এই সময় আবুল হাশিম সাহেব মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে একটা নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করেন এবং নতুনভাবে যুক্তিতর্ক দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করতেন যে পাকিস্তান দাবি হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দু মুসলমানদের মিলানোর জন্য এবং দুই ভাই যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সুখে বাস করতে পারে তারই জন্য। তিনি আমাদের কিছু সংখ্যক কর্মীকে বেছে নিয়েছিলেন, তাদের নিয়ে রাতে আলোচনা সভা করতেন মুসলিম লীগ অফিসে। হাশিম সাহেব পূর্বে বর্ধমানে থাকতেন, সেখান থেকে মুসলিম লীগ অফিসে একটা রুমে এসে থাকতেন, কলকাতায় আসলে। মুসলিম লীগ অফিসটা শহীদ সাহেব ভাড়া নিয়েছিলেন। তাঁকেই ভাড়া দিতে হয়েছে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। হাশিম সাহেব আমাদের বললেন, একটা লাইব্রেরি করতে হবে, তোমাদের লেখাপড়া করতে হবে। শুধু হিন্দুদের গালাগালি করলে পাকিস্তান আসবে না। আমি ছিলাম শহীদ সাহেবের ভক্ত। হাশিম সাহেবও শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলেন বলে আমিও তাঁকে শ্রদ্ধা করতাম, তাঁর হুকুম মানতাম। হাশিম সাহেবও শহীদ সাহেবের হুকুম ছাড়া কিছু করতেন না। মুসলিম লীগের ফাণ্ড ও অর্থ মানে শহীদ সাহেবের পকেট। টাকা পয়সা তাঁকেই জোগাড় করতে হত। সে সম্বন্ধে পরে আলোচনা করব। হাশিম সাহেব বলতেন, মুসলিম লীগকে প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে। গ্রাম থেকে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। উপরের তলার প্রতিষ্ঠান করলে চলবে না। জমিদারদের পকেট থেকে প্রতিষ্ঠানকে বের করতে হবে। তিনি শহীদ সাহেবের সাথে পরামর্শ করে সমস্ত বাংলাদেশ ঘুরতে আরম্ভ করলেন। চমৎকার বক্তৃতা করতেন। ভাষার উপর দখল ছিল। ইংরেজি বাংলা দুই ভাষায় বক্তৃতা করতে পারতেন সুন্দরভাবে।
এই সময় ছাত্রদের মধ্যে বেশ শক্তিশালী দুইটা দল সৃষ্টি হল। আমি কলকাতায় এসেই খবর পেলাম, আমাদের দিল্লি যেতে হবে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সম্মেলনে’ যোগদান করতে। তোড়জোড় পড়ে গেল। যাঁরা যাবেন নিজের টাকায়ই যেতে হবে। আনোয়ার হোসেন সাহেব তাঁর দলবল থেকে কয়েকজনকে নিলেন। টাকাও বোধহয় জোগাড় করলেন। আমি ও ইসলামিয়া কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি মীর আশরাফউদ্দিন ঠিক করলাম, আমরাও যাব আমাদের নিজের টাকায়। আমাদের পূর্বেই ডেলিগেট করা হয়েছিল। মীর আশরাফউদ্দিন ওরফে মাখন, বাড়ি ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জ মহকুমার কাজী কসবা গ্রামে। আমার খালাতো বোনের ছেলে, ওর বাবা-মা ছোটবেলায় মারা গেছেন। যথেষ্ট টাকা রেখে গেছেন। ওর বাবা তখনকার দিনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। শহীদ সাহেবকে বললাম, “আমরা দিল্লি কনফারেন্সে যোগদান করব।” তিনি বললেন, “খুব ভাল, দেখতে পারবে সমস্ত ভারতবরষের মুসলমান নেতাদের।” আমরা দুইজন ও আনোয়ার সাহেবের দলের কয়েকজন একই ট্রেনে ভিন্ন ভিন্ন গাড়ীতে রওয়ানা করলাম। তাদের সাথে আমাদের মিল নাই। দুই মামু-ভাগ্নের যা খরচ লাগবে দিল্লিতে তা কোনোমতে বন্দোবস্ত করে নিলাম। টাকার বেশি প্রয়োজন হলে আমি আমার বোনের কাছ থেকে আনতাম। বোন আব্বার কাছ থেকে নিত। আব্বা বলে দিয়েছিলেন তাকে, আমার দরকার হলে টাকা দিতে। আব্বা ছাড়াও মায়ের কাছ থেকেও আমি টাকা নিতে পারতাম। আর সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনোদিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামের বাড়িতে থাকত, আমার জন্যই রাখত।
