
আগেই বলেছিলাম, মায়া দারোয়ান যে পথে হাটতে হাটতে পাহারা দিতো, তার ঠিক উল্টো পথেই যেতো, এইটাই তার কাল হলো, ভোরে আমরা উঠে ফ্রেস হচ্ছি, রেডি হবো স্কুলে যাওয়ার জন্য, এই সময় দারোয়ান ডাক দিয়ে বললো মায়া পড়ে আছে উঠোনের পানি যাওয়ার জন্য বানানো নালাতে।
আমরা সবাই পড়িমরি করে দৌড় দিলাম ঘরের বাইরে, নালার সামনে এসে চিৎকার করে উঠলাম আমরা ভাই বোন আর আম্মা, আম্মা দৌড় দিলেন ভিতরে আব্বাকে ডাকতে।
মায়া তখন হা করে করে নিশ্বাস নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে, চোখ দিয়ে পানি পড়ে ওর গাল ভিজে আছে।
আব্বা ঘুমিয়ে ছিলেন, ওখান থেকেই উঠে এলেন, মায়ার অবস্থা দেখে আব্বা দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন কই ছিলো সে?
দারোয়ান বললো, সারারাত ডিউটি দিয়েছে মায়া ওর সাথে, দারোয়ান পিছনের দিকে গিয়ে ছিলো ডিউটি দিতে, ফজরের আজানের পর ও টয়লেটে গিয়েছিলো, ওখান থেকে ফিরে মায়াকে দেখতে না পেয়ে সে খুঁজতে খুঁজতে এসে দেখে মায়া মাঠিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে নালায় পড়ে গেছে, যা মনে হচ্ছে ওকে বিষ দেওয়া হয়েছে।
আব্বা দ্রুত ওর মুখে পানি দিলেন, একটু পর মায়া চলে গেল না ফেরার দেশে।
আমরা ভাই বোনদের চোখে পানি, পারছিনা জোড়ে কাঁদতে, কাঁদলে আব্বা বকা দেবেন।
আব্বা বললেন, তোমরা রেডি হয়ে স্কুলে চলে যাও, এখন মন খারাপ করে লাভ নেই।
আব্বার মুখের উপর কিছু বলা না বা করার সাহস আমাদের নেই, মনটা প্রচন্ড খারাপ হলেও বাধ্য হয়ে নাস্তার টেবিলে বসলাম, কিছু পেটে গেলোনা আমাদের কারো, স্কুলে চলে গেলাম।
স্কুলে কি আর পড়ার মধ্যে মন বসে, কত স্মৃতি যে বারে বারে ফিরে আসে মনে।
স্কুল ছুটির পর বাসায় ফিরে দেখি মায়া নেই, শুনলাম আব্বার পাড়ার লোক দিয়ে ওকে কবর দিয়েছে, শুনে আরও মন খারাপ হলো।
পরে যা বুঝলাম, দারোয়ান অন্য দিকে গেলে কেউ হয়ত মায়াকে বিষ যুক্ত কিছু ছুঁড়ে দিয়েছে, মায়া হয়ত ব্যক্তিটিকে দেখেনি, দেখলে ও চিৎকার করতো, খাওয়া দেখে ও খেয়ে ফেলাতেই এই মৃত্যু।
আব্বাও কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেলেন।
মাস খানেক পর আব্বা আমাদেরকে উঠোনে ডাক দিলেন, আমরা বাড়ির বারান্দাতে এসে অবাক হলাম, এক লোক ছোট এক কুকুরের শাবক আনছে, আমরা বাচ্চাটাকে দেখছি আর এর মধ্যে আব্বা লোকটিকে বললেন, এটি তো সরাইলের কুকুর না, আমি তো সরাইলের কুকুর আনতে বলেছি।
লোকটি আব্বাকে বুঝাতে চাইলো এইটাই সরাইলের কুকুর।
আব্বা ক্লিয়ার করে বলে দিলেন, হয় সরাইলের কুকুর আনবা, নাহয় আনবানা।
লোকটি বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে গেলো।
এর কয়েক বছর পর আমরা পাড়াটা ছেড়ে চলে গেলাম চট্টগ্রামের নামকরা হাউজিং সোসাইটিতে, আব্বা এইখানে নতুন বাড়ি করেছেন আর আগেরটা বিক্রি করে দিয়েছেন।
আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, বছর খানেক পর আমি এক কুকুর ছানা নিয়ে আসলাম আমার কাজিনের কাছ থেকে, স্পিটজ জাতের ছোট সাদা কুকুর, ঘরের সবাই মহা খুশি, এইটাকেই নিয়ে মশগুল হলাম আবার, নাম রাখলাম কিটস, তখন নাইট রাইডার মুভি চলতো টিভিতে, সেই মুভির ক্যারেকটার ছিলো কিটস নামের এক অত্যাধুনিক গাড়ী, সেই নামেই নাম রাখা হলো কিটস।
