৩.
-তুমি আমাকে আর ছোঁবে না
‘ কেন হঠাৎ আবার কি হল?’
– ছোঁবে না, ব্যস।
আমাদের পরিচিত পাগল-পাগলি নতুন কলা ভবনের সামনের সিঁড়িতে বসে আছে। ওদেরকে পাগল ও পাগলি হিসাবে পরিচয় করালেও ওদের যার যার নাম রয়েছে। শিহাব ও রুনা। এরাই ওরা। আজ রুনার মন খারাপ। ভীষণ খারাপ।
এবং বিমর্ষ।
সকাল থেকেই হৃদয়ের ঈষাণ কোণে কালো মেঘের আনাগোনা সে টের পাচ্ছে।একটা অমূলক ভয় ভিতরে কাজ করছে। শিহাবের উপস্থিতিও সেটা কাটাতে পারছে না। মোট কথা আজ ওর আকাশে একরাশ কালো মেঘ, অন্য দিনের চেয়ে ভিন্ন বার্তা নিয়ে এসেছে।
শিহাবঃ ‘ আমি কি কোনোভাবে তোমাকে হার্ট করেছি?’
রুনাঃ – জানি না। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।
‘ চলো দুজনে হাত ধরে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াই’
– তুমি কি আমার শরীর ছাড়া আমাকে কল্পনা করতে পার না? যখনি কাছে আসবে শুধু ধরা ধরি আর ছুঁয়ে দিতে চাও… কেন ?
‘ হোয়াট?!’
– হৃদয়টা কি তোমার কাছে কোনো মাইনে রাখে না?
‘ আমি কোনো হৃদয় বিশেষজ্ঞ নই’
– তবে কি তুমি? একজন ডোম? যে মৃতদেহকে ব্যবচ্ছেদ করায় আনন্দ পায়?
‘ তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?
– স্যরি…
দুজনে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। শিহাব পকেট থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বের করে। রুনার দিকে সম্মানজনক দূরত্ব রেখে ওটা বাড়িয়ে দেয়।
– কি ওতে?
‘ খুলে দেখ’
র্যাপিং পেপারে মোড়া ক্ষুদ্র প্যাকেটি খুলেই আশ্চর্য হয়ে যায় রুনা।
একটু আনন্দ…বিস্ময় এবং পেয়েও হারানোর বেদনা ওকে তাড়িত করে। একটু কষ্টও কি মনকে ব্যথাতুর করে দেয় ?! … বিচিত্র এক ভাব মুহুর্তেই খেলা করে যায় ওর ভিতর।
ঘাস ফুলের অতি সাধারণ দু’টি ফুল যাকে কানের দুলে রূপ দেয়া হয়েছে। রুনা যে কোনো ধরণের অলঙ্কার ব্যবহারের বিরোধী। সে নিজেকে সকল সাজগোজ এবং প্রসাধনী মুক্ত রেখে চলে। এটা শিহাব ভালোই জানে।
– এটা কেন?
‘ তুমি তো আর কৃত্তিম জিনিস পড়বে না… তাই অনেক খুঁজে খুঁজে এই দুটো সংগ্রহ করলাম। এতে তোমার নিয়মের ব্যাঘাত ঘটবে না। তুমি নারী… তোমাতে আর প্রকৃতি এক হবে এগুলো পড়লে!’
– তবে তুমি নিজে পড়িয়ে দাও!
‘ নাহ! তোমাকে আর যদি ছুঁয়েছি কখনো!
– এখন আমি বলছি!
‘ কি পেয়েছ আমাকে? ইচ্ছে হল কাছে আসবে, ইচ্ছে হল দূরে ঠেলে দেবে?’
