আগেই বলেছি ইমন যেখানে, ঝামেলা সেখানে। প্রতি মাসের চার-পাঁচ তারিখে ইমনকে টাকা পাঠান মজিদ সাহেব। তার বোকা সোকা পিয়ন মনজু এপ্রিলের এক বিকেলে ইমনকে টাকা দিয়ে এসে মজিদ সাহেবকে যে তথ্য দিল তাতে রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন ব্যাপার। মজিদ সাহেব খুটিয়ে খুটিয়ে ভাতিজার খবর নিচ্ছিলেন। কথাবার্তার মাঝে তিনি জানতে পারলেন ইমন মনজুকে দামী হোটেলে ভাত খাইয়েছে। তিনজনে নয়শত টাকা খরচ। মজিদ সাহেব জুরিস প্রুডেন্স নিয়ে পড়াশুনা করা কৃতি ছাত্র। তার জেরা করা চরিত্র থাকাই স্বাভাবিক। তিনি তৃতীয় ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাইলেন এবং উত্তর পেয়ে ছোট্ট একটা ঢোক গিললেন।
কিছু মানুষ আছে যাদের আইকিউ সব সময় মাইনাসের দিকে থাকে, এরা বছরে দু’বার ছাতা হারিয়ে বৌয়ের বকা খায় মাঝে মধ্যে প্যান্টের চেইন আটকাতে ভুলে যায়। মনজু হচ্ছে সেই ধরনের মফিজ। হোটেলে ইমনের সাথে সুপ্রীতি নামের ভয়াবহ সুন্দরী একটা মেয়ে ছিলো স্যারকে এই তথ্যটা দেবার পাঁচ মিনিট পরই মনজুর মনে হলো বড্ড ভুল হয়ে গেছে। রাতে মজিদ সাহেবের এক ফোঁটা ঘুম হলো না।
পরের শুক্রবার তিনি নিজ কর্মস্থল ছেড়ে ঢাকার দিকে ছুটলেন। মজিদ সাহেব টিএসসি’র পাশে গাড়ির মধ্যে চুপচাপ বসে আছেন। চৈত্রের এই বউরী বাতাস বয়ে যাওয়া দিনে প্রেমিক-প্রেমিকার ঘরে বসে থাকার কথা না। টিএসসিতে ইমনকে না পেলে রমনা পার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যান, শিশুপার্ক সবখানে খুঁজে দেখবেন। মজিদ সাহেবকে কোথাও যেতে হলো না, একটু পরেই ইমন-সুপ্রীতিকে দেখা গেলো। মজিদ সাহেব নির্বাক হয়ে গেলেন।
পিয়ন মনজুর কাব্যশক্তি নেই তারপরও সে বলেছিলো, ‘মেয়েটা পাহা হোসার (পাকা শশার) মতো ধলা, খুব সোন্দর।’ সুপ্রীতি মধ্যযুগের কোনো কবির সামনে পড়লে কবি আলওয়ালী স্টাইলে বলে উঠতেন, ‘সুপ্রীতি দেবীর রূপ কি কহিমু মহারাজ, তুলনা দিবার নাহি ত্রিজগত মাঝ।’
শুভ্রশংখে আলতা পরা অনুভব। ঈশ্বর বিশ্বকর্মার রুচিবোধ আর মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর ধৈর্য্য নিয়ে সুপ্রীতিকে গড়েছেন। একটা জোছনা খণ্ডের মতো সুপ্রীতি তার পরিপার্শ্বকে আলোকিতো করে রেখেছে।
মজিদ সাহেব ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর মধ্যে আলাউদ্দিন খিলজিকে বেশ অপছন্দ করতেন। সুপ্রীতিকে দেখার পর তিনি বুঝতে পারলেন কেনো এই পুরুষ বার বার চিতোর আক্রমণ করতেন। সৌন্দর্যের সম্ভবত স্বকীয় দোষ আছে। রাণী পদ্মাবতীর সর্বনাশা রূপ হয়তো তাকে কিছুটা বাধ্য করতো চিতোর আক্রমণ করতে।
