অজো পাড়া গাঁ বলতে অউন্নত এলাকা যেখানে প্রচুর খাস অকেজু জমি থাকে।তেমনি একটি গ্রাম যেখানে সন্ধ্যা হলেই পুরো এলাকা জন শূণ্য হয়ে পড়ে।তার আরো একটি বিশেষ কারন হলো রাতের গভীরতার সাথে সাথে ডাকাত ছিনতাইয়ের উপদ্রব বেড়ে যায়।এখানেই লোক মুখে শুনা বহুকাল পূর্বে ইসলাম ধর্ম প্রচারে আসা সুদূর ইন্দোনেশিয়া থেকে এক সূধী দরবেশ বাবার আগমন ঘটে।যিনি তৎকালে এ অঞ্চলে একটি ছোট্র ছুনের ছাউনি ঘরে বসবাস করতেন এবং ধর্ম প্রচারে কিছু এ দেশের ভক্তকে তার সাথে রাখতেন।তাদের সাত পুরুষের শেষ পুরুষ আজকের এই দরবারের খাজাঁর উৎপত্তি।
ছোট সেই ছুনের ছাউনি ঘরটি কালের পরিক্রমায় বিশাল এক এলাকা নিয়ে এক কবিরাজ রাজ্যে বিস্তৃত হয়েছে।সেই দরবেশের মৃত্যুর পর তার সমাধি স্থলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি মাজার।যার খাদেম এখন সকল কর্মের প্রধান।এই খাদেম হলো আজকের বড় হুজুর,বড় কবিরাজ।তার আছে বিশাল ভক্ত আশেকান দল।বিশাল দেহের মুখে লম্বা দাড়ি,চুল তার কান বরাবর ফ্যাশান করা,মাথায় নৌকা টুপি।প্রত্যহ চলে উৎসব আনন্দ আর ভক্তি মুলক নাচ গান।মাজারটির ঠিক পিছনের দিকে একটি স্থায়ী ঘরে চলছে দমে দমে দম মারো… ছাড়া গলায় ভান্ডারী গান আর গঞ্জিকা সেবন।বড় হুজুর এখনো আসেননি।ঠিক সকাল নয়টায় তার আসবার কথা,প্রত্যহ সে ঠিক সময়েই ভক্তদের মাঝে উপস্থিত হন কিন্তু কেউ বুঝতে পারেন না সে কি ভাবে কোন দিক দিয়ে ভক্তদের মাঝে উপস্থিত হলেন।কেউ নিদিষ্ট করে বলতে পারেন না বড় হুজুর এই দিক দিয়েই তার দোয়া ঝাড়া স্থানে প্রবেশ করতে দেখেছেন।
বড় হুজুর মজারের পিছনে যে ঘরটি আছে সেই ঘরটিকে বিশাল ছায়া দিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িঁয়ে আছে এক বিশাল দেহী বট বৃক্ষ।যার ছায়ার তলে চলে,চলে বড় হুজুরের কবিরাজ গিরি।বট বৃক্ষের ঝুলন্ত শিকড়ে শিকড়ে চিকিৎসার নামে পা বেধে মাথা নিচু করে রসি দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছেন বেশ কয়েকটি শিশু বাচ্চা।যাদের অভিযোগ আছে ভূতের আছর লেগেছে ওদের গায়।
সজলের মা সেই ভোর বেলায় রওয়ানা দিয়েছেন ছেলে সজলকে নিয়ে বড় হুজুরের দরবারের দিকে।তাকে দরবারে পৌছতে প্রায় ঘন্টা খানেক লাগে।পথি মধ্যে দেখা হয় সেই মাতাব্বর শ্রেনী লোকটির সাথে সে তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।চলার পথে দেখা হয় আরো অনেকের সাথে যারা সেখানেই যাচ্ছেন।অনেক ভিড় ঠেলে হুজুরের বৈঠকের সামনের সারিতে সজলের মাকে দাড় করিয়ে মাতাব্বর ভিতরে দিকে চলে যান।
বড় হুজুর ধ্যানে মগ্ন।সন্নাসীর ন্যায় চোখ বন্ধ করে তপস্যায় ব্রত হুজুর।তার সামনে বিশাল ঘামলায় ধুপের জ্বলন্ত স্তুব হতে অনবরত ধোয়াঁ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো তপস্যা স্থলে।বিশাল ধূম তার যখনি হর্ক মাওলা বলে সূর তুলেন তখন মজলিসে যেনো কান্নায় একটা আত্ম শুদ্ধির সূর উঠে যা মানুষকে ভাবিয়ে তুলে,তার পৃথিবীতে কি তার দায়,কি তার আয়।
