(হাওর বন্দি)
“তৃতীয় পর্ব”
একবার ঘড়ির দিকে চোখ বুলালাম।
ঠান্ডা সিক্ত আবহাওয়ায় বিশালাকার গাছগুলো ডালপাতা ছড়িয়ে এপাশে ওপাশে ঝুঁকে পড়ছে।
সকাল সাতটা বাজতে পনেরো মিনিটের অপেক্ষা।খিদে পেয়েছে খুব।আশেপাশে নির্জনতা ব্যতীত অন্য কিছু দৃষ্টিগোচর হচ্ছেনা।দুর্বল শরীর নিয়ে হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে।থেমে গেলেও চলবেনা-এভাবেই পথের সন্ধান খুঁজে যেতে হবে।১৫ মিনিট ঝোঁপঝাঁড় মাড়িয়ে এগিয়ে চলার পর কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ালাম।নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।একটি মৃত রাজপথ-জং ধরা সাইনবোর্ড-অস্পষ্ট অক্ষরে লেখা ১৮— ।তার পাশেই স্টেশন কাউন্টার।প্রাচীন ঐতিহ্য বলে মনে হচ্ছে।একটি নগ্ন নারী মূর্তি-চোখগুলো গর্ত করে অসংখ্য পোকা কিলবিল করে ছুটছে।
মৃত বলার পেছনে যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে,তাই নয় কি?পিচ করা পাকা রাস্তাটি ঘাঁস আর জঙ্গলের আস্তরনে পুরোপুরি ঢেকে গেছে।আবছা আবছা বোঝা যাচ্ছে।মনে হয় গত দশ বছরে এই রাস্তা দিয়ে কোনো যান চলাচল করেনি।মানুষেের পদ চিহ্নও পরেছি কিনা সন্দেহ আছে তা নিয়েও।
চিঠিটার অপর পৃষ্টে চোখ বুলয়েছি কিছুক্ষণ আগে।মিন্নির অমন পরিনতি পাঠ করার পর এপাশে চোখ বুলাতে পারছিলাম না।ঘোলা হয়ে এসেছিলো অশ্রুভেঁজা চোখ জোড়া।
.
চিঠির অপর পাশে যা লেখাছিলো তা আরও ভয়ংকর কিছু -স্পিড বোডে করে হাওরের শেষ সীমান্তে ফেলে রেখে গেছে।জনবসতি হতে অন্তত এক’শ কিলোমিটার দূরে যার অবস্থান।জিরো পয়েন্ট খুঁজে বের করাই মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ।মাঝে মাঝে বন্য জন্তুর ডাক মৃদু স্বরে ভেসে আসছে।কি জানি!মৃত্যু হয়তো খুবই সন্নিকটে।নাকি হেঁটে হেঁটে মৃত্যুর উদ্দেশ্য গন্তব্যে এগিয়ে যাচ্ছি। শরীর তো নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।কি খাবো আমি!আশেপাশে অনেক পানি আছে।কয়েকবার বন্য পশুদের মতো চুকচুক করে পান করেছি।আহ!কি বিদঘুটে পঁচা গন্ধ।পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে নষ্ট বর্জ্য,গলিদ পঁচিত উদ্ভিদ প্রাণীর দেহের অবশিষ্টাংশ।তবুও খেতে বাধ্য হয়েছি।না হলে বাঁচবো কি করে।১২/১৩ ঘন্টা উপোস করে আছি।প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়েছে।
.
সেই পানির দুষ্ট প্রতিক্রিয়ায় গলগল করে বমি করে দিয়েছিলাম দু’দুবার।অমন নোংংরা পানি আরেকবার পান করলে জানটাই হয়তো বেড়িয়ে যাবে।অনেক অনেক বৃক্ষ জল ফোয়ারা অতিক্রম করে এলাম।একটাও ফলজ বৃক্ষ চোখে পড়লোনা।মিন্নি হয়তো বাবার বাড়িতে ফিরে গেছে।বাবা মায়ের অতি অদুরে সহজ সরল কন্যা।প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার মতো উপযুক্ত নয়।এমন প্রতিকূল মুহূর্তে ও পাশে না থাকাটাই ভালো হয়েছে।
ওর আর কিই বা করার আছে।এমন অবস্থায় আমিহীন হয়ে শশুরবাড়িতে উঠবেই বা কি করে!