মজিদ সাহেব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ইমন নিজ চেষ্টায় মাসুম বিল্লাহ, টুণ্ডা হারুন কিংবা ইয়াবা সম্রাজ্ঞীর হাত থেকে বেঁচে গেছে। কিন্তু এই অপ্সরার মায়াবী জাল থেকে ভাতিজা কিভাবে বেড়িয়ে আসবে তিনি ভেবে ঠিক করতে পারলেন না।
অবশেষে ইমনকে একটা ভদ্র ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অষ্ট্রেলিয়া পাঠানো হলো। এতো ভালো ছাত্র হয়ে ইমন ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করবে না, এটা হতে পারে না। মজিদ সাহেব নিজে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গেলেন। এক রূপবতীর চোখের জল আর এক যুবকের বুক ভেঙে চুরমার হয়ে যাবার ব্যাপারটা তিনি আমলেই আনলেন না। রাক্ষস হৃদয় নিয়ে তিনি ইমনকে প্লেনে উঠিয়ে দিলেন।
সেই ইমন ড-এর সাথে ডটসহ দেশে আসছে। মজিদ সাহেব মনমরা হয়ে পড়লেন। তিনি গাছ লাগাতে মাদারীপুর গেলেন না। গত পরশু কেয়ারটেকার সরকার নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করেছে। ইমন দেশে আসছে রাজনীতির টানে নাকি সুপ্রীতির মায়ায় সে বিষয়ে ভাবতে ভাবতে ছুটির দু’দিন পার হয়ে গেলো। মজিদ সাহেব কর্মস্থলে ফিরে গেলেন।
দেশে আসার এক বিন্দু ইচ্ছে ছিলো না ইমনের কিন্তু পার্টি তাকে দেশের ফিরিয়ে আনার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। মাঠ গরম রাখতে তরুণ নেতৃত্ব প্রয়োজন। জনগণ মিথ্যাবাদী বুড়োদের খুব একটা পছন্দ করে না। ইমনদের মতো ছেলেরা হচ্ছে রাজনীতির টাটকা কাঁচামাল। পাতি নেতা-মাঝারি নেতা ইমনকে রাজী করাতে ব্যর্থ হলে মহাসচিব ব্যাপারটি দেখতে শুরু করেন।
বাংলাদেশে শরীরের কিছু কাঁচা থাকতে মহাসচিব হবার নিয়ম নেই। চোখের ওপরে ভুরু পেকে যাওয়া সম্ভবত মহাসচিব হবার একটি বিশেষ যোগ্যতা। মহাসচিব অতিকষ্টে তরুণ-তরুণী সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন। তার জড়িয়ে যাওয়া কথা শুনে মনে হবে এই মাত্র তিনি গাঁজার দু’তিন পুরিয়া মেরে এসেছেন। বুকের মাঝখানের হৃৎপিণ্ড, পিঠের দু’পাশের কিডনি পুরোপুরি বিকল হয়ে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে না পৌঁছানো পর্যন্ত পার্টির চেয়ারম্যান তাকে মহাসচিব হবার প্রয়াশ্চিত্ত করিয়ে ছাড়বেন।
এক সন্ধ্যায় মহাসচিব ইমনকে ফোন দেন।
: ‘বাবা (মহাসচিব তরুণদের বাবা বলে ডাকেন) তুমি চইলা আস। তোমরা দ্যাশে না থাকলে এই দ্যাশ চালাইব ক্যাঠা?’
একজন মহা সচিবের মুখে দ্যাশ, ক্যাঠা শব্দে ইমন কিছুটা বিব্রত, কিছুটা বিরক্ত হয়, সাংসদদের নরেন বিশ্বাসের উচ্চারণ সংক্রান্ত বইগুলো পড়া উচিত।
: আংকেল একটু ভেবে দেখি।
: কোনো ভাবাভাবি নাই বাবা। তোমরা দ্যাশে না থাকলে প্রতিবাদ করব কারা। অরা ষড়যন্ত্র কইরা ক্ষমতায় গ্যালে আমাগো টোকাইয়া টোকাইয়া জেলে ভরবো। জীবনে দ্যাশে ঢুকতে পারবা না।
: আমার চাকরি টা?
