
“রিয়া, না গেলেই কি নয়?”
“দুখিত। আমার কিছু করার নেই।আপনার ভবিষ্যত আলোকোজ্জ্বল জীবনের জন্য একরাশ শুভকামনা রেখে গেলাম।”
“জীবনটাকে অার কি দিয়ে আলোকিত করব বলতে পারো?”
“কারো জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। থাকে কি?”
………..
আরো কিছু ছোটখাট কথা হল দুজনের মধ্যে।কিন্তু রিয়া তার সিদ্ধান্তে অটল।অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে পেয়েছে চাকরীটা।মানুষ তাকে ছেড়ে গেলেও চাকরিটা তারই থাকবে।তাই কোন কিছুর বিনিময়ে চাকরী ছেড়ে ঘর সংসারে ব্রতী হতে তার আর মন টানে না।সংসার কেন যেন তার ভালো লাগে না।
এদিকে রোহানও কাপড় গোছাতে গেল,তার ছুটি শেষ।খুলনায় ফিরতে হবে।নিজের ঘরের আলমাড়ি খুলে দেখল অনেকগুলো গয়নার বাক্স থরে থরে সাজানো।রিয়ার গয়না। কোনটায় বিয়ের দিন যেগুলো পরেছিল,সেগুলো।কোনটা শাশুড়ির দেয়া উপহার,কোনটা আবার আত্নীয়দের দেয়া। ডায়মন্ডের একটা আংটি রোহান নিজে পছন্দ করে এনেছিল এঙ্গেজমেন্টের জন্য।সেটাও রয়েছে একটি বাক্সে।কিছুই নেয়নি সে।চলে যাবার আগে মায়ের হাতে সংসার খরচের টাকা দিতে গিয়ে জানল,এত টাকা সংসারে খরচ হয় না।যা পাঠায় তার অর্ধেক বেঁচে যায়।রোহান অবাক হয়ে তার মাকে জিজ্ঞেস করল,কি করে এত টাকা বাঁচে, রিয়া টাকা নেয় কিনা। তার মা জানালেন,রিয়া এখান থেকে কোনদিন এক টাকাও নেয়নি। রোহান অবাক হয়ে ভাবল, তার রিয়াকে সে যেমন চিনত,তেমনি আছে।এতটুকু বদলায়নি।অর্থাৎ টাকা পয়সার লোভে রোহানকে সে বিয়ে করেনি।বরং নিজের প্রয়োজনীয় অর্থ নিজেই রোজগার করে নিয়েছে।
.
রিয়া চলে এল হোস্টেলে। ছুটি শেষ করে রোহান চলে গেল খুলনায়।তবে নিয়মিত ফোন করে রিয়ার খোঁজখবর নেয়। রোহানের ফোনে তার মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে।মাঝে মাঝে ফোনটা কেটে দেয়।কোন বাঁধনেই আর নিজেকে জড়াতে চায় না সে।নিয়মিত অফিস করে,রুমে ফিরে বিশ্রাম,খাওয়া দাওয়া,অতপর ঘুম।এভাবেই কেটে যাচ্ছে তার দিনগুলাে।তেমনি একদিন অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যাবেলা বিশ্রাম নিচ্ছিল রিয়া।এমন সময় রোহান ফোন করে।সে একটু বিরক্ত হলেও ফোনটা ধরে।
.
“হ্যালো”
”বলুন,শুনতে পাচ্ছি। ”
“কি করছ?”
“বিশ্রাম নিচ্ছি, পরে কথা হবে।”
.
