বেশ কিছুক্ষণ হল রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। এসময়টিতে এমনিতেই রিকশার সমাগম কম থাকে। আজ মনে হচ্ছে আরও কম। মফঃস্বল এলাকা। লোকজনেরও উপস্থিতিও ধীরেধীরে কমতে থাকে এসময়ে। দুয়েকটি রিকশা যে পাইনি তা নয়। তবে নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে অতিরিক্ত ভাড়া আবদার করায় নাকচ করতে হয়েছে। একে তো পকেট প্রায় শূন্য তার উপর ছাত্র মানুষ। পাঁচ টাকা বেশী চাওয়া মানেই আমার কাছে তখন অনেক কিছু ।
হাতে রাখা ব্যাগটি কাঁধে নিতেই দেখি বয়স্ক এক রিকশাওয়ালা সামনে দাঁড়িয়ে। প্যাসেঞ্জারের আসনটি খালিই আছে দেখলাম।
-‘কাকা কই যাইবেন?’ হাসি মুখে রিকশাওয়ালার প্রশ্ন।
-‘নবগ্রাম যামু’।
-‘আসেন লইয়া যাই’। কথাটি বলেই রিকশা থেকে নেমে এগিয়ে এলো আমার দিকে। ভাবখানা এমন যে আমি নতুন কোনও অতিথি, কেউ একজন এসেছে আমাকে নিতে।
আমি দাঁড়িয়ে আছি। সাধারণত বয়স্ক কোনও রিকশাওয়ালার রিকশায় আমি উঠি না। কেমন যেন এক অপরাধ বোধ কাজ করে ভেতরে। একে তো বয়স্ক তার উপর আবার মুরুব্বি। নিজের কাছেই কেন যেন মনে হয়-মুরুব্বি রিকশাওয়ালাদের রিকশায় উঠতে নেই। এদিকে আবার বৃষ্টি হবে হবে ভাব। ছাতাও নেই সঙ্গে। আমি এগিয়ে গিয়ে রিকশায় উঠলাম। তবে ভাড়া নিয়ে কোনও বাক্যালাপ হল না আমাদের মাঝে।
রিকশাওয়ালা রিকশা নিয়ে এগিয়ে চলছে ধীর গতিতে। তবে এই ধীরের কারণটি শুধুমাত্র তার বয়সের কাছে হার মেনে যাওয়ার জন্য নয়। বিপরীতদিক হতে আসা প্রবল হাওয়াকেও অনেকটা দায়ী করা যায়। আমি ডান হাত দিয়ে ব্যাগ আর বাম হাত দিয়ে রিকশার হুড ধরে বসে আছি। রিকশায় উঠার পর আমাদের মাঝে এখন পর্যন্ত কোনও বাক্য বিনিময় হয়নি। এদিকে বাতাসের গতি কমতে শুরু করছে ধীরেধীরে। রিকশাওয়ালা নীরবে রিকশার প্যাডেল মাড়িয়ে যাচ্ছে। দেখলাম তার পরনের শার্টটি ঘামে ভিজে লেপটে আছে গায়ের সাথে। দেখে বেশ মায়া হল তার উপর। এই বয়সে কত কষ্ট করেই না রিকশা চালায়। পেটের তাগিদে কত কিছুই না করতে হয় দুনিয়ায়। মায়া কাটানোর জন্য কিছু একটা করা দরকার। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে।
-‘চাচার বাড়ি কই?” নীরবতা ভেঙ্গে প্রশ্ন ছুড়লাম রিকশাওয়ালার দিকে।
-‘এইতো কাকা নদীর ঐ পাড়ে বাড়ি। শ্যামগঞ্জে। কিন্তু পরিবার নিয়া এই এলাকায় আছি পাঁচ বছর ধইরা’।
-‘বাড়িতে কেউ থাকে না?”
