
হঠাৎ দেখা এমন একটা দৃশ্য যেন চোখ বিশ্বাসই করছিল না। আটাত্তর বছর বয়সী এক বৃদ্ধা কাছাকাছি বয়সের আরেক বৃদ্ধাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন। পাশে বসা কন্যাসম আরো দুজনও পাতে বাড়া খাবার রেখে মুখে খাবার নেয়ার অপেক্ষায় বসে। কী? ভাবা যায় এমন দৃশ্য? হ্যাঁ, তেমনই এক বিরল দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল গত কয়েকদিন আগে।
নিরিবিলি শান্ত শহরে ততোধিক শান্ত একটি যৌথ পরিবারের দৃশ্য এটি। সামনে খালি জায়গাসহ উঠোনকে একপাশে রেখে দুতলা বাড়িটির সিঁড়ি ভেতরবাড়ির দিকে। উঠোন পেরিয়ে একখানা গেইট। ভেতরবাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ল মাঝখানে উঠোন, একপাশে রান্নাঘর আর গোয়ালঘর, অন্যপাশে দুতলা বাড়িটির ভেতরদিক, একপাশে সিঁড়ি। বাড়ির দুতলায় উঠতে হয় পেছনের সিঁড়ি ভেঙেই। একটু ভিন্ন আঙ্গিকে সম্ভবত যৌথ পরিবারকে কেন্দ্র করেই বানানো বাড়িটি, দেখে তাই মনে হল। দুতলার সামনে-পেছনে চওড়া বড় বারান্দা ঠিক যেন আমার স্বপ্নের মতো। সামনের বারান্দায় বসলে মোটামুটি গাছগাছালির ছায়াঘেরা বাড়ি থেকে বড় রাস্তা থেকে নেমে আসা ফাড়ি রাস্তার সবকিছুই সুন্দরভাবে দেখা যায়। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ উপভোগ্য ছিল। মাঝে তিন কামরার শোবার ঘর। প্রথমদিনে ঘরভর্তি দাওয়াতি আত্মীয় পরিজনের সাথে খানাখাদ্য খাওয়ায় ব্যাপারটা চোখে পড়েনি। পড়েছে সেদিন, যেদিন তল্পিতল্পাসহ তিথিদের বাড়ি গিয়ে উঠেছি। কুষ্টিয়ায় বরকে বিদায় দিয়ে তিথির সাথে মেহেরপুর ফিরে আসি। রাতে খেতে বসবো, খালাম্মা বসবেন না। তিথি বললো, তাঁরা বউ শ্বাশুড়িরা একসাথে খাবে। অগত্যা ঊষাভাবীর বিশেষ তদারকিতে আমরা বন্ধুরা একসাথে খেয়ে উঠে শোবার রুমে ফিরে আসি। খানিকপর পানি খেতে খাওয়ার রুমে যেতেই এ দৃশ্য। ৩/৪ দিন আগে আসা আয়েশা থেকে শুনলাম, বাড়ির মুরুব্বি খালাম্মা (তিথির আম্মা) প্রতিদিন নিয়ম করে নিজপাতে ভাত মাখিয়ে আগে ছোট জাঁ আর দুই বউকে নলা (লোকমা ভাত) খাইয়ে দিয়ে তবেই সকলে যারযার পাতে খেতে বসেন। এ তাদের প্রাত্যহিক নিয়ম। আমি হা হয়ে মুগ্ধতা নিয়ে শুনলাম।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তিথি খালাম্মার একমাত্র সন্তান। সেটাও আমি সেদিনই জানলাম। না বললে হয়তো ছেলে, ছেলেবউ, নাতি-নাতনীদের দেখে বুঝতেই পারতাম না সম্পর্কের সূত্রগুলো।
আরো একটি ব্যাপার, ছেলেরা সব নিচেই থাকেন। তাদের খানাপিনাও নিচে। বাড়ির ছোটচাচা (অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন) আর পরিবারসহ বড় দুইভাইয়ের শোবার ঘর নিচতলায়। ছোটচাচা আবার বিয়ে করেননি প্রেম ঘটিত টানাপোড়ন থাকায়। যে মেয়েটিকে ভালোবাসতেন, নিজ পরিবার রাজী না হওয়ায় আর বিয়েই করেননি। আহা প্রেম! একদিন সন্ধ্যার পর চা-নাস্তার আড্ডায় উপরে এসেছিলেন। আয়েশার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক খুব হতো।