হাওড়া থেকে আমরা দিল্লিতে রওয়ানা করলাম। এই প্রথমবার আমি বাংলাদেশের বাইরে রওয়ানা করলাম। দিল্লি দেখার একটা প্রবল আগ্রহ আমার ছিল। ইতিহাসে পড়েছি, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে শুনেছি, তাই দিল্লির লালকেল্লা, জামে মসজিদ, কুতুব মিনার ও অন্যান্য ঐতিহাসিক জায়গাগুলো দেখতে হবে। নিজামউদ্দিন আওলিয়ার দরগায় যাব। আমরা দিল্লি পৌঁছালে মুসলিম সেচ্ছাসেবক দল আমাদের পৌঁছে দিল এংলো এরাবিয়ান কলেজ প্রাঙ্গণে। সেখানে আমাদের জন্য তাঁবু করা হয়েছে। তাঁবুতে আমরা দুইজন ছাড়াও আলীগড়ের একজন ছাত্র এবং আরেকজন বোধহয় এলাহাবাদ বা অন্য কোথাকার হবে। আনোয়ার সাহেবের দলবল অন্য একটা তাঁবুতে রইলেন। বিরাট প্যান্ডেল করা হয়েছে। আমরা ডেলিগেট কার্ড নিয়ে সভায় উপস্থিত হলাম। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের জন্য আলাদা জায়গা রাখা হয়েছে। প্রথমদিন কনফারেন্স হয়ে যাওয়ার পরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে হাতির পিঠে নিয়ে এক বিরাট শোভাযাত্রা বের হল। আমরাও সাথে সাথে রইলাম। লোকে লোকারণ্য, রাস্তায় রাস্তায় পানি খাওয়ার বন্দোবস্ত রেখেছে। বোধহয় এই সময় পানি না রাখলে বহু লোক মারা যেত। দিল্লির পুরানা শহর আমরা ঘুরে বিকালে ফিরে এলাম। রাতে আবার কনফারেন্স শুরু হল। এই সময়কার একজনের কথা আজও আমি ভুলতে পারি না। উর্দুতে তিন ঘন্টা বক্তৃতা করলেন। যেমন গলা, তেমনই বলার ভঙ্গি। উর্দু ভাল বুঝতাম না। কলকাতার উর্দু একটু বুঝলেও এ উর্দু বোঝা আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর। বক্তৃতা করেছিলেন নবাব ইয়ার জং বাহাদুর। তিনি হায়দ্রাবাদের লোক ছিলেন। স্টেট মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। তাঁর বক্তৃতা না বুঝলেও সভা ছেড়ে উঠে আসা কষ্টকর ছিল।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং- ২৪ ও ২৫)
২২টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
সহজ সরল বর্ণনার মাঝে ইতিহাসকে জানছি
পাকিস্তান সৃষ্টিতে আমাদের পরিচিত জাতীয় নেতাদের ভুমিকা জানা যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
নিজের টাকা খরচ করে রাজনীতি করা বর্তমানে কল্পনাই করা যায় না……
ধন্যবাদ আর আপনাকে দেবো না, আপনি এর উর্ধ্বে উঠে গিয়েছেন।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
এমন করে বলবেন না। আমার স্বউদ্যোগে হাতে নেয়া কর্মটি আপনাদের উৎসাহ উদ্দীপনায় ধীরেধীরে এগিয়ে যাচ্ছে, ভাবতেই ভালো লাগছে। মাত্র তো ২৫ নম্বর পেজে আছি। তবে হবে, আস্তে আস্তে শেষ হবে।
হ্যাঁ, সেদিন শনিবার রাস্তায় বের হয়েছি, দেখি বেশ কয়েকটা গাড়ীতে মাইকে চিল্লাপাল্লা করে যুবকরা যাচ্ছে, গাড়ী খুব একটা ভরা না। পরে মনে পড়লো জাতীয় পার্টির সম্মেলন ছিলো। আমার তখন একথাই মনে পড়লো। আর ভাবলাম আগে রাজনীতি মানুষ মানুষের জন্য করতো নিজের পয়সা খরচ করে আর এখন করে পয়সা কামানোর জন্য।
মৌনতা রিতু
মারজানা আপু, তুমি এতো ধৈর্য্য নিয়ে এই সিরিয়ালটি লিখে যাচ্ছ। অভিনন্দন জানাই তোমাকে। আমার সংগ্রহে কিছু বই আছে। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের বেড়াতে গেছিলাম গত ডিসেম্বরে, তুমি অবাক হবে নতুন প্রজন্মের বাচ্চাদের অনুভূতিগুলো দেখে। ওখানকার ম্যানেজার সত্যজিৎ দাদা আমার দুই ছেলেকে ছবিসহ কিছু বই দিয়েছিল উপহার সরুপ। আমার খুব সখ জান আপু, অনেক বড় একটা লাইব্রেরী করব। যখন আমি একা থাকি, বা যে সময়টাতে আমার মন খারাপ হয়, আমি হালকা মৃদুসুরে গান ছেড়ে লাইব্রেরী রুমটাতে বসে থাকি। কি যে এক স্বর্গীয় আনন্দে মনটা ভরে যায় বোঝাতে পারব না।
তুমি ভাল থেকো।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
তোমার এই মৃদুসুরে গান ছেড়ে লাইব্রেরীতে নিরিবিলিতে বসাটা আমার দারুন পছন্দ হয়েছে।
হ্যাঁ, আজকালকার বাচ্চাগুলো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অনেক জানতে চায়।
