
দেশের বিপন্ন পাখি প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপন্নের তালিকায় রয়েছে শকুন। অতীতে শত শত শকুন নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের হাওরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা এবং বড় বড় গাছের মগডালে দেখা গেলেও এখন তেমন একটা দেখা মিলছে না। এক সময় শকুন ছিল গ্রামবাংলার চিরচেনা পাখি। সে সময় পশু বা জীবজানোয়ার মারা গেলে দলবেঁধে হাজির হতো শত শত শকুন। নিমিষেই মৃত পশু বা জীবজানোয়ার খেয়ে সাবাড় করত। তাড়াতে চাইলে কিছু দূরে আবার বসে থাকত। এ পাখিকে ‘প্রকৃতির অলঙ্কার’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। খাদ্য সংকটসহ খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট ও উঁচু গাছপালা হারিয়ে যাওয়ায় এদের অস্তিত্বের সংকট দেখা দিয়েছে।
পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে পাখি ভালোবাসে না। পাখির গান শুনতে পছন্দ করে না। পাখির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় না। কয়েক দশক আগেও গ্রামবাংলা সবুজ গাছ-গাছালিতে ভরা ছিল। ঝোপ-ঝাড় ছিল। চারপাশ মুখরিত ছিল পাখির কলকাকলিতে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পাল্লা দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বন-জঙ্গল উজাড় হচ্ছে। বিনষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন গাছ-গাছালি। মানুষের প্রয়োজনে বিভিন্ন জেলার বনাঞ্চল থেকে ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার করে নির্মাণ করা হচ্ছে সড়ক, স্থাপনা, বাজারসহ জনবসতি। এতে বিপন্ন হয়ে উঠছে প্রকৃতি। প্রকৃতি বিপন্ন হওয়ার কারণেই হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র। এক সময় হাওর এলাকায় ও বড় বড় নদীর খোলা আকাশে বহু উপরে উড়ে বেড়াত ঝাঁকে ঝাঁকে শকুন। একটি শকুনকে নিচে নামতে দেখলেই বাকিগুলো তাকে অনুসরণ করে মরা পশু খেয়ে সাবাড় করে দিত। আকাশে ওড়া শকুন দেখে মানুষ বুঝতে পারতেন ওই আকাশের নিচে কোনো প্রাণী মরেছে। এসব খাবার খেয়ে বড় বড় উঁচু গাছ ও বিশেষ করে শিমুল গাছে ডানা মেলে বসে থাকত শকুন। শকুনই একমাত্র পাখি যারা গবাদিপশুর মৃতদেহ খেতে পারে। মৃত গবাদিপশু খেয়ে শকুন পরিবেশ পরিছন্ন করে রাখত। যার জন্য শকুনকে প্রকৃতির ঝাঁড়ুদার নামেও ডাকা হতো। অ্যানথ্রাক্সসহ বিভিন্ন রোগ-জীবাণু হজম করার ক্ষমতা শকুনের আছে। এখন হাওরে বা নদী পাড়ে শিমুল, তাল, বট, রেইনট্রি, কড়ই কিংবা উঁচু কোনো গাছ অথবা ঝোপ-ঝাঁড় নেই আগের মতো। আর অনেকটা এ কারনেই হারিয়ে গেছে শুকুন।
পরিবেশবিদদের মতে, কল-কারখানার দূষিত বর্জ্যের কারণে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে শকুনসহ নানা প্রজাতির পাখি। এ ছাড়াও গ্রামাঞ্চলে এখন আগের মতো গণহারে পশু পালন করা হয় না। যে কটি গবাদিপশু আছে এগুলোর দু-একটি মারা গেলে খোলা আকাশের নিচে না ফেলে মাটিতে পুঁতে রাখে। ফলে এদের খাদ্য সংকট দিন দিন বেড়ে চলেছে। আর এ কারণে শকুন চরম খাদ্য সংকটে পড়েছে। শস্যক্ষেতে বিষটোপ, খাদ্য সংকট ও গবাদিপশুর চিকিৎসার প্রদাহরোধক ওষুধ ডাইক্লোফেনাক ব্যবহারে এবং প্রাচীন ও উঁচু গাছ নিধন হওয়ায় শকুন কমে যাচ্ছে। ফলে শকুনের অস্তিত্ব প্রায় শূন্যের কোঠায়। বর্তমানে হবিগঞ্জ জেলার রেমা ফরেস্টে কিছু বেসরকারী সংগঠন শকুনের বংশবৃদ্ধির জন্য কাজ করছে। ২০১২ সাল থেকে এরা রেমায় শকুনের অভয়ারন্য গড়ে তোলার চেষ্টা ও গবেষণা করছে। প্রকৃতির সব বণ্যপ্রাণী ও পাখি স্বাভাবিক নিয়মে বেঁচে থাকুক এটাই হোক আমাদের সবার কাম্য।
শকুন হচ্ছে Accipitridae গোত্রের ৭৫-৮৫ সে.মি. দৈর্ঘ্যের কালচে দেহের গলা ছিলা পাখি। পালকহীন মাথা ও ঘাড় কালচে ধূসর। কোমর সাদা। নিচ থেকে দেখলে সাদাটে গলাবদ্ধ ও ডানার ত্রিকোণ সাদা অংশ ছাড়া সারা দেহ কালো। চোখ বাদামী। পা কালো।
বাংলা নামঃ শকুন।
ইংরেজি নাম: white-rumped vulture.
