ল্যাম্প পোষ্টের নিচে দাড়িয়ে আছি। না, যেদিকটাতে আলো পড়ে সেই দিকটাতে না তার উল্টোদিকে। আলোর আভা আমার গায়েও লাগছে কিন্তু অন্ধকারে এইটুকু আলোর জন্যে অন্ধকারটাকে আরও আপন মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। কাছাকাছি আরও দুইটা ল্যাম্পপোস্টের কোনটাতেই আলো নেই। কে জানে হয়তো লাইট গুলিই চুরি গেছে, আলো দেয়া তো এখন অনেক দূরের ব্যাপার। এ শহরের কেউ যেমন তাদের এই সম্পত্তিগুলির খেয়াল রাখে না আমিও তেমন একজন। কিন্তু আজ চোখে পড়ছে, কারণ এই অন্ধকারে তৈরির পেছনে যেই সম্পদ গুলি হারিয়েছে আমিও তেমন হারিয়েছি। অন্ধকারটাকে আপন মনে হচ্ছে আর সত্যি কথা বলতে কি আলো না থাকাতেই যেন স্বস্তি পাচ্ছি এই মুহূর্তে। অন্য কোন সময় হলে হয়তো ব্যাপারটা ভিন্ন রকম হত।
রাস্তার ওপারের কলোনির ৩ তলা বিল্ডিংটাতে আমার বসবাসের স্থান ছিল আজ বিকেলেও। কিন্তু বিকেলটা শেষ হতেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। জানলাম আমি এতদিন যে বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়েছি সেই বিশ্বাসের কোথাও আমার অবস্থান নেই।
বিকেলে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন ঐ বাসায়। তাকে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু বাবার মুখটা হুট করেই তাকে দেখে কেমন যেন শুকিয়ে গেলো। যদিও খুব ভদ্রভাবে তাকে বসার ঘরে নিয়ে বসালেন, তারপর বেশ পরিচিত ভঙ্গীতেই কেমন আছে, কি হাল এইসব জানতে চাইছিলেন। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম বাবা চাচ্ছিলেন না এই লোকটি এখানে আরও ১ টা মিনিটও অপেক্ষা করুক। যেন দ্রুত কথা বলে বিদায় করে দিতে পারলেই বাবা বাঁচেন।
আম্মা আমাকে ভেতরের রুম থেকে ডাকলেন। তারপর হাত ধরে নিয়ে আমার রুমটাতে নিয়ে এসে কেমন যেন ঝটপট বুঝিয়ে ফেলার ভঙ্গীতে বলতে থাকলেন-
“এই লোক কিছু বললে বিশ্বাস করবি না একদম। এই লোকের কথায় কিছু আসে যায় না। তুই যেমন আছিস এমনই থাকবি, বুঝেছিস।”
আমি ঠিক বুঝি নি, তবে এটা বুঝেছি আম্মা আসলে কথাগুলি আমাকে বলেন নি। আসলে কথাগুলি সে নিজেকেই বলেছেন আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে। আমিও আম্মার কথা মত দ্রুত বোঝার ভঙ্গী করে বললাম বুঝেছি। তারপর আম্মা আমাকে রুমে রেখেই চলে গেলেন লোকটির সাথে বাবা যে রুমে কথা বলছেন সেই রুমে।
অস্পষ্টভাবে এখান থেকেই শুনতে পারছিলাম তারা কোন একটা ব্যাপারে একমত হতে পারছে না, কথা কাটাকাটি করছে। অকারণেই বুঝে নিয়েছিলাম কোথাও একটা সুর কেটে গেছে এই সময়টার ভেতরেই। এর মধ্যেই আব্বা হুট করে রুমে ঢুকে আমাকে টেনে বসার রুমে নিয়ে গেলেন আর বললেন –
“এই ছেলে যদি আপনারই হয় তাহলে এতদিন কি করেছেন? ওখানে কেন ছেড়ে এসেছিলেন ছেলেকে? এতই মায়া তাহলে তখন কেন মায়ায় কমতি পড়েছিল?”
হুট করে কথাগুলি শুনে কেমন যেন ঘোরে চলে গিয়েছিলাম। বাবা এরপরও কি যেন বলছিল খুব উত্তেজিত হয়ে। আবার সেই লোকটাও সমান তালে উত্তেজিত হয়েই কথার উত্তর দিচ্ছিল। কিন্তু কোন কথাই আমার কানে ঢুকছিল না। এক মুহূর্তেই পুরো দুনিয়াটা উল্টে গিয়েছিল আমার জন্যে।
এরপর ঐ ঘোর লাগা অবস্থাতেই ছুটেছিলাম, ঘর ছেড়ে বিল্ডিং থেকে নেমে রাস্তা ধরে ছুটছিলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে পড়ে যাবার ঠিক আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ঐভাবেই ছুটছিলাম আমি। হোঁচট খাবার পরেই ঘোরটা কাটল। চারপাশে তাকিয়ে দেখি সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছিল বাবার কথাগুলি এরাও সবাই জেনে গেছে এরই মাঝে। রাস্তা থেকে দ্রুত উঠে ফুটপাতেই বসে পড়লাম। তখনও চরমভাবে হাঁপাচ্ছিলাম। বার বার আম্মার কথাগুলি কানে বাজছিল-
“এই লোক কিছু বললে বিশ্বাস করবি না একদম। এই লোকের কথায় কিছু আসে যায় না।”
কিন্তু ঐ লোক কিছু বলার আগে আমার বাবা এইসব কি বলল তাহলে? কেন বলল কথাগুলি?
