একসময় আমাদের মোংলাতে খাবার পানির খুব কষ্ট ছিলো। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেষে সুন্দরবনের পাশেই মোংলা শহরটা। সমুদ্রের লবন পানির সাথে তাই তাদের যুদ্ধ।
খাবার পানির তীব্র সঙ্কটে মানুষের জীবন খুব অস্থির ছিলো। টিউবওয়েল বসালেও তাতে লবন উঠত। দূর গ্রাম থেকে অর্থাৎ উজানের দিকে যে সব গ্রাম আছে সেখানকার পুকুর থেকে মিঠে পানি সংগ্রহ করতে হতো। ভ্যানে করে।
ঘরে ঘরে পানি পৌছে দেবার জন্য কিছু লোকও ছিলো যারা এটাকে জীবিকা হিসেবে নিয়েছিলো। মোংলাতে মাদ্রাসা রোডে পানির একটি ট্যাঙ্কি ছিলো। বড় একটা হাউজ ছিলো। সেখান থেকে এসব জীবিকার লোকেরা ভাড়ে করে তেলের টিনে( ওটাকে আগে পরিষ্কার করে নিতো) ভরে ঘাড়ের দু পাশে ঝুলিয়ে পানি নিয়ে হেঁটে হেঁটে মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌছে দিত। প্রতি টিন সম্ভবত পাঁচ টাকা ছিলো। এটা যে কতোটা পরিশ্রমের তা হয়তো আমরা উপলব্ধি করতে পারব না।
আমাদের বাসায় সকাল দশটার দিকে পানি দিয়ে যেতো। আমরা তখন মাদ্রাসা রোডের এক তলা একটি বাড়িতে থাকতাম। তখন হসপিটালের কোয়ার্টার তখনও রেডি হয়নি। আমরা ‘পানিওয়ালা’ বলতাম। উনি আমাদের বাথরুমের হাউজটা ভর্তি করে দিয়ে যেতো। আমরা সে পানি খেতাম ও গোসল করতাম। এসব পেশা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে এতোটা বেশি মিশে ছিলো যে একদিন তারা কাজ বন্ধ রাখলে আমাদের গোসল ও খাওয়ার পানির তীব্র সমস্যা দেখা দিত। আজ আর সে পেশা নেই। এবার গিয়ে আর তাদের দেখা পেলাম না। এখন মোংলাতে পানির লাইন হয়েছে। সে পেশাও তাই হারিয়ে গেছে কালের বিবর্তনে অন্য আরো সব হারিয়ে যাওয়া পেশার সাথে।
মোংলার বেশিরভাগ মানুষ এক বর্ষার পানি আর এক বর্ষা পর্যন্ত ধরে রাখে। আমাদের বাসায় বড় বড় মাটির কিছু মাইট ছিলো। তাতে পানি ভর্তি করে মুখে টিনের থালা দিয়ে কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখতো। একটার পানি শেষ হলে তা পরিষ্কার করে রাখা হতো। এক একটার মুখ খুললে দেখা যেতো তাতে কালো কালো পোকা কিলবিল করছে। আমরা সে পানি নীরে ঠিকই খেয়ে নিতাম। আমাদের বাসায় প্রায় চল্লিশ বছর বয়স হবে এমন দুটি মাটির মাইট আছে। মা ও দুটাকে খুব যত্ন করে। সিমেন্ট দিয়ে তাদের গায়ে লেপে দেয় দেখেছি।
গোসলের পর মাথায় কোনোরকম এক মগ বৃষ্টির পানি দিতাম সেখান থেকে। যেনো চুলে জট না বাঁধে। আমি অবশ্য চুরি করে মাকে লুকিয়ে একটু বেশিই দিতাম😛
খাবারের সময় আমাদের সামনে দুই ধরনের পানি থাকতো। একটা হাত ধোয়ার আর একটা খাওয়ার। আমি প্রায়ই খাওয়ার পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতাম। মা একটা চিৎকার দিতো। কিন্তু পরে সে চিৎকারে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম।