বৈজ্ঞানিক নাম: Gyps bengalensis.
ছবিগুলো হবিগঞ্জের রেমা থেকে তোলা।
১৯টি মন্তব্য
জাহিদ হাসান শিশির
আজ দশ বছর হয়,কোথাও কোন শকুন দেখিনি।
শামীম চৌধুরী
আরো বেশী সময় ধরে শকুন দেশে বিপন্ন হয়ে গেছে।
জাহিদ হাসান শিশির
একে নাকি প্রকৃতির ঝাড়ুদার বলা হতো । কিন্তু এখন তো সব উবে গেছে দেশ থেকে।
শামীম চৌধুরী
ঠিকই বলেছেন। ঝাড়ুদারই ছিলো প্রকৃতির অলংকার
নিতাই বাবু
মানুষ বাড়ছে। বসতি বাড়ছে। জমিজমা কমছে। খালবিল ভরাট হচ্ছে। গাছপালা কমে যাচ্ছে। কাজেই পাখিদের বংশ ধ্বংস হচ্ছে। পরিবেশ দুষিত হচ্ছে। রোগব্যাধি ছড়াচ্ছে। বিষাক্ত কীটপতঙ্গের উপদ্রব বাড়ছে। তাই বর্তমানে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে মানুষ মরছে। এসবের জন্য দায়ী আমরা নিজেরাই।
শামীম চৌধুরী
কষ্টটা দাদা সেখানেই তবুও আমাদের সচেতনতা নেই।
ইঞ্জা
ধন্যবাদ ভাই এমন পোস্ট দেওয়ার জন্য, দিন দিন শকুন কমে যাচ্ছে আমাদের দেশে, এর জন্য দায়ী কিন্তু আমরা মানুষরাই কিন্তু আমাদের নুখা উচিত এই শকুনরাই আমাদের পরিবেশ রক্ষায় অনেক সহযোগিতা করে।
শামীম চৌধুরী
এরা বিলুপ্ত হওয়ায় দেশে রোগ বিরোগের আশাংকা দেখা দিচ্ছে। প্রকৃতিতে বসবাসকারী সব প্রাণীই মানব উপকারের জন্য। আমরা নিজেরাই নিজেদের পায়ের কুড়াল দিচ্ছি।
আরজু মুক্তা
শকুন দেখেছিলাম চিড়িয়াখানায়।
সরকারের উচিত এসব বিলুপ্তি প্রায় প্রাণি নিয়ে কাজ করা
শামীম চৌধুরী
সরকার করছে না আপু। তবে সামাজিক সংগঠনগুলো বিদেশে থেকে সাহায্য এনে কাজ করছে।
প্রদীপ চক্রবর্তী
কয়েকবছর পর শকুন দেখালাম।
আর এসব দিনদিন বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে।
শকুনরা ফিরে আসুক তাদের নিজ নীড়ে।
ছাইরাছ হেলাল
ছোট বেলায় আকাশজুড়ে শকুনের ওড়াউড়ি দেখেছি, বেশ মনে আছে।
এখন শকুনের জায়গা অন্যেরা দখল করেছে!
ফিরে আসুক প্রকৃতি তার নিয়মে, তা কিন্তু চাই-ই।
শামীম চৌধুরী
প্রকৃতির তার নিজস্ব নিয়েমে ফিরে আসতে হলে প্রকৃতিতে বসবাসকারী লোভী মানুষদের লোভ সংবরন করতে হবে। নইলে আমরাই একদিন প্রকৃতির কাছে ধরা খাবো্
তৌহিদ
প্রকৃতি থেকে এই পাখি বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে আমাদের মানুষের কারনেই। অনেক বছর আগে একবার সামনাসামনি শকুন দেখেছিলাম, এরপরে আর দেখনি।
রেমা প্রজেক্ট কি সফল হয়েছে ভাই? ধন্যবাদ এমন সুন্দরভাবে শকুন নিয়ে লেখার জন্য। পরিবেশ রক্ষার্থে এদের বংশবৃদ্ধি করার সুযোগ দিতে হবে বলে মনে করি।
শামীম চৌধুরী
রেমাতেই এখন ওদের অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে। দিনরাত আইইউসিএন কাজ করে যাচ্ছে। গত মাসে আমি গিয়ে ঘুরে এসেছি প্রজেক্টের লোকজনের সাথে। এখন প্রায় ৫০০ এর অধিক পরিবার
শাহরিন
পরিবেশ রক্ষায় যারা কাজ করে তাদের নজরদারি খুবই কম এসব ব্যাপারে। আমরা আফসোস করার দলে যোগ হলাম।
জাহিদ হাসান শিশির
দশ বছর আগে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় নদীর পাড়ে একটা শকুনকে মরা জন্তু খেতে দেখেছিলাম ব্রীজের উপর থেকে।
মনির হোসেন মমি
শকুনের দোয়ায় এখন আর গরু মরে না তাই এরাও দুঃখে দেশান্তরীত হচ্ছে। দারুণ তথ্য বহুল একটি লেখা।
জিসান শা ইকরাম
শকুন এখন আর দেখিই না, শেষ কবে দেখেছি মনে নেই।
প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারিয়েছে বিভিন্ন কারনে,
একে আর রক্ষা করা যাবেনা মনে হয়।