লাইনটা কেটে দিয়ে ভাবতে লাগল,এই মানুষটার সাথে আজ তার কতশত মাইলের দূরত্ব।অথচ একদিন সেই সবচেয়ে আপন হবার কথা ছিল।এই সন্ধ্যাবেলা চা হাতে করে বারান্দায় বসে গল্প হতে পারত,কিংবা দুজনে মাঝরাতে ছাদে এসে জোছনা মাখতে পারত।দুহাত ধরে হেঁটে যেতে পারত বহু পথ।কিন্তু তা আর হল কই?আজকাল রোহানের প্রতি তার বিন্দুমাত্র ভালবাসা জাগে না।তার সকল আচরণ খুব আদিক্ষেতা মনে হয়।কোন কিছুতেই আর বিশ্বাস লাগে না। খালি মনে হয় আজ তাকে গলায় মালা দিয়ে ডেকে নিচ্ছে তো কাল দেবে গলাধাক্কা, সকলি তার হাতে।বাড়ি যার,জোর তার।রিয়ারও একটা বাড়ি চাই।যেখান থেকে কেউ তাকে চলে যেতে বলবে না,একেবারে নিজস্ব একটা বাড়ি। এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা আবার বেজে উঠে।তাকিয়ে দেখে রোহান।
.
“বলুন,আবার কী চাই?”
“একদিন দেখা করতে পারবে?জরুরী দরকার ছিল।”
“কি দরকার এখানেই বলুন।”
“দেখা করেই বলতে হবে।প্লিজ”
“আচ্ছা”
.
কেন দেখা করতে রাজি হল,তা রিয়া নিজেই ভেবে পায় না। অনিচ্ছা সত্বেও দিন তারিখ ঠিক করে একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করল।রোহানের মুখের দিকে তাকিয়ে রিয়া অবাক হয়ে গেল।তাকে প্রথম যেদিন দেখেছিল সেদিন মনে হয়েছিল স্মার্ট,সুদর্শন,লম্বা ইত্যাদি যে কোন প্রশংসাই তার জন্যে কম হয়ে যায়।আর আজ দেখছে কংকালসার, চোখ গর্তে বসে যাওয়া, ক্লান্তিতে ধুকে ধুকে ক্ষয়ে পরা এক রোহানকে।মাত্র একমাসে তার এই অবস্থা,নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না রিয়া।কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েই রইল।অতপর বলল,
“কি যেন বলবেন।”
“ও হ্যাঁ, কোনভাবেই তোমার সিদ্ধান্তটা ফেরানো যায় না রিয়া?”
“সে আর সম্ভব নয়। আপনি এবার নিজের পছন্দমত কাওকে বেছে নিন।দেখবেন এবার যা হবে ভালই হবে।আর আমার দ্বারা সংসার হবে না”
“সেটাইতো নিয়েছিলাম।”
“মানে?”
“তোমাকেই তো বেছে নিয়েছিলাম।”
“সেটাতো ঘটকের আর পরিবারের পছন্দে। এবার নিজের পছন্দটাকে প্রাধান্য দিন”
“তুমি ভুল করছ।”
“কি রকম?”
“তোমাকে নিজের পছন্দেই খুঁজে নিয়েছিলাম।বিশ্বাস করবে কিনা জানি না,জীবনে যদি কাওকে ভালবেসে থাকি সেটা তুমিই। জানি বিশ্বাস করবে না।”
.
রিয়া সত্যিই কিছু বিশ্বাস করে নি।বরং ওঠার জন্য অস্থির হয়ে গেল।কিন্তু রোহান আজ পুরোটা না বলে তাকে ছাড়বে না।
“আজ আমার সব কথা তোমাকে শুনতে হবে।আর লুকিয়ে রাখতে পারছি না।”
“একটু জলদি বলুন।তা ছাড়া আমি আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“তোমার মনে পড়ে,তোমাদের কলেজের পাশে এক পুড়িওয়ালা বসত?তোমরা ঝাঁক বেঁধে এসে সেখান থেকে পুড়ি কিনতে?”
“হুম”
“সেখানেই তোমাকে প্রথম দেখি।”
“তো?”