খালাম্মা ইডেনের ছাত্রী ছিলেন। ইন্টার কমপ্লিট করার পর স্কুলে ঢুকে পড়েন। খালাম্মা অবসরে আসার পরই তিথির আব্বা ঢাকা থেকে মেহেরপুর স্থায়ীভাবে চলে যান।
আমরা যেদিন চলে আসলাম, তার পরদিনই অসুস্থতাজনিত কারণে খালাম্মাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। অবশ্য একদিন পরেই সুস্থ হয়ে ফিরে যান।
আমরা আসার আগেরদিন খালাম্মা তিনজনকেই শাড়ি দিলেন, সেটা আবার আমরা তাৎক্ষণিক পরে তিথির ফুফাতো বোনের বাড়িতে সকলে মিলে দাওয়াতও খেতে গিয়েছিলাম।
আমরা ঢাকা থেকে বৃহস্পতিবার রাতে রওয়ানা করেছিলাম। শুক্রবার মেহেরপুর পৌরসভা রেস্টহাউজে উঠে ফ্রেস হয়েই বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই সবাই এক হয়ে আমঝুঁপি, নীলকুঠীতে গেলাম। এরপর মুজিবনগর। দুপুরে তিথিদের ওখানে আত্মীয় পরিজনসহ খেয়ে বিকালে মাথাব্যথা। সারাদিন রোদে ঘুরে সেই মাথাব্যথা। ভাবলাম, রেস্টহাউজে ফিরে আচ্ছামত নিরিবিলিতে এক ঘুম দিলেই মাথাব্যথা কেটে যাবে। পরেরদিন আবার সকালেই কুষ্টিয়া রওয়ানা হতে হবে। ওমা একি! রেস্টহাউজে এসে দেখি ধুমধারাক্কা অনুষ্টান, নিচে কমিউনিটি সেন্টারে এক দম্পতির সিলভার জুবিলীর অনুষ্টান চলছিল। কী আর করা। দরজা বন্ধ করে কানে বালিশচাপা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কোন ফাঁকে ঘুম চেপেছে টের পাইনি, ভোরে ঘুম ভাঙার পর দরজা খুলেই দেখি বাইরে ঝুম বৃষ্টি। আহ! এমন বৃষ্টি কতোদিন এভাবে খোলা বারান্দা থেকে দেখা হয়নি। কিছু করার নেই, গোসল সেরে ঝটপট তৈরি হয়েই দশমিনিটের দূরত্বে তিথিদের ওখানে পৌঁছে গেলাম সবাই একসাথে রওয়ানা করবো।
সারাদিন কুষ্টিয়া ঘুরাঘুরি করে, দুপুরে রেস্টুরেন্টের প্যাকেট খাবার ছিল, বিকালে তিথির এক বোনের বাসায় সান্ধ্যকালীন চা-নাস্তা খেয়ে নয়টার দিকে সালেহকে বাস কাউন্টারে নামিয়ে আমরা ফিরে আসলাম মেহেরপুর।
পরদিন দেখি আবার তিথির গাড়ি এসে হাজির। ফুফাতো বোনের বাসায় দুপুরের খাবার খেয়ে স্থানীয় একটি পার্ক আর শিমুল বাগান ঘুরে পরেরদিন সকাল দশটায় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা।
এবার বলি, এর পরিকল্পনাটা কেমন করে হলো। গতবছরই আমার মেহেরপুর-মুজিবনগর-কুষ্টিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। টিকেট বুকিং করে হোটেল বুক করতে গিয়ে জানি কোন হোটেলই খালি নেই লালন উৎসব শুরু হয়ে যাওয়ায়। অগত্যা টিকেট ক্যান্সেল।
এবছর ফেব্রুয়ারিতে তিথি দেশে ফিরে মেলায় আসবে ডেট জানালো। যথারীতি আমি গেলাম। বৃষ্টি থাকায় অনেকেই আসতে পারেনি, অন্যদিন আসবে। তিথি জানালো, সে দুদিন পরেই মেহেরপুর চলে যাবে, টানা এক মাসের জন্য। পরিকল্পনার সূত্র সেখানেই। “তুমি মেহেরপুর যাচ্ছো মানে? মার্চের ফার্স্ট উইকে তো আমিও যাচ্ছি।” তখনও আমি জানতাম না তিথির বাবাবাড়ি মেহেরপুর। ব্যস, হয়ে গেল। তিথির বন্ধু পারুল আগে থেকেই ফিট ছিল, সাথে আয়েশা যোগ হলো। তিনজনে মিলে সোমবারে চলে গেল, আমি যোগ দিলাম শুক্রবারে।
