কবে থেকে মা’কে আঁকড়ে পথ চলা শুরু হয়েছে ঠিক খেয়াল নেই। মা’কে কেন্দ্র করেই সকল দুর্বলতা ঘিরে ধরেছিলো আমায়। একটা সময় উপলব্ধি করতে শুরু করলাম, মা-বাবারা সন্তান লালনপালনে কতো কষ্ট করেন অথচ আমরা কি সেরকম তাঁদের প্রতিদান দিতে পারি? মনের এই টানাপোড়ন থেকে কখন যেনো মায়ের ব্যাপারে স্পর্শকাতর হয়ে উঠি। সময়ের পথ বেয়ে একসময় মায়ের অসুস্থতা বাড়তে থাকলে নিজের কাছে নিয়ে আসার সুযোগ তৈরি হয়। সেটা অবশ্যই আমার সৌভাগ্য ছিলো। আর তখন থেকে আমি উপলব্ধি করতে লাগলাম, বয়সকালে মায়েদের মেয়েদের সংস্পর্শে থাকা উচিৎ।

আমি যেমন একজন মায়ের সন্তান, তেমনি আরেকজন মায়ের ছেলেবউ। মা-শাশুড়িমা, দুজনকেই আমি তাঁদের শেষ সময়ের দুঃসময়ে নিজের কাছে পেয়েছি। আর তা বিশ্লেষণ করেই আমার ব্যক্তিগত মতামত, জীবনের শেষ সময়ের দুঃসহ মুহূর্তগুলোতে কোন না কোন মেয়ের মায়ের কাছে থাকা উচিৎ বা মা’কে নিজের কাছে নেয়া উচিৎ। সন্তান যেমন মায়ের কোলেই সর্বাপেক্ষা ভালো থাকে, তেমনি বয়সের ভারে আস্তে আস্তে অবুঝ শিশুতুল্য মা’ও মেয়ের সংস্পর্শেই ভালো থাকেন। নাড়ির সম্পর্ক বলে একটা কথা আছে, সে সম্পর্কগুনেই ব্যাপারটা তেমন দাঁড়ায়। আমার লেখা থেকে অনেকেই মনে করতে পারেন ছেলেবউরা বোধহয় সেরকম দায়িত্ব নেয় না, বা ছেলেবউরা কেয়ারিং ভালো করে না, তাই এমনটা বলছি। আসলে ব্যাপারটা সেরকম নয়। এই যেমন আমার মায়ের ক্ষেত্রে, মা’র খাবারের মেনুতে প্রোটিন নিষিদ্ধ ছিলো, ফলে মাছ-মাংস দেয়া যেতো না। আম্মা মাছ খেতে চাইলেও দিতাম না বা দিলেও নামে মাত্র। খুব মন খারাপ করতেন। কিন্তু একাজটি ছেলেবউ করলে বয়সী অবুঝ মায়ের মনে হতো, আমাকে খেতে দেয় না। আর পাড়া-পড়শী তো আছেই, গসিপ তখন মুখেমুখে। অন্যদিকে মা বিছানায় শয্যাশায়ী, প্রশ্রাব-পায়খানা সব বিছানাতেই। এক্ষেত্রেও মেয়ে যতোটা সহনশীল থাকবে, ছেলেবউ ধৈর্যহীন হয়ে উঠতেই পারে। আরো কিছু টেকনিক্যাল বিষয় আছে, যা থেকে আমি বলবো এ দায়িত্বটা মেয়েদেরই নেয়া উচিৎ। সর্বোপরি, জন্মঋণ বলে একটা কথা আছে, সেটা মেয়ের উপরই বর্তায়, ছেলেবউয়ের উপরে নয়।

আমার ক্যান্সার আক্রান্ত শ্বাশুড়ীকে একসময় মুখে একটা ঔষধ দিতে হতো, যা তিনি কিছুতেই দিতে চাইতেন না মুখ জ্বলে যায় বলে। আমি তাঁর উপর জোর খাটাতে পারতাম না। পরবর্তীতে মেয়ে আসার পর (আমরাই খবর দিয়ে আনিয়েছি) সে আচমকা মুখ চেপে ধরে ঔষধ লাগিয়ে দিতো। কতোক্ষণ ছটফট করতেন, তারপর স্বাভাবিক। আমি অই আচমকা কাজটা করতে পারতাম না, পাছে তাঁর মনে হয় আমি ব্যথা দিয়েছি!

এইসব বিভিন্ন কারনেই আমি মনে করি বয়সকালে মায়ের দেখাশুনার দায়িত্ব মেয়েদেরই নেয়া উচিৎ। হ্যাঁ, এক্ষেত্রে আরেকটি কথা আসতে পারে ছেলেও তো আছে। এ ব্যাপারে আমি বলবো, বিধাতা কিন্তু সেবার কৌশল আর ক্ষমতা মেয়েদেরকেই দিয়ে রেখেছেন। আমাদের পারিপার্শ্বিক সমাজব্যবস্থা এ ব্যাপারটাকে সহজভাবে দেখতে চায় না যদিও, কিন্তু যৌক্তিক বিবেচনায় মায়েদের নিয়ে আমাদের তেমন চিন্তাই করা উচিৎ। তাই আজকের ‘মা’ দিবসে সকল মেয়ের প্রতি আমার একটা অনুরোধ থাকবে, স্বার্থপরের মতো তোমরা দায় এড়িয়ে যাবে না। মা কিন্তু তোমাকে জন্ম দিয়েছে, ছেলেবউকে নয়। আর্থিক সাপোর্ট দেয়ার দায়িত্ব ছেলেদেরই থাকুক, কিন্তু সেবা-শুশ্রষার দায়ভার মেয়েরা, তোমরাই কাঁধে তুলে লও।

অনলাইনে বিচরণ শুরু হওয়ার পর ‘মা’ দিবস কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলেছে। যদিও মা’ ‘মাতৃত্ব’ ’মায়ের সন্মান’কে কোন দিবস বা দিনক্ষণ দিয়ে হিসাব চলে না। সারাবছরই মা অতুলনীয়; ‘মা’ এর মহিমাকে কখনোই দিবসকেন্দ্রিক করা যায় না। তবে দিবসকে কেন্দ্র করে আনন্দ-উচ্ছাস যদি তাঁদের মনকে পুলকিত করে তো মন্দ কি?

এবারই প্রথম ‘মা’ ছাড়া ‘মা’ দিবস আমার সামনে। মাত্র কদিন আগেই মা-হারা হয়েছি। এক ধরনের অস্থিরতা মাঝেমধ্যেই মনকে তাড়িয়ে বেড়ায়। চাইলেও বিষণ্ণতাকে দূর করা যাচ্ছেনা। মনটাকে ভালো রাখা যাচ্ছে না। তবুও আজ আমি লিখতে বসেছি বয়সের ভারে ন্যুব্জ মায়েদের জন্য। আমার আজকের লিখায় মেয়েদের প্রতি আহ্বান রইলো, মায়েদের শেষ দিনগুলোতে সেবা দেয়ার দায়িত্ব মেয়েরা তোমরা নিজের কাঁধে তুলে লও। মাতৃঋণ কোনভাবেই শোধযোগ্য নয়; তবুও চেষ্টা…

পৃথিবীর সকল ‘মা’ ভালো থাকুক। (3 (3 (3

৪৩৪জন ৪৩৪জন
0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