ঘাস ফুল দুটির দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকে রুনা। এরপর যখন সে কথা বলে শিহাবের কানে তা মনে হয় যেন কোনো দূর গ্রহ থেকে কেউ কথা বলছে… যাতে হৃদয় নিংড়ানো কষ্ট এবং না পাওয়ার বেদনা মিশে আছে।
– তুমি আমি দুজনেই ইতিপুর্বে হৃদয়ের ব্যাপারে অন্য কারো কাছ থেকে ফিরে এসেছি। সোজা কথায় আমরা রিজেক্টেড। যাকে ভালোবাসতাম তাঁকে পেতে চেয়েছি পাগলের মতো… কিন্তু তাঁর মন ও শরীর দুটোই হাফ ডান পাওয়া হয়েছে আমার… একটা অতৃপ্তি- অসম্পুর্ণতা আমাকে আগ্রহহীনা করে ফেলেছে… আমি একা থেকেও একা ছিলাম না। অতীত আমাকে বেঁধে রেখেছিল। আমার পৃথিবীটা আমি আমার মত গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলাম… যেখানে বন্ধুরা ওয়েলকাম বাট প্রেমিক নইব নইব চ…
‘ এটা তোমার অনুভুতি। এর ভিতরে আমি এলাম কীভাবে?’
– তুমিও যে কোনোভাবেই হোক প্রত্যাখ্যাত হয়ে মোমের মত গলানো হৃদয় নিয়ে আমার কাছে এলে। তোমার মনটা একেবারে শুন্য হয়েছিল। আমিও একটা শুন্য মন খুঁজছিলাম… যেখানে আমি নিজের মত করে বসত গেঁড়ে তাকেও আমার শুন্য মনে নিয়ে আসতে পারি। যে প্রথমে আমার বন্ধু হবে… ধীরে ধীরে একজন অন্যজনে অবগাহন… সমর্পণ… কিন্তু তুমি তোমার ছেলেমানুষি আর উচ্ছলতা দিয়ে যেভাবে আমাকে আকর্ষণ করছিলে… একসময় নিজেকে ধরে রাখা আমার জন্যও টাফ হয়ে পড়ল। আমি তোমার রিক্তের বেদনাকে আড়াল করে দিতে, তোমাকে এবং আমার নিজেকেও একটু সুখী দেখতে চেয়ে ভেসে গেলাম।
‘ তাই?’
– হ্যা! এবং কি অদ্ভুত ব্যাপার জানো, ভেসে গিয়েই বুঝলাম কি করছি আমি… ফিরতে চাইলাম। তবে তোমাকে কষ্ট দিতেও মন চাইছিল না। আমি কি করব বল এখন?
‘ প্রথমত; মনটাকে আর শুন্য ভেব না। যেভাবেই হোক আর যাই হোক কিছু তো পেয়েছ। নিজেকে শুন্য হতে দিও না। আমি এই মুহুর্ত থেকে তোমাকে বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রতিটি মানুষ আলাদা… তুমি যা ভাবছ সেটা তোমার ভাবনা, আমারটা আমার নিজের। তোমার একটা কথা অবশ্য ঠিক। বন্ধুর চেয়ে আপন আর কেউ হয় না। নিজের অভিজ্ঞতায় বলছি, সম্পর্কের ভেতর থেকে দেখেছি, বাইরে থেকেও দেখেছি!’
– তুমি আমাকে আরো বোঝ… আমি তোমার হাত ধরে সময়ের ওপর সব ছেড়ে দিলাম… এবং আমি এই মুহুর্ত থেকে দরোজার বাইরেই কমফোর্ট ফিল করছি। এখন আমার হাত ছেড়ে দেয়া কিংবা আরো শক্ত করে ধরে থাকা তোমার ব্যাপার।
‘ একসময় হয়তো তুমি দরোজা অতিক্রম করতে পারবে… তবে সেটা কত দিন…মাস…বছর লাগবে আমরা কেউ জানি না!’
– আমি একটা বন্ধু চেয়েছি, যে আমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবে কিন্তু আমার ভেজা শরীর তাঁকে টানবে না… আমি তাঁর সাথে পুকুরের এপার থেকে ওপারে সাঁতড়িয়ে যেতে চাই… আমি ওড়না পড়ি না, এটা সে দেখবে না!