মনে রাখার মতো একটি আনন্দযাত্রা ছিল এটি। আনন্দটিকে আরেকটু প্রাণোচ্ছল করে ক্ষুদে বন্ধু নাফিম (পারুলের ছেলে)।
মেহেপুরের নিরিবিলি পরিবেশ, প্রায় বাড়িতেই গবাদিপশু পালন বিশেষভাবে নজর কেড়েছে আমার। জানলাম ওখানকার সকলেরই খাবার যোগান আসে নিজ উৎপাদিত উপাদান থেকেই। ভালো লাগার আরেকটি দিক, বড় রাস্তাগুলোতে জ্যাম নেই, হৈচৈ নেই, মানুষের অস্বাভাবিক আনাগোনা নেই। এককথায় অস্থিরতার লেশমাত্র কিছু নেই। শান্ত, কোলাহলহীন একটা শহর।
ভালো লেগেছে বন্ধু তিথির প্রাণবন্ত সঙ্গ, খালাম্মার আদর আর ঊষাভাবীর সদা হাস্যোজ্জ্বল আথিতেয়তা।
১৫টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অনেক আনন্দ করেছেন বোঝাই যাচ্ছে। এমন পরিবার, মায়া মমতা পাওয়া সত্যিই বিরল আজকের সময়ে। ধন্যবাদ আপনাকে এমন সুন্দর মুহূর্ত গুলো শেয়ার করার জন্য আমাদের সাথে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
এরকম আথিতেয়তা আজকাল ঘটেই না। প্রাচুর্যের আড়ালে সব হারিয়ে গেছে। চারদিকে একটা কৃত্রিম আবহ। এসময়ে মায়াময় পরিবারে দুদণ্ড একান্তে সময় কাটাতে পারা আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার।
সুরাইয়া নার্গিস
সবমিলিয়ে অনেক সুন্দর লেখা।
শুভ কামনা রইল।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ।
সুপায়ন বড়ুয়া
যৌথ পরিবারের মজাটাই আলাদা
যা ছেলেবেলা থেকে শিখা যায় শিষ্টাচার , সহমর্মিতা ও সহনশীলতা।
ভাল লাগলো। শুভ কামনা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
শিষ্টাচার, সহমর্মিতা, সহনশীলতা এগুলো যৌথ পরিবার থেকে বা ঘ্ণঘ্ণ পারিবারিক সম্মিলন ঘটলে শিশুমনে তৈরি হতে থাকে।
আজকালকার একক পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুর মধ্যে এই বোধগুলো জেগে ওঠার সুযোগই ঘটছে না। তার থেকেও ভয়ংকর মাঝেমধ্যে যে পারিবারিক একত্রীকরণ দরকার সেটাও হচ্ছেনা। যার ফলে বাচ্চারা ক্রমশ একা হচ্ছে আর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে।
ফয়জুল মহী
দারুণ ,বেশ ভালো লাগলো ।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আসলেই ভালোলাগা একটা সময় কাটিয়ে এলাম।
এস.জেড বাবু
অসাধারণ একটা পরিবারের ছবি দেখলাম আপনার লিখায়।
উপভোগ্য ছিলো আপনার সময়টা।
যৌথ পরিবার – আমার চাওয়া / পাওয়া / ইচ্ছে সবগুলোই বলতে পারেন।
দারুন লিখেছেন।
প্রিয় তে রেখে দিলাম।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
উপভোগ্য, আনন্দময় সময় যাপন।
এস.জেড বাবু
ঠিক তাই
ধন্যবাদ আবারও
জিসান শা ইকরাম
এমন পরিবারই শান্তির নীড়
মারজানা ফেরদৌস রুবা
একদম।
হালিম নজরুল
অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
যাক, একটা লেখা দিয়ে আপনার স্মৃতির ভাণ্ডারে টান দিতে পেরেছি।