আমার আব্বা যেদিন ইন্তেকাল করেন, আমি ছিলাম সিলেট, মধ্যরাতে মাইক্রোবাস নিয়ে রওনা হয়ে যায় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে।
পরে শুনেছি, আমার আব্বাকে রাখা হয়েছিলো ড্রয়িংরুমে এ সিঙ্গেল খাটের উপর, সেইসময় কিটস নাকি পাগলের মতো করে বারবার আব্বার কাছে যেতে চাইছিলো, চিৎকার করছিলো, বাধ্য হয়ে ওকে বেঁধে রাখতে হয়েছিলো, ও এমনি ভাবে প্রভুভক্তি দেখিয়েছিলো।
আমি আর আব্বা বিভিন্ন জাতের কুকুর পুষেছি, জার্মান শেফার্ড, ল্যাব্রাডর, হাস্কি, লাসা ছিলো উল্লেখযোগ্য, এরা সবাই সবসময় প্রভুভক্তির উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখিয়েছে, তাদের কিছু উল্লেখ করার মতো মজার ঘটনা বলি আপনাদেরকে।
ল্যাব্রাডর কুকুরকে ছেড়ে দিলে সে এক দৌড়ে উঠে যেতো সিমানা দেওয়ালে, সেখানেই হেঁটে বেড়াতো সে।
জার্মান শেফার্ড কয়েকটা পুষেছিলাম, তার মধ্যে একটার নাম ছিলো শিলা, এক সকালে আমার ইমিডিয়েট ছোট বোনটা ড্রয়িংরুমের জানালা দিয়ে দেখলো শিলা এক ছেলের গায়ে দুই ঠ্যাং তুলে ওকে স্টান্ডবাই করে রেখেছে, ছেলেটা এসেছিলো ব্যাডমিন্টন কোর্ট থেকে বাল্ব চুরি করতে, ওকে পেয়েই শিলা আটক করে ফেলে, আমার বোন তা দেখে ভয় পেয়ে গেলো, নিশ্চয় শিলা ওর কল্লা গিলে খাবে, এই ভয়েই ও চিৎকার করে শিলা শিলা ছাড়ো ওকে বলে উঠলো আর শিলাও ততখনাৎ চোরকে ছেড়ে দিলো, ছেলেটা সেই সুযোগে পগার পার হয়ে গেলো।
এইসব লেখার একটাই কারণ, কুকুরের প্রভুভক্তি, আপনি যদি ওদের আদর ভালোবাসা দেন, ওরা কখনোই আপনাকে ছেড়ে যাবেনা, দরকার হলে ওরা আপনার জন্য জান দিয়ে দেবে।
সমাপ্ত।
ছবিঃ গুগল।
৩১টি মন্তব্য
হালিম নজরুল
আজই প্রথম ঢুকলাম বলে সঠিকভাবে মন্তব্য করতে পারলাম না।তবে আমি আপনার প্রতি আস্থাশীল।
ইঞ্জা
আন্তরিক ধন্যবাদ ভাই, খুব আনন্দিত হলাম আপনাকে আমাদের মাঝে পেয়ে। 😍
জিসান শা ইকরাম
কুকুরের প্রভু ভক্তি খুবই বেশি,
মায়ার জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
মানুষ কত পিশাচ হলে এমন করে একটা কুকুরকে মেরে ফেলতে পারে।
অনেক কুকুর পেলেছেন দেখছি।
শুভ কামনা।
ইঞ্জা
মায়ার মৃত্যু এখনো পীড়া দেয় আমাকে, ওর স্মৃতি এখনো ভুলতে পারিনা ভাইজান।
শুধু কি কুকুর, সাথে খরগোশ, গিনিপিগ, বেজি, বিভিন্ন জাতের পাখি, বানর, কবুতর পালার অভিজ্ঞতা আমার আছে। 😊
জিসান শা ইকরাম
সব কিছু নিয়ে একটা একটা পোষ্ট দিন,
পড়তে ভালো লাগে 🙂
ইঞ্জা
দেখি ভাইজান, সময় করে একদিন লিখবো।
নিতাই বাবু
শেষমেশ মায়ার জন্য সত্য মনটা খারাপ হয়ে গেল দাদা। আমাদের এই সমাজে কিছু মানুষরূপী শয়তান আছে। ওঁরা মানুষে ভালো তো চায়-ই-না, বনের পশুপাখিদেরও ভালো চায় না। যাইহোক দাদা, আপনার আব্বার প্রতি সম্মান রেখে আপনার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করছি।
ইঞ্জা
সত্যই বলেছেন দাদা, এইসব মানুষরূপী অমানুষ গুলোর চাইতে জানোয়াররা অনেক ভালো।
ধন্যবাদ।
ছাইরাছ হেলাল
আপনি এরো লেখেন, এভাবে শেষ করতে নেই।
