সুভাষের প্রতিবাদের ফল পাওয়া গেলো অচিরেই। অবিভক্ত ভারতের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য তালিকা থেকে মহাত্মা গান্ধীর একক সিদ্ধান্তে বাতিল করা হলো সুভাষের নাম। মহাত্মা গান্ধীর ভাষায়, ‘যারা এক মতের মানুষ, একমাত্র তাদেরই ওয়ার্কিং কমিটিতে থাকা উচিত।’ সঙ্গে সঙ্গে সুভাষ অধিবেশন ছেড়ে বেরিয়ে এলেন তাঁর বাষট্টিজন সহকর্মী নিয়ে। সুভাষ বললেন:
‘আবেদন নিবেদনে কোনোদিনও স্বাধীনতা আসে না। প্রেম-ভালোবাসা বিলিয়ে কোনোদিনও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়।’[২৩]
১৯২৯ সালের আগস্ট মাসে নিখিল-ভারত লাঞ্ছিত রাজনৈতিক দিবস উপলক্ষে সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে সুভাষ সেই সময়ের সর্ববৃহত শোভাযাত্রা পরিচালনা করেন। এর ফলে নয় মাস তাঁর স্বশ্রম কারাদণ্ড হয়।
সরকারকে মহাত্মা গান্ধীর বেঁধে দেয়া সময় ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়ে গেলো। কোথায় স্বাধীনতা! মহাত্মা গান্ধীর কাছে কোনো উত্তর এলো না বড়লাট আরউইনের পক্ষ থেকে। বড়লাটের উদ্দেশ্যে ১৯৩০ সালের ৫ জানুয়ারি আবেদন জানালেন মহাত্মা গান্ধী, আবেদনে তিনি উল্লেখ করলেন:
‘আমি নতজানু হয়ে রুটি চেয়েছিলাম, পেলাম শুধু পাথর। সুতরাং একটিমাত্র পথই আমার সামনে খোলা আছে, সেই পথটি হলো আইন অমান্য আন্দোলন। …কিন্তু জেনে রাখুন, আমার পিছনে হাজার হাজার লোক এগিয়ে আসবে, হাসিমুখে কারাবরণ করতে একটুও বাঁধবে না তাদের।’[২৪]
আইন অমান্য শোভাযাত্রা পরিচালনার জন্য সুভাষ তখন আগে থেকে জেলে ছিলেন। ১৯৩০ সালের মার্চ মাসের ১২ তারিখে সবরমতী থেকে মহাত্মা গান্ধী তার পদযাত্রা শুরু করলেন ৭৯ জন আশ্রমবাসীকে সঙ্গে নিয়ে। এই পদযাত্রার লক্ষ্য দুইশত মাইল দূরবর্তী সমুদ্র উপকূলের ডান্ডিগ্রাম। সেখানে গিয়ে তিনি গিয়ে তিনি লবণ আইন অমান্য করবেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলছেন মহাত্মা গান্ধী। সেই লবণ আইন অমান্য আন্দোলনের পুরোভাগেও বাঙলার বিপ্লবীগণ। নেতাজী সুভাষ বসুর কংগ্রেসদলীয় অনুসারীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সারা ভারতবাসী জেগে উঠলো এই আন্দোলনের সামিল হওয়ার জন্য। এই লবণ আইন অমান্য আন্দোলনের সাথে সাথে সুভাষ বসুর প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সেরও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ে সারা বাঙলায়।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্যসেন ৬৫ জন সাহসী তরুণকে নিয়ে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার ও পুলিশ লাইন লুট করেন, তাঁরা ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা সূর্যসেন ও লোকনাথ বলের নেতৃত্বে জালালাবাদ পাহাড়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে জয় লাভ করেন, সেই যুদ্ধে ১২ জন বিপ্লবী শহীদ হন।
চট্টগ্রামে যখন সশস্ত্র বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিলো সুভাষ তখন আলিপুর জেলে। জেলে তাঁর সঙ্গে ছিলেন যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, কিরণশঙ্কর রায়, সত্যগুপ্ত, সত্য রঞ্জন বক্সি, নৃপেন ব্যানার্জি এবং ফরিদপুরের তরুণ কংগ্রেস নেতা আবদুল খালেক। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিলের সেইদিন আলিপুর জেলে পাগলা ঘন্টা বাজিয়ে পাঞ্জাবী মেজর সোমদতের নেতৃত্বে কারা পুলিশ সুভাষসহ সব বিপ্লবীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয় তাঁদের; নির্মম এই নির্যাতনে সুভাষ গুরুতর আহত হন। সুভাষসহ অন্যান্য বিপ্লবীদের উপর কারা নির্যাতনের খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে বাঙলার সর্বত্র। উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে পুরো বাঙলা। মেজর সোমদতের শাস্তির দাবিতে ফুঁসে ওঠে লাখো মানুষ, তীব্র প্রতিবাদে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে বাঙলার প্রধান প্রধান শহরগুলোতে। লাখো মানুষের প্রতিবাদ মুদ্রিত হলো, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের মুখপত্র ‘বেণু’র সম্পাদক ভূপেন্দ্র কিশোর রক্ষিত রায়ের লেখায়। তিনি লিখলেন:
