শহর থেকে গ্রামে গেলে সবাই যখন গাছের ডাব খাওয়া, চালতার আচার, কাঁচা আম বানানি খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকে, কোন এক অদৃশ্য টানে, অলিখিত নিয়মে সকলের অগোচরে পাশের গ্রামে যাই প্রতিবারই। যে গ্রামটি আজও গহীন গ্রাম হয়ে নুয়ে আছে। হারিকেন, কুপির আলোয় যাদের সন্ধ্যা হয়, রাত নামে। সেখানে আমি যাই রহিমা বু’র কাছে। বেড়ার ঘরে কন্কনে শীতের সেই দুপুরে হুহু করে বাতাস ঢুকে কাঁপন ধরায় শরীরে। শীত বর্ষায় এটুকু আশ্রয়ের স্থানেই এমন করে বেঁচে থাকা রহিমা বু’র। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটে যাওয়া ঘটনা, পরবর্তী সময়কার বিষাদময় বেঁচে থাকা, একটি অতৃপ্ত আত্মা’র ঘরময়, গ্রামময় ঘুরে বেড়ানো, আর্তনাদ আর ক্রন্দনের গল্প শুনি।
তিনি ফিরে যান সেই তেতাল্লিশ বছর আগে। যেন স্পষ্ট দেখতে পান সময়গুলো চোখের সামনে। উনিশ বছরের উচ্ছল প্রানবন্ত দুই সই বেণী দুলিয়ে দুলিয়ে গ্রামময় চষে বেড়াতেন। অভাব ছিল না সংসারে। ধানক্ষেত, সরিষাক্ষেত, সুপারি বাগান সবখানে দুরন্ত ছুটে চলা ছিল রহিমা বু আর সালেহা বু’র। সালেহা বু’র বিয়ে ঠিক হয় শহরে লেখাপড়া করা পাশের গাঁ’য়ের রমিজের সাথে। সালেহা বু স্বপ্নে বিভোর থাকে, খুশীর জোয়ারে ভাসে। দুর্দান্ত সুখের সেই সময়টাতে যুদ্ধ শুরু হয়…
মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে যোগ দেয় রমিজ। দেশ রক্ষা ছাড়া অন্য কোন স্বপ্নের কথা ভাবতে পারে না। এরপর দীর্ঘকাল রমিজের কোন খোঁজ জানা হয়না গাঁ’য়ের কারো। তারা নিশ্চিত ঠাহর করে নেয়, রমিজ বেঁচে নেই। এদিকে সেই গাঁ’য়ের অনেকেই চোখের সামনে বুলেটের আঘাতে ঝাঁজরা হয়। কাউকে কাউকে হানাদার বাহিনী চোখ বেধে নিয়ে যায় নদীর ধারে। লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে একে একে গুলি করে। খুব ভোরে নদীর জলে চেনা মানুষগুলোর লাশ ভাসতে দেখা যায়।
তরুণী রহিমা বু আর সালেহা বু নিরাপত্তাহীন উৎকণ্ঠা, শঙ্কা’র দিন কাটায়। রাত কাটায় নিদ্রাহীন। একরাতে তাদের বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় সেনা ক্যাম্পে। সেখানে পাকিস্তানী সেনা আর দেশীয় রাজাকার দ্বারা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয় দু’জন। দেশ স্বাধীন হয়। সেই সাথে দুরন্ত চঞ্চল যুবতীদ্বয়ের সমস্ত সুখ, হাসি, আনন্দ স্তব্দ হয়ে মুখ থুবড়ে পরে। এরপরের কয়েকটি দিন থম্কে থাকে সালেহা বু। নির্বাক ছলছল আতংকিত চোখে শূন্যে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। এক ভোরে গ্রামবাসী আবিষ্কার করে, বাড়ীর পেছনের আমবাগানে গলায় ওড়না পেঁচানো ঝুলন্ত নিথর এক যুবতীর দেহ…