অনেক স্মৃতি এসে ভিড় করে এমন লেখা পড়লে।
ইঞ্জা
ভাইজান, স্মৃতির পাতার কথা কি আদতেই শেষ করা যায়, যায়না, এরপরেও শেষ করেও করা হয়না।
মনির হোসেন মমি
কথা সত্য। ওদের আদর করলে প্রভুভক্তের লক্ষণটা ওদের লেজ নাড়ানোতেই বুঝা যায়। খুব ভাল লাগল লেখাটি।
ইঞ্জা
ধন্যবাদ ভাই, সত্যি ওদের ল্যাজ নাড়ানো দেখলেই বুঝা যায় ওরা কত খুশি থাকে তখন।
তৌহিদ
মায়ার মৃত্যুতে কষ্ট পেলাম দাদা। যাদের ভালোবাসি তাদের মৃত্যুতে পরিবারে শোক নেমে আসে। কুকুরের প্রভুভক্ততা নিয়ে প্রশ্ন করার কিছু নেই। এটা আমরা বলতে পারি নিঃসন্দেহে।
মায়া’র এই পর্বটি ভালো লেগেছে দাদা। অনুভাবী গল্পটির জন্য ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য।
ইঞ্জা
এখনো ভুলতে পারিনা সেই দিনটি যেদিন মায়া চলে যায়।
ধন্যবাদ প্রিয় ভাই।
সাখিয়ারা আক্তার তন্নী
লিখাটা পড়ে অন্যরকম ভালো লাগলো,
ইঞ্জা
আন্তরিক ধন্যবাদ আপু।
সাবিনা ইয়াসমিন
মায়ার মৃত্যুর ঘটনা অপ্রত্যাশিত ছিলো। হিংস্রতার কাছে পার পায় না অবলা প্রানীরাও। কত পাষাণ মনের মানুষ হলে একটি জীবকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা যায়!
মন খারাপ হয়ে গেলো ভাইজান। আপনাদের তখন কেমন লেগেছিলো তা অনুভব করতে পারি। আমারও একটি পোষা কুকুর ছিলো। তাকেও বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হয়েছিলো।
আরও লেখা দিন। শুভ কামনা 🌹🌹
ইঞ্জা
আপু মানুষ কিন্তু জানোয়ারের চাইতেও হিংস্র হয় তার প্রমাণ লাখো কোটি আছে, যারা বিষ দিয়ে মায়াদের মেরে ফেলে তাদেরকে ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই দেওয়ার নেই।
আরজু মুক্তা
লেজ নাড়ানো ছাড়াও পায়ের কাছে মাথা কুটে।
ইঞ্জা
হাঁ আপু, ওরা এমনই করে।
রেজওয়ান
কুকুর আসলেই অমায়িক একটা প্রাণী। দেশে আমিও বেশ কয়েকটা কুকুর পেলেছিলাম❤এখন যেখানে আছি সেখানে অনেক ঝামেলা কুকুর পালা🤢তাই কিছুদিন আগে মা সহ ৭টি সাবক রেস্কিউ করেছিলাম যখন আমার পার্কিংএ ওদের দেখেছিলাম🤘
ইঞ্জা
হাঁ সেই ঘটনা জেনেছিলাম তোমার পোস্ট থেকে, জানি ওদেরকে খুব ভালোবাসো তোমরা দুজন। 😊
রেজওয়ান
সময় ম্যানেজ করতে পারি না ইদানীং ভাই😪সাজেশন দেন কিভাবে ব্লগে সময় দিবো?
ইঞ্জা
সেই সময় আমারও যে দরকার ভাই।
অনন্য অর্ণব
কুকুর পৃথিবীর সবথেকে বেশি প্রভু ভক্ত প্রাণী। এতে কোন সন্দেহ নেই। আপনার চয়েস এবং কালেকশন সম্পর্কে জানতে পেরে খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।
ইঞ্জা
আন্তরিক ধন্যবাদ ভাই, জীবনে শুধু কি কুকুর?
আমি হরেক জাতের পাখি, বেজি, খরগীস, গিনিপিগ, কবুতর, বানর, তিতির সহ অনেক কিছুই পুষতাম।
ইঞ্জা
খরগোশ ★
সুরাইয়া পারভিন
মায়ার এমন মর্মান্তিক মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। মানুষ নামক জানোয়ার গুলো কত হিংস্র হয়।মায়াকে মেরেই ফেললো
ইঞ্জা
আপু আমি কখনোই কোন জীবকে অযথায় কারো ক্ষতি করতে দেখেনি, মানুষই আস্লে সবচাইতে হিংস্র।
জাকিয়া জেসমিন যূথী
হৃদয় আদ্র করে দিলো লেখাটি।
আপনার লেখা পাঠের বেশ আগ্রহে জড়িয়ে যাচ্ছি। একটানে পড়ে ফেলেছি ৪ টি পর্ব।
ইঞ্জা
ধন্যবাদ অশেষ আপু, ভালো থাকবেন।