-‘আত্মীয় ছাড়া তেমন কেউ নাই। পোলা মাইয়ার লেহা পড়ার লিগা চইলা আইছি এইখানে’।
আমি এবার নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। এ বয়সে কায়িক শ্রম করে নিজ সন্তানদের ভরণপোষণ এবং লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া নিতান্তই কষ্টের। তাও আবার যদি রিকশা চালানোর মতো সাধারণ পেশা হয়। আর কথা বাড়াতে ভাল লাগছে না। চুপ করে বসে আছি। গন্তব্যে পৌঁছতে আর বেশী দেরী নেই। সামনের চৌরাস্তা পার হলেই আমার গন্তব্য।
চৌরাস্তার কাছাকাছি আসতেই জালালের সাথে দেখা। জালাল আমার বন্ধু। তবে ওর সাথে আমার পরিচয় বেশী দিনের না। আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে ওর সাথে পরিচয়। তবে আমাদের মধ্যে তুই তুই সম্পর্ক বিরাজমান। একই ব্যাচের আমরা। জালাল কে দেখেই আমি হাঁক ছেড়ে ডাকলাম-“কিরে দোস্ত, লেখাপড়া বাদ দিয়া রাস্তায় কি করস?” জালাল কোনও উত্তর দিল না। কেমন করে যেন মুখটি ফিরিয়ে নিল। মুখ ফিরিয়ে নেবার ভাষাটি ঠিক বোঝা গেলো না। রাস্তার আধো আলো আর আধো অন্ধকারে আমাকে হয়তো চিনতে পারেনি। তবে কণ্ঠ তো চেনার কথা! ব্যাপারটি বেশ ঘোলাটে লাগলো।
গন্তব্যে আসতে না আসতেই রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুড়িয়ে বলে উঠলো-“কাকা আমার পোলাডারে একটু বুঝাইয়েন, লেহাপড়া করবারই চায় না। খালি আছে আড্ডার মইধ্যে”। আকস্মিক তার এমন কথায় আমি কিছুটা ভড়কে গেলাম। তার ছেলেকে বোঝাবো, মানে কি! আর তার ছেলেকে আমার বোঝাতে হবেই বা কেন! রিকশাওয়ালার আকস্মিক এমন কথায় কী সাড়া দেব মনে মনে ভাবছি।
ইতিমধ্যে আমি পৌঁছে গেছি আমার গন্তব্যে। রিকশা থেকে নামতে নামতে তার ছেলের ব্যাপারে জানতে চাইলাম। উত্তরে যা জানলাম তা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। যাকে একটু আগে ‘দোস্ত’ বলে ডাক দিলাম সেই জালাল-ই তার সন্তান। লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়লো আমার চোখেমুখে। খুব বেশী অপরাধী মনে হল নিজেকে তখন। আমি নির্বোধের মতো হয়ে গেলাম। মুখ দিয়ে কোনও কথা বের হল না আমার। নিঃশব্দে পকেট থেকে টাকা বের করলাম। ভাড়া মিটানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া পেলাম না। রিকশাওয়ালা চাচা ভাড়া না নিয়েই চলে যাচ্ছে। কেমন যেন অস্বচ্ছন্দ লাগছে পুরো ব্যাপারটি।
এ ঘটনার পর জালালের সাথে আমার আরও অনেকবার দেখা হয়েছে। আড্ডা হয়েছে। কিন্তু কখনও এ ব্যাপারে কোনও কথা হয়নি। কেনই বা সেদিন ও মুখ ফিরিয়ে নিল জানতেও চাইনি। তবে এটা বুঝেছি ও সেদিন ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। বাবা রিকশার প্যাডেল ঘুরাচ্ছে আর বন্ধু যাত্রী হয়ে রিকশায় বসে আছে, ব্যাপারটি মেনে নেয়া সত্যিই কষ্টের।
পৃথিবীর সব বাবাই তার সন্তানদের কাছে শ্রেষ্ঠ। আবার সব সন্তানই শ্রেষ্ঠ তার বাবার কাছে। সব বাবাই তার সন্তানদের সুখের জন্য নিজের সুখকে বিসর্জন দেন। হোক সেটা গরীব বাবা। সন্তানদের উত্তম কিছু প্রদান করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেন পুরো বাবা জাতি। একজন বাবা হয়ে আমার এমনটিই ধারণা।
….. Rumon Ashraf
১৪টি মন্তব্য
শাহরিন
ভাইয়া কি যে বলবো ভাষা খুজে পাচ্ছি না। মানুষের জীবন বড়ই বিচিত্রময়। বাবা নামের বট গাছটি সব মানুষের জীবনেরই ছায়া। বেচে থাকুক এই বাবা গুলো সন্তানের ভালোবাসায় সবার শ্রদ্ধায়। ধন্যবাদ।
রুমন আশরাফ
সত্যিই বাবা নামের বট গাছটি সব মানুষের জীবনেরই ছায়া। ভাল থাকবেন।
এস.জেড বাবু
বুকের মধ্যে ধুক করে উঠলো, হোঁচট খেলাম ভাই।
‘বাবা’ সম্পর্কটাই কেমন যেন- শুধু দিতেই জানে, দিতেই সুখ পায়।
সুন্দর শুরু এবং শেষ
শুভেচ্ছা রইলো
রুমন আশরাফ
সত্যিই বাবা সম্পর্কটা কেমন যেন!