‘আমরা বাঙলার সেই তারুণ্য শক্তিকে আহ্বান করি, যে শক্তি গোটা আলিপুর জেল উপড়ে গঙ্গার জলে ফেলে সরকারি এই অপকর্মের প্রতিবাদ করবে।’[২৫]
বিপ্লবীদের ভয়ে মেজর সোমদত অনেকদিন জনসমক্ষে বের হলো না। শেষ পর্যন্ত মেজর সোমদত পণ্ডিত মদন মোহন মালব্যের কাছে গিয়ে প্রাণভিক্ষা চাইলো, মদন মোহন মালব্য মেজর সেমাদতকে ঘৃণাভরে তাড়িয়ে দেন। পরে মেজর সোমদত বাঙলা থেকে পালিয়ে বাঁচে। আলিপুর জেলের সেই নির্যাতনের প্রতিশোধ বিপ্লবীরা নিয়েছিলো, কলকাতার পুলিশ কমিশনার চালর্স গেটার্ডের উপর বোমা নিক্ষেপ করে।
১৯৩০ সালের ৫ মে মহাত্মা গান্ধীকে গ্রেপ্তার করা হলো। দেখতে দেখতে আরো ৬০ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হলো। এই নির্বিচারে গ্রেপ্তার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন বাঙলার বিপ্লবীরা। বিপ্লবী এই যজ্ঞের প্রমাণ দিলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, কুমিল্লা, কলকাতা, মেদেনীপুরসহ বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার বিপ্লবীরা। চরম আত্মোৎসর্গের মধ্যদিয়ে বাঙলার বিপ্লবীরা রক্তের অক্ষরে ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে দিলেন। বাঙলার অকুতোভয় বিপ্লবীরা প্রমাণ করলেন, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত তাঁরা।
তথ্যপঞ্জি:
২৩. মৃত্যুঞ্জয়ী, তথ্য-সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার; ভারত, মার্চ ১৯৮২
২৪. মৃত্যুঞ্জয়ী, তথ্য-সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার; ভারত, মার্চ ১৯৮২
২৫. বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের মুখপত্র ‘বেণু’; কলকাতা, ২৪ এপ্রিল ১৯৩০
(…………………………………………………………………………………………চলবে)
আগের পর্বগুলোর লিংক:
অনন্য সুভাষ (১) http://sonelablog.com/archives/24619
অনন্য সুভাষ (২) http://sonelablog.com/archives/24727
অনন্য সুভাষ (৩) http://sonelablog.com/archives/24827
অনন্য সুভাষ (৪) http://sonelablog.com/archives/24920
অনন্য সুভাষ (৫) http://sonelablog.com/archives/25039
অনন্য সুভাষ (৬) http://sonelablog.com/archives/25609
৯টি মন্তব্য
লীলাবতী
নতুন কিছু জানলাম ভাইয়া। ভাইয়া আপনি ব্লগে সময় দেন না কেনো? অন্য কারো লেখাও পড়েন না।অন্যদের লেখা কি পড়ার যোগ্য নয়?
সাতকাহন
লীলাবতী, আমি কিন্তু ব্লগার নই, টুকটাক যা লিখি তাকে ব্লগারদের ভাষায় ব্লগপোস্ট বলা চলে না। আমি যখন সোনেলাতে আসি তখনই অন্যের লেখা পড়ি, তবে অনেক সময় কমেন্ট করা হয়ে ওঠে না। আর আমার কিছু প্রিয় মানুষ এখানে আছে যাঁদের লেখা আমি নিয়মিত পড়ি, তাঁদের মধ্যে আপনিও একজন। আসলে আপনাদের পোস্টে কমেন্ট করার সাহস এখনও আমার হয়নি। যখন সাহস হবে তখন নিয়মিত কমেন্ট করবো। আশা করি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আপনার বেশিরভাগ পোস্ট আমার পড়া।
জিসান শা ইকরাম
পড়ছি নিয়মিত। (y)
শুভ কামনা।
সাতকাহন
ধন্যবাদ জিসান ভাই।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
‘আমরা বাঙলার সেই তারুণ্য শক্তিকে আহ্বান করি, যে শক্তি গোটা আলিপুর জেল উপড়ে গঙ্গার জলে ফেলে সরকারি এই অপকর্মের প্রতিবাদ করবে।
গর্বিত আমি বাঙ্গালী -{@
সাতকাহন
ধন্যবাদ মনির হোসেন।
খেয়ালী মেয়ে
মাঝখানে ৩টা পর্ব পড়া হয়নি, তবে এই পর্বটা পড়ে নিয়েছি-সময় করে বাকীগুলোও পড়ে নিবো..
সাতকাহন
ধন্যবাদ।