে ভয় করছিল। না ভুতের ভয় না। ঐ গুন্ডা গুলোর ভয়। পিছনে ফিরে তাকালাম এবং সাথে সাথে চমকে উঠলাম।

পাঁচ.

আমি যখন কোন কারনে চমকে উঠি তখন খুব পস্রাবের বেগ হয়। এখনো হলো তাই। প্রেসারে পেন্ট ভাসিয়ে দেই এ অবস্থা। কিন্তু তখনকার মত সামলে নিলাম। আমার চমকানোর কারন হল পিছনে যে আমার পিঠে হাত রেখে দায়িয়ে আছে সে আর কেউ নয় ! সয়ং আমাদের বগা ভাই। খুশিতে প্রায় চিৎকার দিচ্ছিলাম। কিন্তু বগা ভাই মুখ চেপে ধরে ফিস ফিসিয়ে বললেন, চুপ চুপ চুপ।

আমিও আস্তে আস্তে বললাম, তুমি এখানে এলে কি করে?
আমরওতো একই প্রশ্ন তুই এখানে এলি কি করে? বাকিদের অবস্থা কি?
আছে সবাই আছে। চল আমার সাথে।
বগা ভাইকে নিয়ে তালগাছ তলায় এসে দেখি দুজন তখনো ঘুমোচ্ছে। জাগলাম ওদের । বগা ভাইকে দেখে আমার মতো ওরাও চমকে উঠল। আমাদের ভুতুরে মাঠে পৌছানোর ইতিবৃত তাকে বলা হলো। তারপর আমরা তার কাছে জানতে চাইলাম তার এই হঠাৎ নিখোঁজ আর হঠাৎ আবিভাবের ঘটনা।
বগা ভাই শুরু করলেন তার ভুতুরে মাঠে হঠাৎ আবিভাবের বৃত্তান্ত-
কুকুর দুইটার তারা খেয়ে তোদের সাথে আমিও দৌড়াচ্ছিলাম। কিন্তু তোদের সাথে দৌড়ে না পেড়ে পিছনে পড়ে গেলাম। এদিকে পাজি কুত্তা দুইটা আমাকে প্রায় ধরে ধরে অবস্থা। প্রান পনে ছুটছি। কিন্তু আর কাহতক দৌড়ানো যায়। ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। এতটুকু বলে বগা ভাই থামলেন।
তারপর কি হল? কুত্তা দুইটা কি তোমারে ধরতে পারছিল? উত্তেজনায় লিটুর প্রশ্ন।
তোদের শুধু ফাউল পেচাল। আরে কুত্ত দুইটা যদি আমাকে ধরতে পাড়তো তবেকি আমি এখন এখানে থাকতাম। কবেই মুনকার নাকিরের সংগি হয়ে যেতাম। কথা না বলে যা বলি শুনে যা।
ক্লান্ত হলেও দৌড়া বন্ধ করি নাই। কিন্তু নচ্ছার কুকুর গুলির মনে হয় ক্লান্তি নাই। আমাকে ধরার জন্য জেনো পাগল হয়ে গেছে। অবশেষ আল্লাহর অশেষ রহমত। সামনে একটা গাছ দেখতে পেলাম। দেরি না করে যেইনা গাছে চড়তে গেলাম, পিছন থেকে কুকুর দুইটি আমার জামার কোন কামড়ে ধরল। আমি শক্ত করে গাছের মোটা একটা ডাল ধরে উঠার চেষ্টা করছি। যতই গাছের উপর উঠতে যাই ততই পাজি দুইটি আমার জামার কোনা ধরে নিচে টানে।


দারুন ইন্টরেস্টিং ব্যাপারতো! বলল লিটু।
তোর কাছে যতই ইন্টারেস্টিং লাগুক আমার তখন অজ্ঞান হওয়া বাকি! একসময় গাছে উঠে গেলাম। এদিকে টানাটানিতে আমার সার্ট ছিড়ে একাকার। জম্ম দিনে মামা দিয়ে ছিল। কোন উৎসব আয়োজনে এটা পড়তাম। আমার এতো ভাল শার্টটা। যাক মনকে শান্তনা দিলাম এই বলে- (ছন্দে ছন্দে )
ছিরলে শার্ট ছিরুক না
প্রানটা তুবু বাচুক না
মনিষিরাতো এটাই বলে
যা আছে কপালে
করে যাও নিজের কাম
আপনে বাচলে বাপের নাম।
একসময় কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করতে করতে কোথায় যেনো চলে গেল। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে আমি আর গাছ থেকে নামলাম না। রাত-বিরাতে আর কোথায় যাব একা। তাই ঠিক করলাম এই গাছেই রাতটা কাটিয়ে দিই। মনে নানা প্রশ্ন আমি এখন কোন জায়গায় আছি। তোরাইবা কোথায়? এসব নিয়ে ভাবছিলাম।