অনেক ধন্যবাদ ভাই। আপনার প্রতিও শুভেচ্ছা রইলো।
সুরাইয়া পারভিন
পৃথিবীর সব বাবাই তার সন্তানদের কাছে শ্রেষ্ঠ। আবার সব সন্তানই শ্রেষ্ঠ তার বাবার কাছে। সব বাবাই তার সন্তানদের সুখের জন্য নিজের সুখকে বিসর্জন দেন। হোক সেটা গরীব বাবা। সন্তানদের উত্তম কিছু প্রদান করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেন পুরো বাবা জাতি।
একদম বাস্তব সত্য কথা বলেছেন। বাবার তুলনা বাবাই।ভালো থাকুক পৃথিবীর সমস্ত বাবা’রা।
চমৎকার লিখেছেন 👏 👏
রুমন আশরাফ
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য। ভাল থাকুন।
বন্যা লিপি
সব বাবারাই সন্তানদের কাছে শ্রেষ্ঠ বাবা।উক্তিটার কাছে আমি বিনম্র।সাবলীল স্বচ্ছন্দ গল্প ভালো লেগেছে পড়তে।
শুভ কামনা।
রুমন আশরাফ
অনেক ধন্যবাদ বন্যা আপা।
সাবিনা ইয়াসমিন
একজন বাবার কাছে তার সন্তানের চাইতে দামী আর কিছু হয়না, তেমনি বাবার চাইতে বেশি সম্মান সন্তান আর কাউকে দিতে পারেনা।
জালালের কাছে যেমনই লাগুক, তার পিতার কাছে কিন্তু ভালো লেগেছে ছেলের বন্ধুকে নিজের গাড়িতে চড়িয়ে। হোক সেটা বড় গাড়ি বা রিক্সা। নিজের যা আছে সন্তান এবং সন্তানের বন্ধুর জন্যে তা নিবেদন করাতেই বাবার আনন্দ। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল বাবা। ভালো থাকুক বাবার আদর যতনে পালিত সন্তানেরা।
শুভ কামনা রুমন ভাই 🌹🌹
রুমন আশরাফ
এটি আমার জীবনে একটি বাস্তব ঘটনা। তবে কাহিনীর কিছু ব্যাপার একটু অন্যভাবে সাজিয়েছি। জালাল নামটিও ছদ্মনাম। ধন্যবাদ আপনাকে।
রাফি আরাফাত
বাবা মানেই অন্য কিছু। যার ব্যাখ্যা আসলেই অন্যরকম।
ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ ভাই
রুমন আশরাফ
আপনাকেও ধন্যবাদ ভাই।
জিসান শা ইকরাম
বাবা, একটি অন্যন্য সাধারণ ডাক।
বাবার কাছে সন্তান অমূল্য, তেমনি সন্তানের কাছেও বাবা।
ভালো লেগেছে গল্প।
শুভ কামনা।
রুমন আশরাফ
অনেক ধন্যবাদ জিসান ভাই।