রহিমা বু জানায়, সালেহার আত্মা অমাবস্যায়, রিমঝিম বৃষ্টির দিনে,রাত গভীরে অন্ধকারে গ্রামময় হেঁটে বেড়ায়। তিনি তার ক্রন্দন আর আর্তনাদের শব্দ শুনতে পান। আক্ষেপে বলেন, এমন মরবার গুপ্ত ইচ্ছে তার নিজেরও ছিল। জীবনের প্রতি তীব্র হতাশা, ঘৃণা সত্ত্বেও ক্যামন করে আজো বেঁচে আছেন__ সেটাই বিস্ময়। বনের পাখীর ন্যায় স্বাধীন ঘুরে বেড়ানো রহিমা বু সংকোচ, লজ্জায় ঘরের কোনে থাকেন সেই থেকে। পিঞ্জরের আহত পাখির মত ছটফট করেন সুদীর্ঘকাল। মুক্ত বাতাস আর আলোর বিপরীতে অনাহারে অর্ধহারে কেটে যায় অনেকগুলো বছর।
আমি নতমুখে বসে থাকি। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। রহিমা বু’র দিকে ব্যথাতুর হয়ে তাকাই। তিনি উন্মত্তের মতন এদিক সেদিক কাউকে খুঁজেন। অতঃপর শক্তিহীন ক্ষীণস্বরে বলেন___” চক্ষু দুইডা মুদে জন্মের লাহান ঘুমাইতে পারলে পরানডা শান্তি পাইতো”। আমি বুঝি__ দুঃসহ স্মৃতি বইতে বইতে তিনি ক্লান্ত, অবসন্ন। রহিমা বু’র আসলেই বিশ্রাম প্রয়োজন খুব… খ-উ-ব। জীবনের শেষ বিশ্রাম ! শ্রদ্ধা আর বিস্ময় নিয়ে তাকাই। তাঁর ছানি পরা ঘোলাটে দু’চোখ বেয়ে নোনাজল গড়ায়। যে জল দীর্ঘ তেতাল্লিশ বছর ধরে গড়ায়, গড়াতেই থাকে… ফুরায় না… শুকায় না…
সন্ধ্যা ঘনায়। একঝাঁক পাখি উড়ে যায়… নীড়ে, নিরাপদ আশ্রয়ে। আমি ফিরি ঘরে। হুম… নিরাপদ একটি ঘর ! বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশটির জন্মের পিছনে কত শত দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস বাতাসে ঘুরে বেড়ায়___ আমি কেমন করে ঘুমাই এই রাতে ? ক্যামন করে !
৩০টি মন্তব্য
মেহেরী তাজ
এমন হাজার হাজার লাঞ্চনার ইতিহাস আমাদের সমস্ত দেশ জুড়ে।কষ্ট হয় খুব এসব ভাবলে। ‘ স্বাধীন দেশটির জন্মের পিছনে কত শত দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস বাতাসে ঘুরে বেড়ায় ‘ 🙁 ভালো লিখেছেন আপু।
রিমি রুম্মান
ধন্যবাদ আপনাকে। ভাল থাকবেন ভালোলাগায়।
ছাইরাছ হেলাল
এ বেদনার আর্তি আমদের কত কাল বয়ে বেড়াতে হবে আমরা তা কেউ জানি না।
রিমি রুম্মান
এ আর্তি থাকবে যুগ যুগ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
সাইদ মিলটন
আলো কাঁপে –
কাঁপে ছায়ারাও, সুদীর্ঘ সময়তলে
পড়োপড়ো দেয়ালজুড়ে বিস্মৃতির ছাপচিত্র।
আধোঘুমে শুনে যাই ইতিহাস,
হৃদপিঞ্জরে কে আজ সময় খুড়ে অনন্ত দুঃখ ছোয়ায়
আমারে কে ডেকে বলে – জাগো, যায় বেলা অবেলায় ।
রিমি রুম্মান
সুন্দর বলেছেন। ভাল থাকুন।
প্রহেলিকা
অসাধারণ লিখেছেন আপনি, বরাবরের মতোই, এখনো অনেকেই ঘুমেই কাটিয়ে দিচ্ছে এই দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে, তেতাল্লিশ বছর পার হয়েছে তবে ভাবছি এমন করেই আরো কয়েকশত তেটাল্লিশ বছর পার হয়ে যাবে তারপরও কি এই দীর্ঘশ্বাসের অন্ত থাকবে?
এমন গল্প আরো চাই আপু!
