দুধের নাড়ু ও সুরজিৎ

নীরা সাদীয়া ১৩ মার্চ ২০১৯, বুধবার, ১১:০৬:১৭অপরাহ্ন গল্প ১৫ মন্তব্য

তখন সবে তৃতীয় শ্রেনিতে উঠেছি। মনটা ভীষণ খারাপ। প্রতিবারই আধা নম্বর নয়ত এক নম্বরের কারনে হেরে যাই, রোলটা পিছিয়ে যায়। কোন না কোন বিষয়ে সুরজিৎ আধা কিংবা এক/দু’নম্বর বেশি পাবেই পাবে! কত চেষ্টা করি, তবু তাকে টপকাতে পারি না।

সুরজিৎ আমাদের ক্লাসের প্রথম হওয়া ছাত্র। দেখতে ইয়ো ইয়ো টাইপ, প্রচন্ড সুন্দর, একবার দেখে কেউ দ্বিতীয় বার না তাকিয়ে পারবে না। যেমন ফর্সা, তেমনি কিউট একটা মুখ, ফর্সা হাত, পা, ঘন কালো ছোট ছোট চুল।কোন অংশে কম সুন্দর নয়। স্কুল ড্রেসের সাদা শার্ট নেভী ব্লু প্যান্টের সাথে লাল সোয়েটার পরে আসতো শীতের দিন। তাতে করে তার সৌন্দর্য বহুগুন বেড়ে যেত। স্কুলে এসেই বসতো ডানদিকের সারির প্রথম বেঞ্চের ডান কর্নারে। এই একটাই তার নির্দিষ্ট বসার জায়গা ছিলো। বেঞ্চে বসে সামনে পেছনে ডানে বায়ে কোনদিকেই তাকাতো না। কারো সাথে কথা বলতো না। ক্লাস শুরু না হওয়া অব্দি চুপচাপ বসে থাকত।কথা বলতো একমাত্র টিচারের সাথে, তাও ম্যাম যদি কিছু জিজ্ঞেস করতেন তখন। ম্যামের সুবাদে আমরাও জানতে পারতাম সুরজিৎ বোবা নয়।

একটা সময় তার প্রতি ভীষণ জেদ চাপতো। জেদ হবার বেশ কয়েকটা কারন ছিলো, যেমন: সবসময় কিছু না কিছু নাম্বার বেশি পায়, আমাদের সাথে খেলে না, কথা বলে না, এত বেশি সুন্দর, কি যেন টিফিন খায়, আমাদেরকে দেয় না ইত্যাদি।

স্কুলে আমরা বন্ধুরা মিলে একটা গ্রুপের মত ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধা মাঠে একসাথে কানামাছি, বৌছি খেলতাম টিফিন বেলায়। গ্রুপটাতে ছিলো সানি, ফারজানা, মম, হাসিব, মুক্তা, নুমা, কবিতা এবং আরও অনেকে। সানি ছিল সুরজিতের প্রতিবেশি। তো একদিন টিফিনের আগের ক্লাসে সানি হঠাৎ বলছে,

: জানিস, সুরজিতের বাসায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় পূজো হয়। তখন তারা একসাথে পূজো করে আর সবাই মিলে কি যেন খায়!আমি জানালা দিয়ে দেখেছি। দেখতে বেশ সুন্দর নাড়ুর মত, সাদা সাদা, সম্ভবত দুধ দিয়ে বানায়! আমি একদিন চেয়েছিলাম, দেয়নি।

এটা শুনেই আমাদের জীভে জল চলে এলো।তখন ছিলো রোজার মাস। আমরা ছোটরা শখ করে ২/৩ টা রোজা রাখতাম, বেশি ভালো ইফতারের লোভে। কিন্তু এই মাসটা আমাদের একটু সুবিধা করে দিলো। সানিকে পরামর্শ দিলাম

:আজ সন্ধ্যায় তুই সুরজিতের বাসায় ইফতার নিয়ে যাবি। তখন প্লেট তো আর খালি দিতে পারবে না, ২/১ টা নাড়ু নিশ্চই দেবে।

এটা শুনে মুক্তা,নুমা সহ সবাই ফিশফিশ করে বলতে লাগলো

“আমাদের জন্যেও আনিস।”

