ISIS / ISIL / Waffen / @albaraka_news

গত পর্বে(বিশ্ব রাজনীতি বনাম আলকায়দা থেকে আইএস-বিহাইন্ড দি সিন।পর্ব-২ )  আমি যে প্রশ্নটা রেখে শেষ করেছিলামঃ কে এই ফিলিপ মার্শাল? চলুন উত্তর খুঁজি পর্ব তিন এঃ

৮০’র দশক থেকে পরবর্তী দীর্ঘসময় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র হয়ে কাজ করেছেন এই ফিলিপ। ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের(বুশের বাবা জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ তখন ভাইস প্রসিডেন্ট) গোপন কন্ট্রা চুক্তি, যার আওতায় গোপনে ইরানকে আস্ত্র (যদিও ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রির ব্যাপারে তখন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ছিল) দেওয়ার বিনিময়ে তেহরানে জিম্মি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন কর্মকর্তাদের মুক্ত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। একই দশকে নিকারাগুয়ার বিপ্লবী সান্দানিস্তা সরকারকে উৎখাতে কন্ট্রা বিদ্রোহীদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল সিআইএ। এমনকি কন্ট্রা বিদ্রোহীরা যাতে অবৈধ কোকেইন বিক্রি করে অস্ত্র কিনতে পারে সে জন্য মাদক চোরাচালানের রুটও গড়ে দিয়েছিল সিআইএ। ইরান ও নিকারাগুয়ায় সিআইএ’র এমনি অনেক বেআইনি কর্মকাণ্ডের নীরব সাক্ষী ছিলেন ফিলিপ মার্শাল।

(এখানে একটা তথ্য দিয়ে রাখতে চাই আপনাদের, নিকারাগুয়ার মত ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়, রাশিয়ার কারনে যেটা বাংলাদেশের সাথে করতে পারেনি রণতরী পাঠিয়েও , সেটা করেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্রে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদেই পাকিস্থানের দোসররা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে সমর্থ হয়েছিল)

বলছিলাম ফিলিপ মার্শাল প্রসঙ্গেঃ ইরান কিংবা নিকারুগুয়া নয়, ফিলিপ মার্শালকে নাড়িয়ে দিয়েছিল নাইন-ইলাভেন ট্রাজেডি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাইন-ইলাভেনের নির্ভুল নিখুঁত আর চৌকষ ধংসযজ্ঞ কৌতুহলী করে তুলেছিল এই সিআইএ পাইলট ফিলিপ মার্শালকে। সিআইএ’র মতো দাপুটে একটি সংস্থার পাইলট বিশেষ করে বোয়িং চালানোয় অভিজ্ঞ মার্শালের মনেও জেগেছিল হাজারো প্রশ্ন।

 pilotBig Bamboozleছবিঃ সিআইএ পাইলট ফিলিপ মার্শাল ও তাঁর নাইন-ইলাভেন ষড়যন্ত্র নিয়ে লিখা আলোচিত সেই বই।

সবার আগে তিনি যে প্রশ্নটি করেছিলেন সেটা হল “সরকারী ভাষ্য বলছে, বিশ্বের অন্যপ্রান্তের কোন এক গুহায় বাস করা কিছু ভূত (বিন লাদেন ও তার সহযোগী) আমাদের মাটিতে আমাদেরই পুরো সামরিক প্রতিষ্ঠানকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘটিয়ে চলে গেল আর আমরা কিছুই জানলাম না কিছুই করলাম না। এটা নিছক ছেলে ভুলানো গল্প ছাড়া আর কিছুই না”। নাইন-ইলাভেন ট্রেজেডি নিয়ে দশ বছরের গবেষনার পর ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত হয় ফিলিপ মার্শালের সাড়া জাগানো বই, The Big Bamboozle: 9/11 And The War On Terror । এই বইয়ে কংগ্রেসের যৌথ তদন্ত দলের অ-প্রকাশিত ২৮টি পৃষ্ঠার বেশকিছু অংশ ফাঁস করেছেন ফিলিপ। প্রসঙ্গতঃ মার্শালের সাথে সাবেক সিনেটর বব গ্রাহামের হৃদ্যতা ছিল(যার কথা আগের পর্বে জানিয়েছিলাম আপনাদের)।