“দেখলাম,তোমরা দল বেঁধে এলে,পুড়ি কিনে নিয়ে চলে গেলে।কিছুক্ষন পর আবার সেই দলবল নিয়ে ফিরে এলে।এসে তুমি বললে,’মামা,আমার প্যাকেটে পুড়ি একটা বেশি গেছে।আমি তিনটার টাকা দিয়েছি,আপনি চারটা দিয়েছেন।’লোকটা চেক করে দেখল একটা বেশি আছে।সেটা ফেরত নিল।তারপর তোমরা চলে গেলে।আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম।দোকানদার আমার বন্ধুর সাথে আলাপ করছিল যে দুনিয়াতে এখনো সৎ লোক আছে বলেই দুনিয়াটা টিকে আছে।আমিও খেয়াল করলাম,সত্যিতো।তার পর থেকেই কেবল তোমার কথা মনে হত।ভাবতাম,বিয়ে যদি করতে হয়,তোমাকেই করব।কত খুঁজেছি তোমাকে।অবশেষে তুমি আর চাকরি দুটো একই সাথে মিলে গেল।এভাবেই তোমাকে চেনা এবং ঘটক পাঠিয়ে তোমার বাড়িতে প্রস্তাব দেয়া।বিশ্বাস করো,সত্যিই আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।কিন্তু হঠাৎ আমার বন্ধুদের মুখে তোমার নামে এসব নোংড়া কথা শুনে মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না।মনে হচ্ছিল অামি এভাবে ডস খেলাম,এভাবে হেরে গেলাম।?তাহলে কি পৃথিবীতে আর একটাও ভাল মানুষ নেই?সবাই চীটার?আমি আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। কেন যে তোমার সাথে এমন করে ফেললাম,জানি না।”
সব শুনে রিয়া বলল,
“থাক না ওসব কথা।তা ছাড়া দেখুন সন্ধ্যে হয়ে গেছে।অন্ধকার হয়ে এলে মুশকিল হবে।”
রোহান চারদিকে তাকিয়ে দেখে সত্যিই অন্ধকার হয়ে এসেছে।সে বলল,
“চিন্তা করোনা,আমি তোমাকে পৌঁছে দেব।”
“তার দরকার হবে না।আমি একাই যেতে পারব।”
“সব কিছুতে জেদ করো না রিয়া।আমাকে কষ্ট দিচ্ছ, ঠিক আছে দাও।কিন্তু এমন কিছু করে বসোনা যেন নিজেরি ক্ষতি হয়।চল আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”
“লাগবে না”
এই বলে রিয়া হাঁটা শুরু করল।বাহিরে সত্যিই খুব অন্ধকার।তার ভেতরে কেমন একটা ভয় ভয় করছে।তারপরো হাঁটছে।রোহান তার পিছু নিল।এরকম অবেলায় রিয়াকে সে কিছুতেই একলা ছাড়বে না।হাঁটতে হাঁটতে রিয়ার কাছে গেল এবং একটা রিকশা নিল।রিয়া ভেবে দেখল এই ঘুটঘুটে অন্ধকার গলিটা সত্যিই তার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।তাই রোহানকে সে আর রিকশায় উঠতে বাঁধা দিল না।তবে দুজন সিটের দু’প্রান্তে বসল,মাঝখানে সেই হাজার মাইলের ব্যবধান।যখন তারা হোস্টেলের গেইটে পৌঁছল,তখন রাত নটার বেশি বেজে গেছে।সেখানকার কড়া নির্দেশ রাত নটার পর কোন মেয়ে বাইরে থাকতে পারবে না।যদি নটার পর কেউ ফেরে তাকে আর ঢুকতে দেয়া হবে না।এবার রিয়া পরল বিপদে।এখন সে কোথায় যাবে? যাওয়ার কোন জায়গা নেই বলেইতো এই হোস্টেলে উঠেছিল।এখন তবে কি হবে?রিয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল।
.
চলবে…….