‘ আমি ওড়নার নীচের সব কিছু এতো দেখেছি যে ওটা আমার না দেখলেও চলবে’
– আবার শুরু করলে?
‘ না, সিরিয়াস মুড থেকে একটু রিল্যাক্স মুডে আসার চেষ্টা করলাম। তোমার দিক থেকে একে অপচেস্টা ও বলতে পারো।’
ঘাসফুলের কানের দুল দুটিকে দেখিয়ে রুনা শিহাবকে বলে,
– এখন কি এগুলো আমাকে পড়িয়ে দেবে?
‘ না, যেদিন তোমার প্রেমিক থেকে বন্ধু হতে পারব, সেদিনই ও দুটো পড়াবো।’
– প্রোমিজ? নাকি রাগ করে বলছ?
‘ ইটস আ জেন্টেলম্যান প্রোমিজ… এন্ড আই রিয়েলি মীন ইট’
– বেশ! তবে এগুলো আমি যত্ন করে রেখে দিচ্ছি সেদিনের অপেক্ষায়।
‘আচ্ছা, রেখে দাও তবে।
– একটা কথা, তুমি যেদিন ওটা করে দেখাতে পারবে, সেদিন কদম ফুটবে। আমি নিজে সেই কদমের অপেক্ষায় রইলাম!
‘ কদম কত ভাগ্যবান! কেউ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে… আর আমি?’
– যাও!… তোমাকে ও কদম দেয়া হবে
‘ না, আমি কদম প্রদানকারিনীকে চাই!’
একজন প্রেমিক তাঁর প্রেমিকাকে নিয়ে পাশাপাশি হেঁটে চললো। আশেপাশে আরো অনেকে হাত ধরে চলছে… কিন্তু সে প্রেমিক থেকে আগে বন্ধু হবার সাধনায় নেমেছে। তাই নিরাপদ দূরত্বে থেকেই দুজনে হৃদয়ের কাছাকাছি থাকার আপ্রাণ চেষ্টারত… রুনার আকাশের কালো মেঘগুলো সাদা মেঘবালিকায় পরিণত হয়েছে। শিহাব সেই মেঘবালিকাদের দেখে দেখে পথ চলছে।
(ক্রমশঃ)
১২টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সুন্দর অনুভূতি নিয়ে লেখা গল্পটি ভাল লাগছে। -{@ মাঝে এমনি হয় চাহিদা যেন বেড়ে যায়। -{@
মামুন
অনেক ধন্যবাদ ভাই।
সুন্দর অনুভূতি রেখে গেলেন। -{@
নুসরাত মৌরিন
গল্পটি ভাল আগাচ্ছে।
পড়তে ভাল লাগছে। 🙂
মামুন
ভালো লাগার অনুভূতি জানিয়ে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
মারজানা রুবা
অনেক ভালো লাগলো গল্পটি পড়ে। এটি ৩য় পর্ব, বাকী দুটু পড়ার সুযোগ হয়নি কিন্তু এবার তো না পড়ে হবে না।
সুন্দর!
মামুন
আমার ব্লগে স্বাগতম!
ভালো লাগা রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ। -{@
ব্লগার সজীব
এটি ৩য় পর্ব হলেও একটি আলাদ গল্পর মতই আবেদন এর। ভালো লেগেছে।
মামুন
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
ছাইরাছ হেলাল
আমরা এখন বৃষ্টির অপেক্ষা করছি।
মামুন
অনেক ধন্যবাদ অপেক্কাহ্র জন্য।
এইমাত্র অফিসে এলাম, বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মত কুয়াশা ঝরছে।
ছাইরাছ হেলাল
এত্ত সকালে কোথায় অফিস এই শীতে?
মামুন
আমি একটি পোশাক কারখানায় জব করি ভাই। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে অফিস শুরু। কোনাবাড়িতে, গাজীপুর জেলায়।