বইটিতে মার্শাল বলেছেন, বিন লাদেন কিংবা আল কায়েদা’র লোকজন জুজু(জাদুকর) নয়। এক ইঞ্জিনের ছোট্ট বিমান নিয়ে প্রশিক্ষন চালানো কোন আনাড়ী কয়েকজন পাইলটও নয় তারা। বরং ১৯ জন হামলাকারীকে টানা ১৮ মাস ধরে ট্রেনিং দিয়ে দুনিয়া কাঁপানো এই হামলার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। লাস ভেগাস আর ফ্লোরিডারসহ যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি রাজ্যে চলেছে তাঁদের প্রশিক্ষন। বিন লাদেনের মূখোশ এর আড়ালে হামলার কৌশল প্রনয়ন, অর্থায়ন আর হামলাকারীদের প্রশিক্ষন দিয়েছে সৌদি আরব। হামলার আগেই সবদিক থেকে সেটি সফল করার মতো সমস্ত ডেমোনেস্ট্রেশন সম্পন্ন করা হয়েছিল হামলার অনেক আগেই। আর হামলার আগে পরে নানাভাবে নিষ্ক্রীয় থেকে প্রকান্তরে হামলাকারীদের সাহায্য করেছে বুশ প্রশাসন। কংগ্রেসের যৌথ তদন্ত কমিটির প্রধান পোর্টার গশ(রিপাবলিকান দলের কংগ্রেসম্যান পরে ২০০৪ সালে সিআইএ’র ডিরেক্টর), ফিলিপ জেলিকো(নাইন-ইলাভেন কমিশনের প্রধান) এবং এফবিআই ডিরেক্টর রবার্ট মুলার(৪সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত) এই তিনজনের রহস্যজনক ভূমিকা ও সত্য আড়াল করার চেষ্টা নিয়েও বেশ কিছু তথ্য প্রমান তুলে ধরেছেন ফিলিপ মার্শাল তাঁর বইতে।

Prince_Bandar_bin_Sultan_with_G.W._Bushfoysal ছবিঃ এই ছবিই বলে দেয় কেবল সোদি রাষ্ট্রদূত নয় তারচেয়েও বেশি কিছু ছিলেন প্রিন্স সুলতান বিন বানদার আল ফয়সাল।

এই ষড়যন্ত্রের দৃশ্যমান সূচনটা ছিল ২০০০ সালের জানুয়ারী মাসে। ওয়াশিংটনের সৌদি দূতাবাসে। নাইন-ইলাভেনের ঘটনায় যে মানুষটির সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ পাওয়া যায় তিনি হলেন ওয়াশিংটনে দুই দশকের(১৯৮৩ থেকে ২০০৫) সৌদি রাষ্ট্রদূত এবং কূটনৈতিক কোরের ডিন প্রিন্স সুলতান বিন বানদার আল ফয়সাল। ঠোঁটের কোণে সিগার আর অনৈসলামিক পানীয়’র ভক্ত খোষমেজাজি এই মানুষটি একাধারে সিনিয়র বুশ, বিল ক্লিনটন এবং জর্জ বুশ অর্থাৎ ডেমোক্রেট রিপাবলিকান দুই দলের চার প্রসিডেন্টের শাসনামলেই দাপুটে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সম্ভবত সেটা এ কারনে যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল প্রতাপশালী রাজনৈতিক পরিবার অর্থাৎ বুশ পরিবারের দুই দশকের বন্ধু তিনি। এই বন্ধুত্ব এতটাই প্রগাড় ছিল যে টেক্সাসে বুশ পরিবারের খামার বাড়ী, প্রেসিডেন্টের ক্যাম্প ডেভিডের অবকাশ কেন্দ্র এমনকি হোয়াইট হাউসেও প্রিন্স বানদারের সপরিবারে যাতায়াতের জন্য কোন পূর্ব অনুমতির দরকার হত না। ২০০৪ সালে প্রিন্স বানদারের বিলাশবহুল ব্যাক্তিগত বিমান A-340-এ আয়োজন করা হয় জর্জ বুশের বাবা এইচ ডব্লিও বুশের ৮০তম  জন্মদিন। সেখানে বুশ সিনিয়র মজা করে প্রিন্সকে, বানদার বুশ নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের অনুসন্ধানী সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড তাঁর State of Denial গ্রন্থে লিখেছেনঃ “বুশ তাঁর বাবা সিনিয়র বুশকে বললেন, আমি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার সিন্ধান্ত নিয়েছি। তখন জবাবে বুশের বাবা বিলেছিলেন, তুমি প্রিন্স বানদারের সাথে কথা বলো। বুশ তাই করলেন। প্রিন্সের সাথে দেখা করে তিনি বললেন, বাবা আমাকে বলেছেন আমি মনস্থির করার আগে যেন আপনার সাথে কথা বলি। সেই বুশ যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তখন প্রিন্স বানদার যেন রীতিমত ভাইস প্রসিডেন্ট।