অনেকে কার্গো থেকেও পানি কিনতো। আমরাও মনে হয় কয়েকবার কিনেছিলাম। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা তখন নৌকা করে কার্গো থেকে পানি এনে বিক্রি করতো। কলসি প্রতি দুই টাকা ছিলো সম্ভবত। আমি তখন ভাবতাম! এতো মিষ্টি পানি এরা কোথা থেকে আনে? একবার কার্গোর লোকটিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল নদী থেকে। আমি মনে মনে ভাবলাম, নদীর পানি মিষ্টিও হয়? ইশ! সে দেশ জানি আবার কেমন। হা হা আজ সেই মিষ্টি নদীর পানির দেশেই আমার বিয়ে হয়েছে। ছোটো মনে কতো কতো ভাবনা খেলা করে। এখন ভাবলে অবাক লাগে আমার।
আমাদের হসপিটালের ছাদে বৃষ্টির পানি ধরার একটা সিস্টেম করে নিছিলো মা। ট্যাপ সিস্টেম। যাতে করে বৃষ্টির সময় বৃষ্টিতে ভিজে পানি সংগ্রহ করতে না হয়। সত্যিই! একসময় প্রচুর ভিজতাম বৃষ্টিতে প্রয়োজনের তাগিদে পানি ধরে রাখার জন্য। এ পরিস্থিতিটার সাথে মোংলার কম বেশি সবাই পরিচিত। পরে এ পানি ধরে রাখার কাজটা মুক্তাই বেশি করতো। একদিন প্রচন্ড ঝড় তার সাথে বৃষ্টি। বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে খুব। বাসার ছাদে মা ও মুক্তা পানি ধরতেছে। আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে দিব্বি শুয়ে আছি। বড় আপা বলল, তুই গিয়ে একটা ধমক দিয়ে আয়। নতুবা ওরা পানি ধরতেই থাকবে। আসলে বাসার গুন্ডামির কাজটাও আমাকে দিয়ে ভালো হয়। আমি কেবল এক সিঁড়ি উঠেছি, অমনি ছাদের গেটে ধুড়ুম এক শব্দ। মুক্তা চিৎকার করে বলল, ছাদের ও পাশের দেয়ালে কেউ আছে। সে দেখতে খুবই বিদঘুটে টাইপের। তার কান্না আর কিছুতেই থামে না। ওর ধারনা ও ভুত দেখছে। আসলে বৃষ্টি হলে রাত হোক বা দিন হোক পানি ধরাটাই মূল কথা।
একবার আমার বান্ধবী মানছুরা মুনাদের বাসায় পানি ধরা নিয়ে বাসায় উত্তম মধ্যম খাইছিলাম মার কাছে। কারণ, সেদিন আমাদের বাসায় পানি ধরার কেউ ছিলো না। বড় আপা নানা বাড়িতে তখন। ও নানা বাড়িতেই বেশি থাকতো। রিক্তা মুক্তা তখন ছোটোই। অনেক কাজে এজন্য মায়ের হাতে বেশ উত্তম মধ্যম আমি খেয়েছি। এখন এবার গিয়ে দেখলাম মোংলাকে ঘিরে থাকা বড় পশুর সে নদী এখন ছোটো হয়ে গেছে। মনে হলো এ এক অন্য শহর আমার। এ শহরের আমি কেউ না। আসলেই আমি কেউ না।
যাই হোক, আজকে বৃষ্টি হচ্ছে এখানে বেশ। বৃষ্টির কান্নার সাথে অতীত স্মৃতিও টপটপ করে ঝরে পড়ে সামনে। হাত দিয়ে ধরতে গেলে তা ঠিকই পড়ে যায় মাটিতে। হাতটা শুধু ভিজে যায়। শুষ্ক মাটিও তা শুষে নেয়। অতীত পৃথিবী থেকে বিলীন এটাও তার প্রমাণ।
১১টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