চোখ ফেটে কান্না আসছে, কিন্তু আমি কান্নাও করতে পারছি না। কেমন যেন হাসফাস হচ্ছিল ভেতর ভেতর। বারবার মনে হচ্ছিল বাবা ঐসব মিথ্যা বলেছিল। এমন তো হতেই পারে না। আমার তো এখনো স্পষ্ট মনে আছে বাবা আমাকে কাঁধে করে নিয়ে হাঁটছে, ঘুমপাড়ানোর চেষ্টা করছে। তাহলে এমন কথা কেন বলবে বাবা। এটা হতেই পারে না। মনে হচ্ছিল আমি ভুল শুনেছি, বাবা অন্য কিছু বলেছিল। আমিই ভুলে কথাগুলি এমন শুনেছি।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। ফুটপাতে এত সময় বসে আছি দেখে কয়েকজন কেমন করে তাকাচ্ছেও। তার মধ্যে পড়ে গিয়ে হাঁটুর অনেক বড় অংশের চামড়া উঠে গেছে। একটু একটু রক্তও বের হচ্ছে সেখান থেকে সাথে জ্বালা করছে অনেক। কিন্তু মনের ভেতর যেই জ্বালা হচ্ছে তার কাছে এই জ্বালা কিছুই না। আমি শুধু বারার চাইছিলাম এই দুঃস্বপ্নটা ভেঙ্গে জেগে উঠি। উঠে দেখি আম্মা আমার জন্যে বিকেলের নাস্তা রেডি করছে। কিন্তু জাগতে আর পারছি কই। জ্বলে-পুড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছি আমি।
ফুটপাত ছেড়ে উঠে আবার হাটা শুরু করলাম। হাঁটছি, কোনদিকে খেয়াল করা ছাড়াই হাঁটছি। মাঝে মধ্যে এর ওর সাথে ধাক্কাও লাগছে। দুই একজন আবার “পাগল নাকি” বলেও সম্বোধন করছে। কিছুই গায়ে লাগছে না এখন আর। ঘোর লাগা মুহূর্তটা আবার ফিরতে শুরু করেছে মনে হয়। সত্যিকারের একটা পরিচয় ছাড়াই আমি মিথ্যা পরিচয়ে এতটা বড় হয়ে গেছি, সেটাই ভাবছি বার বার। হাটতে হাটতে কখন এই কলোনির সামনে ল্যাম্প-পোষ্টের নিচে চলে এসেছি তা খেয়াল করি নি। খেয়াল হল যখন অন্ধকারটাকেই আপন মনে হচ্ছিল তখন।
আচ্ছা ঘুরে ফিরে এখানেই কেন ফিরে এলাম? এখানে তো আপন বলে কেউ নেই, সবই তো আমার অপরিচিত। সবকিছুই তো মিথ্যে……
২৮টি মন্তব্য
স্বপ্ন নীলা
দুইবার পড়েছি –ছবি এবং বর্ণনা দুটোই চমৎকার আর সাবলীল — আমার মনের ভেতর কষ্ট ভর করেছে — কেমন যেন কষ্টে মনটাই বিষিয়ে গের — মনে হয় সত্যি কোন ঘটনা পড়ছি — আবার পড়েছি — মনে হয় কান্না করলে ভাল হতো —-
আন্তরিক ধন্যবাদ এত সুন্দর একটি গল্প উপহার দেয়ার জন্য ————-
অলিভার
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ সময় নিয়ে লিখাটা পড়ার জন্যে।
শুভকামনা জানবেন আপু 🙂
লীলাবতী
খুব কষ্টের এক অনুভুতি
ভালো ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন।
অলিভার
লেখাটা লেখার পর মনে হয়েছে লেখাটি লেখা ঠিক হয়নি। এই অনুভূতি নিয়ে কল্পনা করাটা মনে হয়েছে অন্যায়। যারা এমন পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছে তাদের কথা ভেবে নিজেরই খারাপ লেগেছে একটা সময়ে।
অনেক ধন্যবাদ আপু সময় নিয়ে পড়ার জন্যে।
নুসরাত মৌরিন
কখনো কখনো দুঃখ বোধ হৃদয় কে দারুন ভাবে নাড়া দেয়।গল্পটা তেমনই …ছুঁয়ে গেল মন।
অলিভার
আমাদের হয়তো শুধু হৃদয়টাকেই নাড়া দেয়। কিন্তু কারো কারো পুরো পৃথিবীটাই নড়ে যায় যখন এমন কোন বাস্তবতা সামনে এসে দাড়ায়।