হোয়াইট হাউসের প্রেসিডেন্ট দপ্তর কিংবা ক্যাবিনেটে বিনা নোটিশে-বিনা এপয়েন্টমেন্টে বানদারের ছিল অবাধ যাতায়ত। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা মজা করে প্রিন্স বানদারকে “টপ গান” নামে ডাকতেন। বলা হয় ২০০৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর ইরাক যুদ্ধের পরিকল্পনাটা প্রথম যার কাছে প্রকাশ করেছিলেন, তিনি প্রিন্স বানদার। কেবল সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র নয়। তাঁর প্রভাব ছিল পুরো মধ্যপ্রাচ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের সম্পর্কের যে কোন সংকটে, সেটা ৮৪ সালে ইরানের কন্ট্রা-অপারেশনে বিপুল অঙ্কের অর্থ দেওয়া থেকে শুরু করে ৯০ সালে ইরাকের কুয়েত দখল করা, প্যান আমেরিকান বিমানে লিবিয়ার হামলা, ১৯৯৩ সালে বৈরুতে বোমা হামলা এবং মেরিন সেনাদের প্রত্যাহার এমনি নানা সংকটে ছায়ার মত হোয়াইট হাউসের পাশে ছিলেন প্রিন্স বানদার। যেমনটা ছিলেন নাইন-ইলাভেনের দিন বিকেলবেলা জর্জ বুশের সাথেও। প্রিন্স বানদার আর প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশেকে তখন একসাথে হোয়াইট হাউসের বেলকনিতে সিগার টানতে দেখা গেছে। সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ যখন নো ফ্লাই জোন, তখন প্রিন্স বানদারের অনুরোধে রীতিমত বিশেষ প্রহরায় বিন লাদেনের পরিবারসহ যুক্তরাষ্ট্রে থাকা শতাধিক সৌদি পরিবারকে গোপনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেওয়া হয়।

তারপর কি ঘটেছিল কিংবা আর কি কি গোপন তথ্য ছিল ফিলিপ মার্শালের THE BIG BAMBOOZLE বইতে? প্রিন্স বানদারের আর জর্জ বুশের ষড়যন্ত্রের আর কি কি প্রমান ছিল মার্শালের বইতে? দিবালোকের মত এইসব সত্য প্রকাশের পর কিভাবে তাঁকে হত্যা করা হয় সপরিবারে? আমরা সবাই মিলে, মিলাবো তথ্য সুত্র, জানবো আগামী পর্ব-৪ এ

 

সবাই ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, চোখ-কান খোলা রাখুন, নিরাপদে থাকুন

।।শুভকামনা নিরন্তর।।

১৫১২জন ১৫১২জন
0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