পরদিন সানি এসে আপডেট দিলো, ইফতারের প্লেটে কটা কাটা ফলের সালাদ দিয়েছে! এটা শুনে আমরা সবাই হতাশ। কিন্তু হাল ছাড়লাম না। প্ল্যান এ কাজ করেনি তো কি হয়েছে? চট করে বানিয়ে ফেললাম প্ল্যান বি। এবারের প্ল্যান হলো, আমরা সবাই টিফিনের সময় খেলাধূলা না করে সুরজিতের বাড়ি যাবো। গিয়ে আন্টির কাছে নাড়ু চাইবো। যে কথা সে কাজ। টিফিন ঘন্টা হতেই বের হয়ে গেলাম ক্লাস থেকে। নাড়ুই যখন খাবো, তাহলে বাসা থেকে আনা ওসব বিস্বাদ টিফিন কে খায়? সানি আমাদের পৌঁছে দিল সুরজিতের বাসার সামনে, আর সে আড়ালে লুকিয়ে রইলো যেন ধরা না পরে। দেখলাম সবুজ রঙের একটা গেট। ভয়ে ভয়ে গেট খুলে ভেতরে উঁকি দিলাম। দেখি শাড়ি পরা, সিঁদুর পরা, খোঁপা করা, ফর্সামতন একজন ভদ্রমহিলা ছোট ছোট থালা আর গ্লাস মাজছে। এসব দেখে ভীষণ অবাক হলাম, ভাবলাম সুরজিত বোধহয় এখনো এসব খেলনা দিয়ে খেলে। ছেলেটা আর বড় হলো না। এবার বুঝলাম কেন আমাদের সাথে কানামাছি, বরফ পানি খেলে না। খেলবে কি করে, ও তো বড়ই হয়নি। এসব ভাবতে ভাবতেই শুনতে পেলাম, ভদ্রমহিলা আমাদেরকে কিছু বলছেন। ধরে নিয়েছি ওনিই আন্টি। আমরা ছোট ছোট পায়ে আন্টির দিকে এগিয়ে গেলাম। তিনি বললেন

:কি চাই? তোমরা কে?
: আন্টি আমরা শোলাকিয়া সরকারী স্কুলে পড়ি।
: আচ্ছা। কোন ক্লাসে পড়?
: ক্লাস থ্রী।
: ও… তোমরা সুরজিতের বন্ধু?

আমরা কিছু না ভেবেই মাথা দুলিয়ে বললাম হ্যাঁ। মনে মনে বললাম, “যা একখান ছেলে আপনার, কারো সাথেই মেশে না, তার আবার বন্ধু!” কিন্তু যদি না সূচক কিছু বলি, তাহলে নাড়ু মিস! তাই রোজার মাসেও মিথ্যে বলতে হলো। এবার আন্টি বলছেন

:তোমরা কেন এসেছো? পড়া জানতে?
:না মানে আন্টি, ইয়ে…
:কি চাই, বলো…
: আন্টি, আপনারা পূজোর সময় কি জানি একটা খান, সাদা সাদা… নাড়ুর মত, ঐটা আমরাও খেতে চাই!

আন্টি এসব শুনে কতক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন আমাদের দিকে। আমরাও চুপ। কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে তিনি বললেন,

:এখন তো পূজো করছি না, সন্ধ্যায় পূজো হবে।তখন বরং এসো, নাড়ু দেব।

সবাই মুখ কালো করে বেরিয়ে এলাম। দূর থেকে আমাদের মুখ দেখেই সানি হতাশ। আমাদের একেকজনের বাসা কত দূরে! আমার বাসা শোলাকিয়া মাঠের ধারে, মমর বাসা আখড়া বাজার, সানি আর মুক্তার বাসা অবশ্য স্কুলের কাছেই। বাকিরা অর্থাৎ ফারজানা, হাসিব, নুমা ওরা হেঁটেই খরমপট্টি আসে। তাই প্ল্যান করলাম, আমি আমার খালার বাসা উকিল পাড়ায় থেকে যাবো। মম থাকবে তার চাচার বাসায়। তারপর বিকেল বেলা আবার সবাই একত্রিত হবো, ‘আমাদের গন্তব্য সুরজিতের বাসা’!

প্ল্যানমত বিকেল বিকেল করে সবাই চলে এলো মুক্তিযোদ্ধা মাঠে। সন্ধ্যা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম সুরজিতের বাসায়। পূজো শুরু হতে একটু বাকি, তবে প্রস্তূতি চলছে।আন্টি আমাদেরকে বসতে দিলেন। সন্ধ্যেতে তারা পরিবারের সকলে একত্রিত হয়ে পূজো দেয়। পূজো শুরু হলো, সবাই হাজির, শুধু সুরজিৎ আসেনি। তার নাকি ঘুম ভাঙেনি। কিছুক্ষণ পর হাতমুখ ভেজা নিয়েই ঠাকুর ঘরে এলো সুরজিৎ। আসামাত্রই, তার সুমিত দাদা দিলেন কড়া করে একটা ঝাড়ি!

:তুই কোনখানের নবাবরে? প্রতিদিন পূজোর সময় দেরি করে আসিস? তোর ঘুম ভাঙে না?