২০টি মন্তব্য
ইঞ্জা
মুগ্ধ হয়ে পড়ছি, রিয়া রোহানের টানাপোড়ন খারাপ না, চলুক আমরাও থাকি অপেক্ষায়।
নীরা সাদীয়া
পাশে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।পরের পর্ব দেয়া হয়েছে। আমন্ত্রন রইল। শুভরাত।
ইঞ্জা
পড়ে ফেলেছি আর কমেন্টো দেওয়া হয়েছে, দেখুন।
নীরা সাদীয়া
দেখেছি। ধন্যবাদ। শুভরাত।
আবু জাঈদ
বাহ! প্রেম টা গাঢ় হোক, আছি রোহানের পাশে, গেট বন্ধের ব্যাপার টা দারুণ লাগছে
নীরা সাদীয়া
মেয়েদের হোস্টেলের এমনিরনিয়ম। পাশে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।পরের পর্ব দেয়া হয়েছে। আমন্ত্রন রইল। শুভরাত।
আবু খায়ের আনিছ
আগ্রহ ধরে রেখেছেন এখনো। আমি হলে এতদিনে খতম হয়ে যেতাম। বেশ লিখছেন, চলুক।
নীরা সাদীয়া
পাশে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।পরের পর্ব দেয়া হয়েছে। আমন্ত্রন রইল। শুভরাত।
নীলাঞ্জনা নীলা
রোহান আরোও জ্বলুক-পুড়ুক। রিয়ার মন আরোও কঠিন হোক, এটাই চাই।
গেট বন্ধ নিয়ে আমিও একবার কি যে বিপদে পড়েছিলাম!
নীরা সাদীয়া
আপনার চাওয়া পূরণ হোক,সেই কামনা। পাশে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।পরের পর্ব দেয়া হয়েছে। আমন্ত্রন রইল। শুভরাত।
মৌনতা রিতু
এখন এসব ঢং এর কথা রিয়ার না শোনাই ভাল। দেখা করাই ঠিক হয়নি। কিন্তু ঐ যে মেয়েদের মন, অজানা টান।
এখন যে কি হয় তাই ভাবছি।
নীরা সাদীয়া
ঠিক বলেছেন। মেয়েদের মন বলে কথা! পাশে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।পরের পর্ব দেয়া হয়েছে। আমন্ত্রন রইল। শুভরাত।
লীলাবতী
নিয়মিত পড়ছি আপনার লেখা। ভালই লিখছেন। কেন জানি মনে হচ্ছে গল্পে দুজনার মিল হয়ে যাবে। এ ধরনের পুরুষদের শাস্তি দেয়া দরকার। কোনো ক্রমেই নমনীয় হওয়া উচিৎ না।
নীরা সাদীয়া
দেখা যাক কী ঘটে। তবে কেউ তার ভুল বুঝতে পারলে তাকে ক্ষমা করা উচিত। কি বলেন? পাশে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।পরের পর্ব দেয়া হয়েছে। আমন্ত্রন রইল। শুভরাত।
লীলাবতী
সে যে আবার ভুল করবেনা তার নিশ্চয়তা কি?
নীরা সাদীয়া
সেরকম একটা ব্যবস্থা অবশ্যই করে নিতে হবে। মানুষের জীবনটাই তো ভুলে ভরা, ফাঁকা ফাঁকা।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
সবগুলো পর্বই পড়েছি, সবখানে মন্তব্য করা সম্ভব হয়নি।
ভাল লাগছে। লিখে যান।
নীরা সাদীয়া
পাশে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।পরের পর্ব দেয়া হয়েছে। আমন্ত্রন রইল। শুভরাত।
ফারহানা নুসরাত
আসলে সম্পর্কের সুতো একবার ছিঁড়ে গেলে আগের গাঁথুনি আর পাওয়া যায়না। রিয়া রোহান এক হয়ে গেলেও অতীতের স্মৃতি রিয়ার পিছু ছাড়বেনা।
নীরা সাদীয়া
ঠিক বলেছেন আপু। তাই রিয়া-রোহানের উচিত একটি উপযুক্ত সমাধানে আসা। পাশে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।পরের পর্ব দেয়া হয়েছে। আমন্ত্রন রইল। শুভরাত।