: ওইসব চাকরি ফাকরির চিন্তা ছাড়ো বাবা। চাকরি করনের লাইগা তোমাগো জন্ম হয় নাই। তোমরা দ্যাশের দায়িত্ব নিবা, তোমার এলাকায় তুমিই দাড়াইবা।’
: কিন্তু…
: কোনো কিন্তু মিন্তু শুনুম না। নেত্রীরে আমি বইলা রাখছি। তুমি আমার পোলা। পোলা হইয়া বাপের কথায় না কইরো না বাজান।
শেষ কথাগুলো বলার সময় মহাসচিব প্রায় কেঁদেই ফেললেন।
ইমন দেশে এসে মহাসচিব সাহেবের সাথে গভীরভাবে কোলাকুলি করে। এরপর নেত্রীর সাথে দেখা করে একটি উদ্যানের মাঝে কোলবালিশকে লাশ সাজিয়ে বানানো মাজার জিয়ারতে যায় সে। মনোনয়ন সাক্ষাতে মাত্র চার মিনিট সময় ব্যয় হয়। বিশ্ববিদ্যালয়, হাইকোর্ট, সেনাব্যারাক এবং সচিবালয় এই চার প্রতিষ্ঠান থেকে আসা প্রার্থীদের চার মিনিটের বেশি সময় নষ্ট করা লাগে না।
(চলবে)
আগের পর্বগুলোর লিংক :
নিছক গল্প-১
http://sonelablog.com/archives/3193
নিছক গল্প-২
http://sonelablog.com/archives/3229
নিছক গল্প-৩
http://sonelablog.com/archives/3286
১৯টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
যাক অবশেষে গল্প ট্রাক লাইনে উঠেছে ।
চলুক , আছি অপেক্ষায় ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ ভাই, সাথে থাইকেন
বনলতা সেন
লিংক দিয়ে ভাল হয়েছে ।
দেখুন ইমনের কিছু হলে জ্বলবে ধুয়া যখন তখন ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ আপ্পি
সাতকাহন
জ্বি আপ্পি আপনি থাকতে আর কোনো চিন্তা নাই
জিসান শা ইকরাম
দারুন লেখা
বাস্তবতার স্পর্শ
জাতীয় পার্টির মহাসচিব কিন্তু বুড়া নয় হ্যাভি স্মার্ট 🙂
অঃকঃ লেখার লিংক দেয়া সোনেলায় আরো সহজ 🙂
আপনার লেখার পেইজে গিয়ে শুধু লেখার শিরোনাম কপি করুণ , আর পেস্ট করুণ নির্দিষ্ট স্থানে । লিংক পেস্ট হয়ে যাবে 🙂
যেমন শিরোনাম > নিছক গল্প-১
সাতকাহন
ইমন যখন নির্বাচন করেন, তখন বুড়ো মহাশয় পার্টির মহাসচিব ছিলেন, আর এখানে জাতীয় পার্টির কথা বলা হয়নি। যে পার্টির কথা বলা হয়েছে সেটা একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন। আর ওই বুড়ো মহাশয় কে সেটা আপনি ধরতে পারছেন। আর ইমন এখন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষক। আর আমি নিজে ওর ছোটো ভাইয়ের বন্ধু।
জিসান শা ইকরাম
বুঝেছি একবারেই
জাতীয় পার্টির কথা এনেছি ফান করে 🙂
শিশির কনা
আমাদের নেতারা এমনিই শেষ করে দেন যুবাদের ।
সাতকাহন
এটাই বাস্তবতা
প্রজন্ম ৭১
জমছে কাহিনি । ভালো লাগছে (y) (y)
সাতকাহন
ধন্যবাদ আপনাকে
যাযাবর
সত্যির মত করে লিখতে পারেন আপনি ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ ভাই
ব্লগার সজীব
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম ভাই (y) (y)
হতভাগ্য কবি
(y) (y)