আমরা মুখটিপে হাসছিলাম। এরই মাঝে সানির মুখ থেকে একটু ‘হিহিঃ ‘ বের হয়ে গেছে! সঙ্গে সঙ্গে সুরজিৎ পেছনে তাকালো। তাকিয়ে যেই আমাদেরকে দেখলো, তার চক্ষু ছানাবড়া! আমাদের দেখে যেন ভূত দেখছে! আমরা তাকে খেয়াল না করে পূজো দেখতে লাগলাম। দেখি, ঐ ছোট ছোট থালা, গ্লাস এসব দিয়ে পূজো করে। তার মানে এগুলো দিয়ে সে খেলে না। যাই হোক, পূজো শেষ। এবার আন্টি প্রসাদ বিতরন করছেন। একটা নাড়ু থেকেই ভেঙে ভেঙে সবাইকে দিচ্ছেন। আর আমাদের সবাইকে দিলেন আস্তো আস্তো একেকটা নাড়ু! আমাদের সে কি খুশি! নাড়ু হাতে নিয়েই দিলাম দৌড়।

পরদিন স্কুল মাঠে সবাই দাঁড়িয়ে মিটিং করছিলাম। এমন সময় ফার্স্টবয়ের আগমন। একে অপরকে ইশারা করলাম, “দেখ, ঐ যে আসছে!” এসে সুরজিৎ আমাদের দিকে কেমন একটা দৃষ্টিতে যেন তাকালো। এই প্রথম তাকালো সবার দিকে, চোখ দুটো কী সুন্দর! কালো কালো চোখের মণি। পরক্ষনেই রাগ উঠলো,ঐ আধা নম্বরের কথা মনে পড়ে গেলো। রাগ গলে আবার জলও হলো, যেহেতু ঠিক আগের দিনই দুধের নাড়ু খেয়ে জেদ মিটিয়েছি! তারপর থেকে সুরজিৎ ক্লাসে ঢুকেই প্রথমে কেমন যেন ভয়ার্ত চোখে রোজ একবার করে আমাদের দিকে তাকায়। আমরাও তাকে আসতে দেখলে একে অন্যকে ইশারা করি। এভাবে অনেকদিন কেটে গেল।

চতুর্থ শ্রেনিতে ওঠার পর আমি কিশোরগঞ্জ ছেড়ে ময়মনসিংহে চলে এলাম। সেই যে এলাম, আর তাদের কারো খোঁজ জানতে পাররলাম না। ২০০০ সাল পেরিয়ে চলে এলো ২০০৯, মাঝে নয়টা বছর চলে গেলো। তাদের কারো সাথে কোন যোগাযোগ নেই।শুধু তাদের স্মৃতিটুকুই রয়ে গেছে।এস এস সি পাস করে মুমিনুন্নিসা কলেজে ভর্তি হবার সুবাদে শুধু ফারজানার দেখা পেলাম, তাও এত বছর পর কাওকে তো পেলাম। যদিও ফারজানা অন্য সবার ব্যপারে তথ্য দিলেও সুরজিতের কোন খবর দিতে পারলো না।

এসময় একদিন সৈয়দ নজরুল কলেজের সামনে দিয়ে হেঁটে ইশতিয়াক স্যারের বাসায় যাচ্ছিলাম পদার্থের ব্যবহারিক খাতা সাইন করাতে। হঠাৎ পথিমধ্যে সুরজিতের সুমিতদার সাথে দেখা। তিনি এতদিন পর আমাকে দেখেও চিনতে পারলেন। কোথায় আছি, কিসে পড়ছি সেসব জানতে চাইলেন। তারপর একটা ফোন নাম্বার দিয়ে বললেন,

: এটা সুরজিতের নাম্বার। ফোন করিস, কথা বলিস।

আমি ভেবে নিলাম, ছোটবেলায় যত প্রতিযোগীতাই থাকুক না কেন, এখন সবাই বড় হয়ে গেছি। স্কুল জীবন শেষ। এখন নিশ্চই এই ছেলেটা একটু পাল্টেছে। ফোন করে কথা বলে নেব একদিন।

কিছুদিন পর সুরজিতের নাম্বারে ডায়াল করলাম, ফোন ধরে সে বললো:
: হ্যালো, আসসালামুঅালাইকুম!

(টিনের চালে কাক,আমি তো অবাক!)

:ওয়ালাইকুম সালাম। এটা কোন জায়গা?
:ময়মনসিংহ।
:আপনার নাম কি?
:সুরজিৎ
:কিসে পড়েন?
:একাদশ শ্রেনি
:কোন শাখা?
:বিজ্ঞান।

১৫ মিনিট এসব গল্প হবার পর সে বলে উঠলো
:এই, আপনি কে বলুন তো? তখন থেকে প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন!
:আমি সাদীয়া, তোমার সাথে শোলাকিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম…মনে পড়ে?

ওপাশ থেকে কটাশ করে ফোনটা কেটে দিল…!

 

১৩.০৩.১৯

১০০৯জন ৮৫৭জন
0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