এমন একটি পরিস্থিতিতে হুজুর চোখ খুলে আঙ্গুলের ইশারাঁয় হঠাৎ সজলের মায়ের নাম মুখে আনেন।ততক্ষনে সজলের মাও অবাক হন হুজুর তার নাম জানল কেমন করে।সজলও মায়ের আচলেরঁ তলে মুখ লোকায় হুজুরে কর্কস শব্দ শুনতে পেয়ে।
-ঐ..ঐডা ফরিদের বউ ফুলী না?ছেলেটির দিকে তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল হুজুর।
-ঐ দেখছো তোমার ছেলে কি ভাবে আমারে দেইক্ষা ভয় পাইয়া মুখ লুকায়,সমস্যা নাই…ওরে ভুত পেত্নী দুটোয় ধরেছে তয় প্রাথমিক অবস্থায় আছে। ছেলেডারে তেল মালিশ করতে হবে…দে পাঠিয়ে দে, ঐ বেঞ্চতে।ঐ যে….ঐ খানে ছেলেডারে শুয়ে দিয়ে চলে আসবা আবার নিজ জায়গায়৴৴৴।
পাশেই বাশেঁর কঞ্চি দিয়ে বানানো একটি বিশেষ টেবিল শুয়ে দেবার মিনিটেই টেবিলের এক পাশ দাড়িয়ে বা খাড়া হয়ে যায়।সজলের বেলায়ও হলো তাই,মাথা নীচু পা উপর হয়ে শুয়ে থাকা।সজল যেনো নিশ্চুপ তবে হাতে কাউকে আঘাত করার চেষ্টা কম করেনি হঠাৎ সেই হাত দুটো কি যেনো বন্ধন এসে বেধে ফেলল।অতপর এক সন্ন্যাসী এসে তার মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দেয় জিয়ল মাছের জল।সে কয়েকবার বমি করার চেষ্টা করল অবশেষে মুখ দিয়ে কেবলি ফেনা বের হল।
সজলের সমস্ত দেহ চুপ চুপ তেল মালিশ করা হল।টেবিলটিকে আগের অবস্থানে এনে তাকে তার মায়ের কাছে যেতে বলে মালিশওয়ালা।সজলের সমস্থ চোখ কেমন যেনো অস্বাভাবিক লাল হয়ে গেল।মুখে যন্ত্রনায় কাতর অনবরত গোঙ্গানীর শব্দ।বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে অচেতনার ন্যায় ধীরে ধীরে মায়ের নিকট এগুতে থাকে সজল।মা দূর থেকে দেখে ছেলের কষ্ট সইতে না পেরে দৌড়ে তাকে বুকে জড়িয়ে কয়েক বার কপালে গালে চুমু খেল।এরই মাঝে হুজুর ফুলীকে ডাক দেন।
-ঐ…ফুলী দেখতো ওর মুখে কোন মাছের গন্ধ পাছ কি না।মা তার ছেলের মুখে নাক দিয়ে বুঝতে পারেন হুজুরের কথাই সত্য।
-হ…হুজুর!
-ভয় নাই,সঙ্গে তোকে এক বোতল সরিষার তেল দিবো।সাত দিন ওর পুরো দেহে তেল মালিশ করবি আর এই সাত ওর শরীরে কোন জল স্পর্শ করাবি না।সাত দিন পর আমি হঠাৎ দেখবি তোর বাড়ীতে চলে গেছি।তুই এহন যেতে পারিস….হর্ক মাওলা।
হুজুর এবার ভূতে ধরা দুটো শিশু বাচ্চাকে দু পায়ে ধরে সজোরে ঘুরাতে থাকেন।এর পর বাচ্চা দুটোকে মাটিতে শুয়ে পা দিয়ে ফুটবলের মতো লাথি মেরে নিদিষ্ট দাগের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন আবার ব্যাক করছেন।এমন পরিস্থিতিতে শিশুদুটো প্রশ্রাব করে দেয় তবুও হুজুরের টনক নড়ে না (ছবি: কোন এক গ্রামের বাস্তব চিত্র)।
ফুলী তার আধো মরা ছেলের এক হাত কাধে রেখে বাড়ী ফিরে যাবার পথে মাতাব্বরের সাথে দেখা।
-কি গো ফরিদের বউ হুজুরে অষুধ দিছে?
