কাজ শেষ হবার পর শ্রীপদ পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা ছোট মদের বোতল বের করে বড় করে এক ঢোক মারে। এক ঢোকেই বোতলের তিন-চতুর্থাংশ হাওয়া। কৃষ্ণা ও রামু হা করে তাকিয়ে থাকে। শ্রীপদ বাকী মদ সমেত বোতলটি কৃষ্ণার হাতে দেয়।
শ্রীপদ: কৃষ্ণা ই লে দারু। বিদেশী হ। তে আর রামু মিলকে খো।
কৃষ্ণা: সব মালিককে ইচ্ছা। আওরে রামু দারু পিয়ে।
রামু দ্রুত কৃষ্ণার কাছে আসে। দু’জন মিলে দ্রুত মদের বোতল শেষ করে ফেলে। রামু আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। এ যেনো মদ্যে নয় পদ্যে মাতাল হয়ে যাওয়া। পাক্কা মাতাল, জলকেও মদ্য ভেবে পান করে নেশায় চুর হয়ে যায়।
শ্রীপদ: রামু ও কৃষ্ণা।
রামু: জ্বী মালিক!
শ্রীপদ: চল। রাম্বাকে লেকে আবার নারাছু ডোমকে ঘরে যায়েহই, চল।
কৃষ্ণা: জ্বী মালিক!
শ্রীপদ হাতের টর্চটা জ্বালিয়ে দ্রুত হাঁটতে থাকে। পেছনে পেছনে রামু আর কৃষ্ণা।
নারাছু ডোম ও রাম্বার বিয়ে এবং সহমরণ প্রসঙ্গ
নারাছু ডোমের উঠান। হেজাগের আলোর বন্যা। সমাজের সবাই বসে মদ্যপান করছে। বরবেশী বৃদ্ধ নারাছু ডোম বড় একটা জলচকিতে কাত হয়ে শুয়ে আছে। হাঁপানির কারণে বার বার তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সে হাঁপানির শব্দ ঝিঁঝিঁ পোকাকেও হার মানিয়ে দেয়। নারাছু ডোমের চোখে জ্বল জ্বল করে শেষ যৌবনের সুতীক্ষ্ন ঝলক। উম্মত্ত যৌবন আরেকবার উঁকি মারে জীবনের শেষ বেলায়। নারাছু ডোমের পাশে ঠাকুর বসা। তার সামনে বিয়ের নানান উপাচার নিয়ে অপেক্ষা করছে লোকজন। শ্রীপদ রাম্বাকে হাত ধরে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে আসে। পেছনে পেছনে রামু ও কৃষ্ণা।
শ্রীপদ: ঠাকুর বিয়াকা মন্ত্র শুরু কারো। যো রাম্বা, এই বুড়ুয়া আদমি তর আদমি হ। শুরু কারো ঠাকুর।
ঠাকুর মন্ত্র শুরু করে…।
‘ওঁ দূর্ব্বায় নমঃ
ওঁ বেলপাতায় নমঃ
ওঁ প্রজাপতি নমঃ…’
অগ্নিসাক্ষী চলছে। রাম্বা নিশ্চুপ, নিথর হয়ে পাক দিচ্ছে। একটু দূরেই চলছে শুয়োর মারার নির্মম দৃশ্য, দুইপাশে দু’টি বাঁশের কাচি, মাঝখান দিয়ে দুই কাচি বরাবর একটা ধাতব পাইপে একটা চ্যাংদোলা করে আস্ত শুয়োরকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। নীচে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। আগুনের লেলিহান শিখার কষাঘাতে ক্ষয়ে যায় শুয়োরের মাংসল শরীর। আগুনের তীব্র দহনে শুয়োরের কৃষ্ণবর্ণ চামড়ার আস্তরণ পাল্টে গিয়ে লাল দগদগে মাংস বেরিয়ে আসে। ঠাসা মাংসের ভেতরের চর্বি গলে চুইয়ে চুইয়ে ভিজিয়ে দেয় লাল দগদগে পোড়া মাংস আর মুহূর্তেই সেই নিঙড়ানো তরল চর্বি আগুনের ঝাপটায় পুড়ে বায়বীয় হয়ে যায়, নিমেষে ছ্যাৎ ছ্যাৎ করে ওঠে। নিদারুণ যন্ত্রণার সুতীব্র চিৎকারে আর্তনাদ করে দগ্ধ শুয়োর। তার কান্নার জলও বেশিক্ষণ চোখের কোণে স্থায়ী হয় না। নিরন্তর উত্তাপে উবে যায় ক্ষণে ক্ষণে। মৃত্যুপথযাত্রী শুয়োরের সে কান্না অসহায় রাম্বার ভেতরের গুমড়ে ওঠা নির্বাক কান্নার সাথে একাকার হয়ে যায়। এ যেনো শুয়োরের দগ্ধ হওয়া নয়, রাম্বার পোড়া দেহ, পোড়া মন।
ঠাকুর মন্ত্র পড়ছে। অগ্নিসাক্ষী চলছে। পাক যত বাড়ছে নারাছু ডোমের হাঁপানির কষ্ট ততোই বাড়ছে। সপ্তম পাক শেষ হবার আগেই নারাছু ডোম পরপারে চলে যায়। ব্রাহ্মণ চিৎকার করে ওঠে, ‘শ্রীপদ! নারাছু ডোম আর নাই। হরিবোল! হরি বোল! নারাছু ডোম মরগিয়া!’ চারিদিকে রোল ওঠে, ‘বোল হরি! হরি বোল! রাম নাম সত্য!’