ধন্যবাদ তোমাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য।
লীলাবতী
যতই পড়ছি ততই জাতির পিতা সম্পর্কে জানছি। কত সাধারণ ভাবে নিজের কথা বলেছেন। রাজনীতির জন্য টাকা দিতেন বাবা মা স্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর মাতা পিতা এবং স্ত্রী উৎসাহ না দিলে আমরা হয়ত এমন নেতা পেতাম না। সবার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
ধন্যবাদ আপনাকে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে প্রতি সপ্তাহে একটি পোষ্ট দিচ্ছেন -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
যেকোন কাজে পরিবারের উৎসাহ মানুষকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর লিখা থেকেও তাই ফুটে উঠেছে।
তোমরা পাশে আছো তাই ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে না সেজন্যে তোমাদেরও ধন্যবাদ।
ইনজা
অনেক কিছুই জানতে পারলাম আজ, আশা করি আপনার এই লেখা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা পড়ে অনেক উপকৃত হবে, তারা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে প্রায় অনেক কিছুই জানেনা আর তাদের জানানো আমাদেরই উচিৎ।
ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর এই পোষ্টের জন্য।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সেই আশা নিয়েই কষ্ট করে পর্ব আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত। এই বইটি এমন একটি বই, এটি পড়ার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে পারলে বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক গুণাবলী মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করবেই।
আর পর্ব আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত মুলত যাতে মানুষ পুরু বইটি না পড়লেও অল্প কিছু হলেও পড়ে। বইবিমুখ বাঙালী বড় বই বলে বইটি হাতে নিতে চাইবে না। এখানে যতোটুকুন পড়বে ততোটুকুনও যদি প্রভাবিত হয়, তাই জাতির উপকারে আসবে।
ব্লগার সজীব
আপনার এই ধারাবাহিক লেখাটি সোনেলার জন্য অবশ্যই একটি সম্পদ বলে বিবেচিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। অনলাইনে পিডিএফ আকারে এই বইটি পাওয়া গেলেও, এমনি লেখায় প্রকাশ সম্ভবত এই প্রথম। ধন্যবাদ আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
এমনি লেখার মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে অল্প অল্প করে মানুষের মননে তা রোপণ করা। পাশাপাশি সারাটা না পড়ুক, কেউ যদি ১০/১২টি পর্বও পড়ে তবে কিছুটা হলেও তা তার মনের উপর প্রভাব বিস্তার করবে, সে আশা নিয়েই এই প্রকাশ।
খসড়া
ধন্যবাদ
মারজানা ফেরদৌস রুবা
-{@
আর্বনীল
বেশ ইন্টারেস্টিং… সময় নিয়ে প্রথম পর্ব থেকে আবার পড়ার আগ্রহ জন্মেগেছে…
আপনার লেখার হাতও বেশ…
চলুক…।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ। চলুক তবে…
নীলাঞ্জনা নীলা
ইতিহাস তুলে আনা বহু কষ্টের। আপনি সেটাই করছেন। অসংখ্য ধন্যবাদ।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সর্বদা পাশে থাকার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
স্বপ্ন
বইটি পড়া হয়নি পূর্বে। সোনেলায় পড়ার সুযোগ পাচ্ছি আপনার কল্যাণে। ধন্যবাদ আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
পড়ার সুযোগ করে দিতে পারার জন্য আমিও আনন্দিত।
অনিকেত নন্দিনী
পড়ছি আর জানছি অনেক অজানারে। 🙂
ধন্যবাদ আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হ্যাঁ, এ বইটি থেকে অনেক অজানাকে জানার সুযোগ আছে।
শুভ্র রফিক
যতই পড়ছি, ততই মজা পাচ্ছি।কত অজানা বিষয় জানতে পারছি।ধন্যবাদ সোনেলাকে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ভালো লাগছে আপনারা পড়ছেন। কাছেপিঠে অন্যদেরও উৎসাহিত করুন, তাহলেই সোনেলা’র এই ধারাবাহিক প্রকাশ সার্থকতা পাবে।