-হ চাচা,
-তা খরচাদি কিছু যোগার কইরা রাইখো…।
-হুজুরতো তা কিছু কয় নাই,এই দেহেন এক বোতল তেলও দিলো।
-আরে বুঝনা কেন. এসব কিনতে টেহা লাগে না।তাছাড়া হুজুরতো টাহার কথা তোমারে কইবো না কইবো আমারে।বুঝলা কিছু….???
ফুলী মাথা ঝুলিয়ে তার কথার সম্মতি দিলেন।এরই মাঝে মাতাব্বরের কানে ভেসে আসছে কয়েক জনের উচ্চারিত একটি বাক্য..”ঐ বুড়া তোর বুড়ি কই” মাতাব্বার এ দিক ওদিক তাকিয়ে অস্থির।আবারও একই বাক্য তার কানে আসে।ঐ বুড়া তোর বুড়ি কই” এবারো কাউকে খুজেঁ পেল না সে।দূরে এক কিশোরকে যেতে দেখে সে তাকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন “হারাম জাদা তোর মা কই ক…তোর মা কই কছনা কেন?এমন সব প্রলাপ বলতে বলতে দৌড়ে কিশোর ছেলেটির পিছু নিলেন।এই ফাকে প্রকৃত ব্যাঙ্গকারী কিশোর মানে সজলের বন্ধুরা গাছের ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে সজলকে তার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে তার দুপাশে হাত দুটো দু বন্ধু দু কাধে তুলে ধীর গতিতে তাকে বাড়ীতে নিয়ে যায়।ততক্ষণ সজল বন্ধুদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে নিঃশব্দে শুধু চেয়ে থাকে তখনো অনবরত তার মুখ দিয়ে লালা বের হতে থাকে।
১৪টি মন্তব্য
ইঞ্জা
কত ভন্ড কবিরাজ ফকির দেখলাম যারা শুধুই প্রতারণা করে কিন্তু ভয় মানুষকে কতো নিরুপায় করে তার একটা প্রমান আপনার এই গল্প।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ধন্যবাদ ভাইয়া -{@ এ সব ভন্ডদের থেকে সাবধান থাকতে গ্রামবাসীকে সচেতন করতে রাষ্ট্রীয় উদ্দ্যেগ থাকা প্রয়োজন।
ইঞ্জা
আজকাল রাস্ট্র এদের কথায় বেশি শুনছে ভাই।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমি পীর-কবিরাজ-জ্যোতিষী বিশ্বাস করিনা।
ভন্ডামী ছাড়া এরা কিছুই জানেনা।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সহমত -{@ ধন্যবাদ।
মোঃ মজিবর রহমান
ভন্ড কবিরাজ, ভন্ড চিকিৎসা।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ধন্যবাদ মজিবর ভাই -{@
আবু খায়ের আনিছ
পাঁড়া,অনুন্নত, অকেজু(পতিত/খালি), জনশূণ্য, শোনা,ছোট্ট,ছনের। এবং ধর্ম প্রচারে এ দেশের কিছু ভক্তকে তার সাথে রাখতেন।
কবিরাজ, পীর, জ্যোতিষী এদের কাউকে বিশ্বাস করি না। এড়িয়ে চলি এদের।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ধন্যবাদ -{@ সুন্দর মন্তব্য।
নীরা সাদীয়া
আজো এসব চলে পাড়াগাঁয়ে!
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
হ্যা দিদি এখনো অনেক এমন গ্রাম এমন সরল সোজা মানুষ আছে।ধন্যবাদ -{@
মৌনতা রিতু
আমি খুব চঞ্চল স্বভাবের। সব বিষয়ে কৌতহল খুব আমার। আমি এমন কিছু কিছু স্বচোখে দেখেছি। তবে শেষকালে ব্যবস্থাও নিয়েছি কয়েকবার। ঐ ওষুধ ওদেরও খাওয়াইছি কয়েকবার। ঐ ক্ষমতার দাপট আর কি :p
আসলে আমি মনে করি এসব কবিরাজের কাছে যারা যায় তারাই মূলত বেয়াদপ।
ওদের ঐ সব টেকনিকেই আসলে সহজ সরল মূর্খ মানুষগুলো ফাঁদে পড়ে।
এই সুযোগগুলোই আসলে ওরা নেয়।
নাজমুস সাকিব রহমান
মাঝে মধ্যে মনে হয়, সময় সব বদলাতে পারে না।
জিসান শা ইকরাম
ভন্ডদের থেকে সহজ সরল সমাজকে রক্ষা করতেই হবে,
শুভ কামনা।