পানিওয়ালার গল্প শুনলাম। চোখে ভেসে উঠলো আমাদের সাধু বুড়োর। মোংলাতে যে এভাবে জল সংগ্রহ করা হতো আমার জানা ছিলোনা। তোমার লেখা পড়লে অনেক অজানা কিছু জানা হয়ে যায় আপু।
লিখে চলো অবিরাম।
ভালোবাসা! (3
মৌনতা রিতু
আমি ওনার কথা লিখতে গিয়েও লিখতে পারলাম না। লোকটি এতো কষ্ট করতো যে তার এক দন্ড থামার সময় ছিলো না।
ভালবাসয় রেখো আপু। -{@ (3
মাহমুদ আল মেহেদী
অনেক অজানা বিষয় জানা হল। ধন্যবাদ আপনাকে ।
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ ভাই। ভালো থাকবেন ভাই।
মোঃ মজিবর রহমান
ঘাড়ের দু পাশে ঝুলিয়ে পানি নিয়ে হেঁটে হেঁটে মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌছে দিত।–এটাকে আমাদের অঞ্চলে বাঊক বলে, মানে দই ওয়ালা যেভাবে দই বই।
নীরে- অর্থ নিংড়ানো।
জীবন যেখানে যেরকম। পানি ধরে রাখার এই নিয়ম এই প্রথম জানলাম।
মৌনতা রিতু
আপনাকে ধন্যবাদ। আসলেই জীবন যখন যেখানে যেমন।
মোঃ মজিবর রহমান
পানির অপরনাম জীবন।
আর বেঁচে থাকার তাগিতে অন্য পেশায় ।
জিসান শা ইকরাম
আমাদের বাসায় মাটির বড় একটি মাইট এখনো আছে। কোনো কাজে লাগেনা, তারপরেও আছে। শহরে পানি সাপ্লাই আসার সাথে সাথে এই পেশার মানুষজন বেকার হয়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। আমাদের শহরেও এমন পেশার লোক ছিল।
ডিপ টিউব ওয়েলের পানি খাবার জন্য আর রিজার্ভ পুকুরের পানি রান্নার জন্য এরা দিয়ে যেতো। আমরা এদের ভাড়ওয়ালা বলতাম।
বর্তমানে খাবার পানি ডিপ টিউবওয়েল থেকে কাজের বুয়া এনে দেয়, আর রান্নার পানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় বৃষ্টির পানি। বাসায় কয়েকশত প্লাস্টিকের বোতল/ ক্যান আছে। বৃষ্টির সময় পানি ধরে রেখে সারা বছরই এই পানি দিয়ে রান্নার কাজ চলে। আমি অবাক হই এই ভেবে যে এই পানি কয়েকমাস পরে ব্যবহার করলেও তা নষ্ট হয় না।
তোমার পোষ্ট গুলো সব সময়ই ভিন্ন ধরনের হয়,
এত আইডিও যে কোথায় পাও, আল্লাহ মালুম 🙂
মৌনতা রিতু
সত্যিই, পানির কষ্ট বড় কষ্ট।
প্রযুক্তির কল্যাণে এটা থেকে মুক্তি পেয়েছি আমরা।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
ছাইরাছ হেলাল
অতীত অবশ্যই বিলীন হয়, বিলীনতাই তার নিয়তি!! কিন্তু সবটা নয়,
যেমন এখানেই আপনার অগ্রন্থিত প্রথম প্রণয়!! যা এখানে আজ অনুল্লেখ্য-ই রেখেছেন! ( তা রাখুন)।
মাইটে রাখা কিলবিলে-পোকা-পানি খাওয়ার কথা সামান্যতে আগেই বলেছেন, এ-ভাবে সবিস্তারে জেনে ভাল লাগল।
কতদিন পরে লিখলেন তা হিসেব করা খুবই কঠিন, (অংকে ভালু না)
চাকুরিতে বেতন বৃদ্ধি হালো কীনা কে জানে!!
মৌনতা রিতু
অঙ্কে আমিও বড্ড কাঁচা। তবে অনেকদিনপর কবিগুরুকেও দেখতে পেলাম আজকে।
তবে আমি ডরাইনা কারো কন্ঠে।