ধন্যবাদ আপু সময় নিয়ে লিখাটা পড়ার জন্যে, শুভ কামনা জানবেন।
মোঃ মজিবর রহমান
খুব প্রাণচঞ্চল ও সহজ সরল ভাবে লেখাটি পড়ে মনে হয় বাস্তব ঘটনা। খুব সুন্দর হয়েছে।
অলিভার
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া লেখাটা সময় করে পড়ার জন্যে 🙂
শুভ কামনা জানবেন 🙂 🙂
ছাইরাছ হেলাল
বেশ ভালোই লিখছেন দেখছি। শিকড়ের টানে ফিরে আসতেই হয়।
অলিভার
ভাইয়া খুব ভালো আর হচ্ছে কই! নিজের কাছেই অনেকটা ছাড়া ছাড়া মনে হয় :p
লেখাটা ভালো লেগেছে জেনে আনন্দ লাগছে 🙂
মিথুন
গল্পটা ছুঁয়ে গেলো।
অলিভার
সময় নিয়ে লেখাটা পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ 🙂
শুন্য শুন্যালয়
অনেকদিন পর এলেন অলিভার। গল্পটা সত্যিই অসাধারন। সবকিছুই তো মিথ্যে, এটা বুঝলে কস্ট যেতো আসলে।
শুন্য শুন্যালয়
*কমে
অলিভার
আসলে কিছু সমস্যার কারণে নিয়মিত ব্লগে আসতে পারছি না। তবে দ্রুতই আবার ফিরে আসার চেষ্টা করছি 🙂
যেখানে পরিচয়ের শিকড়টাই মিথ্যে প্রমাণিত হয় সেই কষ্টটা কি আসলেই সান্ত্বনা দিয়ে কমানো সম্ভব? মনে হয় না আপু।
মেহেরী তাজ
মিথ্যা টাই যে সত্য, আর এই মিথ্যা সত্য টাকেই যে আম্রা মেনে চলি। অনেক ভাল লাগলো।
অলিভার
কাউকে যখন সত্যিই সত্যিই মিথ্যের ভেতর নিজেকে হারিয়ে ফেলে পুনরায় বাস্তবতার সামনে দাড়াতে হয় তখন তার মনের অবস্থাকে কিভাবে সমাজের এই নিয়ম দিয়ে মূল্যায়ন করা যায় বলুন।
ভালো লেগেছে জেনে আনন্দিত হলাম। শুভ কামনা জানবেন 🙂
বনলতা সেন
আমি কী ঠিক দেখছি ? আপনাদের অজুহাতের আর অন্ত নেই।
এলেন যখন তখন চলে যান কেন?আবার চলে গেলে আবার আসেন কেন? যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলেন?
রেগে আছি।
অলিভার
সরি আপু, প্লিজ রাগ করবেন না -{@
একেবারে যাবো কেন? আছি আপনাদের সাথেই 🙂 যদিও মাঝে মধ্যে একটু পিছিয়ে যাই :p
বনলতা সেন
এবার থেকে আর কোন পিছিয়ে থাকা নেই। পড়েছি লেখা।আরও লিখতে হবে।
অলিভার
🙂 চেষ্টা করবো আপু
আম্মানসুরা
বাহ! স্বার্থক ছোট গল্প। অন্তরে অতৃপ্তি আছে।
অলিভার
সোনেলা ব্লগে স্বাগতম আপু 🙂
লেখাটা ভালো লেগেছে জেনে সত্যিই আনন্দিত হলাম। শুভ কামনা জানবেন আপু 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
এমন অবস্থা কল্পনাতেও আনতে পারিনা। কষ্টকে ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন।
অলিভার
গল্পটা যেন গল্পই থাকে, এমন অবস্থার সম্মুখীন যাতে কখনোই কাউকেই না হতে হয় সেই কামনাই করছি।
সময় নিয়ে লেখাটা পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ আপু 🙂
প্রজন্ম ৭১
আত্মপরিচয় বেঁচে থাকার প্রধান শক্তি। কষ্টের লেখা। ভালো লিখেছেন।
অলিভার
শেকড় ছাড়া একটা গাছ যেমন কল্পনা করা যায় না তেমনি পরিচয় বিহিন একটা জিবনও কল্পনা করতে কষ্ট হয়। তবুও কারো কারো বাস্তবতায় এমনটা হয়ে যায়।
ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্যে 🙂
আগুন রঙের শিমুল
অন্ধবৃত্ত 🙁