রাম্বা ক্ষীণস্বরে চিৎকার করে থেমে যায়। সাথে সাথে শুয়োরটাও শেষ চিৎকার করে থেমে যায়। শুয়োরের প্রাণেই হয়তো নারাছু ডোমের প্রাণ লুকিয়ে ছিলো। শ্রীপদ, ‘হায় হায়’ বলে চিৎকারজুড়ে দেয়।
শ্রীপদ: হায়, হায়, হায়! আমার বোন সাদিকা বাদমে তু বিধবা হোগা রে..!
রাম্বার কণ্ঠ থেকে একবার ক্ষীণ কান্নার আওয়াজ বের হয়েই থেমে যায়। পাথর হয়ে যায় রাম্বা, যেনো কাঠের পুতুল।
রামু: আহা! পোড়া কপাল!
শ্রীপদ: তাকলিফ জো হোগা তো হোগা। মেরা বাহিন, স্বামী তো মরগা উছকো পাছ তুম চিতাছে জ্বালযাও। আদমি বোলাহ্যায় শ্রীপদ ডোমের বাহিন রাম্বা সতী ও সত্যি রক্ষা কাররাহাহ্যায়।
রাম্বা: ঠিক হ্যায় ভাইয়া, তুম জো বোলেগা ওহি কারেঙ্গা হাম!
শ্রীপদ: সাবাশ রাম্বা, সাবাশ, ভাইকা বাহিন! দেখিয়ে হরি মেরা বাহিন সতী ও সত্যি রক্ষা কাররাহাহ্যায়!
শ্রীপদ রাম্বার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে শ্মশানে। দূরে রামু এবং কৃষ্ণার কাঁধে চলছে নারাছু ডোমের মরদেহ। পেছনে ডোমপাড়ার রাজালাল, নৃপেন্দু, কানাইসহ অনেক শ্মশান বন্ধু। মৃদঙ্গে তা-ব বাজায় কানাই। সবার মুখেই , ‘বল হরি, হরি বোল’।
(…………………………………………………..চলবে)
আগের পর্বগুলোর লিংক:
১. http://sonelablog.com/archives/12440
২. http://sonelablog.com/archives/12475
৩. http://sonelablog.com/archives/12531
৪. http://sonelablog.com/archives/12788
৫. http://sonelablog.com/archives/12859
৬. http://sonelablog.com/archives/12944
৭. http://sonelablog.com/archives/13003
৮. http://sonelablog.com/archives/13126
৯. http://sonelablog.com/archives/13269
১০. http://sonelablog.com/archives/13617
১১. http://sonelablog.com/archives/14926
১২. http://sonelablog.com/archives/17125
১৩. http://sonelablog.com/archives/17164
১৪. http://sonelablog.com/archives/17210
১৫. http://sonelablog.com/archives/17308
১৬. http://sonelablog.com/archives/17837
১৭. http://sonelablog.com/archives/17968
১৮. http://sonelablog.com/archives/18263
১৯. http://sonelablog.com/archives/18396
২০. http://sonelablog.com/archives/18643
২১. http://sonelablog.com/archives/19993
৬টি মন্তব্য
মিসু
শুয়োর এভাবে মারে নাকি?
সাতকাহন
ডোমদের নিজস্ব কালচার, এভাবেই ওরা মেরে থাকে।
শুন্য শুন্যালয়
নির্মম। হুম শুয়োর এভাবে জ্বালানোর কথা প্রথম শুনলাম।
সাতকাহন
ডোমদের নিজস্ব কালচার, এভাবেই ওরা শুয়োর মেরে থাকে।
স্বপ্ন নীলা
দারুন লাগলো —–দারুন লেগেছে —
সাতকাহন
ধন্যবাদ, স্বপ্ন নীলা