রিমি রুম্মান
পৃথিবীর মানচিত্রে যতদিন বাংলাদেশ নামক দেশ থাকবে, ততদিন এইসব দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস বাতাসে ভেসে বেড়াবে। অনেক কষ্টে পাওয়া এই দেশ আমাদের।
জিসান শা ইকরাম
এনাদের কানাতেই আজ আমরা মাথা উচু করে চলি।
ভালো লিখেছেন।
রিমি রুম্মান
ধন্যবাদ ভাইয়া। মন্তব্যে উতসাহিত হই প্রতিবার, বারবার…
মিথুন
এমন ইতিহাসগুলো কস্ট বাড়িয়ে দেয় বহুগুন। অন্তর থেকে শ্রদ্ধা নাম না জানা আরো এমন সালেহা আর রহিমা বু দের জন্য।
রিমি রুম্মান
শ্রদ্ধা সেই সব মানুষদের, যারা দেশের আনাচে কানাচে নীরবে আজও তেতাল্লিশ বছর পরও স্বস্তি পায়না এতোটুকু। দীর্ঘশ্বাস আর অশ্রুপাত নিয়ে তারা বেঁচে থেকেও মৃতপ্রায় ।
শুন্য শুন্যালয়
অসাধারন লেখা আপু। সালেহা আর রহিমা বু এর কান্না আমি শুনতে পেলাম যেন।
রিমি রুম্মান
এ যে হৃদয় বিদীর্ণ করা কান্না। দেশের প্রতি ভালবাসা যাদের অসীম, এ কান্না তাদের কানে বাজে প্রতিনিয়ত।
অরণ্য
আপনি ভাল লেখেন এটা বলার চেয়ে আমার বলা উচিৎ লেখাটি আমার খুব ভাল লেগেছে। সাথে মনে পড়ছে আপনার আগের লেখায় (যে আর ফিরে আসেনি) অভিমানী মেয়েটিকে করা আমার মন্তব্যগুলো।
রিমি রুম্মান
“যে আর ফিরে আসেনি” লেখাটির ধারাবাহিকতায় এই লেখাটি এসেছে। আপনি ঠিক ধরতে পেরেছেন। ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। ভাল থাকবেন।
বনলতা সেন
আমাদের গোল্ড ফিস মেমোরি। জোর করে চোখ বন্ধ করে ঘুমাই।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন।
আজিজুল ইসলাম
অসাধারন প্রকাশ।
সালেহা বু আর রহিমা বু-দের কান্না আমাদের প্রচন্ড অপরাধী করে তোলে। কিন্তু মৃত্যুভয় আমাদের প্রতিবাদ করতে দেয়না।
তাই বলি-ই বা কী করে যে, আমাদের অপরাধী করে তোলে?
রিমি রুম্মান
ভাল বলেছেন। ভাল থাকুন।
নীলাঞ্জনা নীলা
এই দীর্ঘ শ্বাস এর বিচার না হওয়ায় দেশ ভারী হয়ে থাকে।বিচার না হলে এই দীর্ঘ শ্বাস আমাদের শান্তি দেবে না।
রিমি রুম্মান
তবুও আমি আশাবাদী। আশা নিয়ে বেঁচে থাকি।
স্বপ্ন
তাঁদের কান্নায় আমরা পেয়েছি এক স্বাধীন দেশ।
রিমি রুম্মান
বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক।
আজিজুল ইসলাম
যতবারই পড়ি লেখাটা, মন্তব্য করতেই হয়। প্রধান কারন এর অসাধারণ উপস্থাপনা, অনূধাবন থেকে যে-যোগ্যতা আসে। অনুভূতি যার যতো প্রবল, অনুভূতির প্রকাশটাও তাঁর হয় ততোটাই অসাধারণ, যেটার আসলে কোন সংজ্ঞা হয়না অথবা কোন মাপকাঠি। উপস্থাপনাটা পড়তে অদ্ভুত এক বেদনা অনুভূত হয়। এটাও প্রকাশ করা যায়না, শুধু অনূভব করা যায়।
রিমি রুম্মান
এমন মন্তব্যে লিখতে উৎসাহিত হই। দ্বিগুণ গতিতে আরেকটি লেখার দিকে এগিয়ে যাই। ভাল থাকুন। শুভকামনা রইলো।
ব্লগার সজীব
অসাধারন লিখেছেন আপু। এসব ভাবলে কষ্ট হয় খুব।
রিমি রুম্মান
কষ্টে পাওয়া দেশ, কষ্টে পাওয়া স্বাধীনতা ।
প্রজন্ম ৭১
বুকের মাঝে তীব্র ব্যাথা আপু।
রিমি রুম্মান
এ ব্যথা ছড়িয়ে পরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আমরা নিস্তার পাই না। এভাবেই বেঁচে থাকি একটি স্বাধীন দেশে।