হঠাৎ দুড়ে দেখতে পেলাম কিছু ডাকাতটাইপের লোক মশাল হাতে এদিকে আসছে। তাদের কাধে অনেকগুলো বোঝা। আরেক জনের কাধে দেখলাম একজন হাত-পা বাধা লোক। মুখ টেপ দিয়ে আটকানোয় কোন আওয়াজ করতে পাড়ছেনা শুধু গোংগাচ্ছ। মশালের আলোয় আমি তিনজন মানুষকে আমার চিনা চিনা মনে হলো। এদের মধ্যে দুজনকে আমরা রাস্তায় দেখেছিলাম আরেকজন ঐ হাত-পা বাধা লোকটা! তাকেও চিনি । কোথায় যেন তাকে দেখেছি। কিন্তু মনে করতে পারলাম না। উত্তেজনায় আমার সারা শরির কাপছে। গাছ থেকে পড়ে যাব এমন অবস্থা। দারুন ভয় লাগছিল। যদি ডাকতরা আমাকে দেখে ফেলে তবে অবস্থা হবে। আলী বাব চল্লিশ দস্যর কাহিনি আমি জানি। কি সাংঘাতিক! কি ভয়কর! এইসব লোকজন। মনে মনে আল্লাহ কে স্মরন করতে লাগলাম-

বিপদ আমার চার পাসে
কিযে করি এখন
ডাকতের হাতে পড়ে
যায় বুঝি জীবন।
আল্লাহ তুমি কাটিয় দাও
এইবারের মতো ফাড়া
ছাড়বো ছোট চুড়ি দাড়ি
বাগানের আম পাড়া।
একসময় ডাকাতগুলো চলে গেল। আমি গাছ থেকে নেমে তাদের অনুসরন করতে লাগলাম। ডাকাতরা জংগলের ভিতরে একটি আখরার মধ্যে চলে এলো। চারিদিক থেকে শোর শুনা গেল টক্কর গ্রুপ জিন্দাবনদ! সর্দার বিজয়সেন জিন্দাবাদ। তারপর শুরু হলো খানাপিনা । নাচা গান। আর তখনই তোকে উকি ঝুকি মারতে
দেখলাম । এই হলো আমার ঘটনা।

আমার খুব ভয় করছে! ডাকাতরা যদি আমাদের দেখে ফেলে। এর চেয়ে কুকুরের হাতে মরা অনেক ভাল ছিল। কান্না কান্না কন্ঠে লিটুর বিলাপ।
এতো হৈ হুল্লা করিস না তোরা। চিল্লা-ফাল্লা করে কোন ফয়দা নাই। ডাকাতরা এখন নেশা করে অচেতন। ইচ্ছা করলে ওদের আমার ধরতে পারি। বললেন বগ ভাই।
আমি বললাম ঠিকই বলেছ, বাবাজিরা এখন ঘুমে বিভোর। এইতো সুযোগ।


ডাকাতের হাত থেকে পালাইতে পারলেই বাঁচি। আবাদ তাদের ধরা। এমন কাজ আমার দ্বারা হবে না। লিটুর সাফ কথা।
হবে আমাদের দিয়েই হবে। মনে নাই কিভাবে আমরা রামলাল মালিকে টাইট দিয়েছিলাম।


পল্টু এতক্ষন আমাদের কথা শুনছিল। এবার সে বলল, ডাকাত ধরব ভাল, তবে আমরা মাত্র চার জন । এতা গুলো ডাকাতকে কাবু করতে পারবোতো!
বগাভাই বললেন- (ছন্দে ছন্দে)

চল চল চল চল
সিংহ সাবক দল
ঘুমে বিভোরে দল
হূংকার ছেরে উঠে পড়
নরপশুদের হটাতে হবে
চল এগিয়ে চল।
চল চল চল।।

(চলবে)

৮৬৯জন ৭৪৩জন
0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