.
মিন্নির জন্য যতটা খারাপ লাগছে,তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশী আফসোস হচ্ছে নিজের জন্য।আহা!কতো সহজে প্রাণটা বেড়িয়ে যাচ্ছে।কেউ নেই আশেপাশে।আমি আর নির্জন অরন্য ভূমি।
মানুষ যখন মৃত্যুর স্পর্শ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকে,তখন নিজের জন্য অসীম ভালোবাসা অনুভব করে,বুঝে যায় নিজেকেই সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে সে।তাই নিজেকে বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়।তেমনি সিচুয়েশন আমার।প্রতিটি পদক্ষেপে মৃত্যুর গন্ধ শুঁকছি।মাথার পেছনের আঁঘাতে বেশ বড় ক্ষতোর স্মৃষ্টি হয়েছে।রুমাল দিয়ে বেঁধে দিয়েছে।ব্যথা কমছেনা।ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে তীব্রতার রেশ।
.
ঘন্টা খানেক হাঁটার পর একটা কামরাঙ্গা গাছের দেখা পেলাম।
প্রাণটা আনন্দে কেঁপে উঠলো।এমন ক্ষুধার্ত প্রহরে এই রসালো ফলই বাঁচিয়ে দিতে পারে আমাকে-তা না হলে এখানেই মরে পরে কঙ্কাল হয়ে যেতে হবে।লাশটাও অংশীদারত্ব হারাবে।এমন মৃত্যু কিছুতেই আরাধ্য না হউক।আমাকে বাঁচতেই হবে। বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে পা’দুটো উঁচু করে একটা বড় কামরাঙ্গা ছিড়লাম।মুখে নিয়ে কামড় দিতেই জ্বলে যেতে শুরু করলো পুরো মুখপট।ও মাই গড!এ কেমন প্রাজাতির কামরাঙা তবে-এমন বিষাক্ত তেতো-সাথে মাত্রাতিরিক্ত এ্যাসিডিক ইফেক্ট।বেশ কিছুক্ষণ হাঁপানোর পর জ্বলনটা একটু কমে এলো।
থু থু নিক্ষেপ করতে গিয়ে দেখলাম জমাট রক্ত যাচ্ছে।মুখে আঙুল গুজে দিলাম।জিহবা এবং দাঁতের মাড়ির চারপাশে মারাত্নক রকম ক্ষত স্মৃষ্টি হয়েছে।সময়ের সাথে শরীরটা অবস হয়ে যাচ্ছিলো।একটিকে মাথার পেছনের ব্যথাটা অন্যদিকে নতূন ক্ষত।অজান্তেই অচেতন হয়ে পড়লাম।হাত পা নড়ানোর শেষ প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হলাম-হয়তো মরে যাচ্ছি।এই বুঝি নিঃশ্বেস হয়ে যাবো।আমিতো এমনটা চাইনা-তবে কেনো মরে যাচ্ছি এতো সহজে।সবকইছু ঘোলাটে হয়ে আসছে।বাবা,মা,ভাইয়া তোমরা কোথায়?
.
যখন চেতনা ফিরলো নার্সিং নিয়ন্ত্রনে নিজেকে আবিষ্কার করলাম।
চার পাঁচ জন পুরুষ-মহিলা আমাকে ঘিরে রেখেছে।কলাপাতায় করে কি যেনো বেটে মাথায় লাগিয়ে দিচ্ছে।
মুখে জঙ্গলীী তরল জাতীয় এনার্জেটিক কিছু একটা পাইপ দিয়ে ধরে রেখেছে।চোখে কপালে ভেঁজা স্যাঁতসেঁতে কিছু অনুভব করছি।
প্রচুর ঝাঁঝালো অনুভব সারা শরীর জুড়ে -যন্ত্রনায় কুঁকড়ে উঠছিলাম থেমে থেমে।বিন্দুমাত্র নড়াচড়া শব্দ করতে পারছিলামনা।ওরা বুঝে যায় আমার চেতনা ফিরেছে।এক মধ্য বয়সী মহিলা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অস্পষ্ট ভাষায় বললেন,ঘুমানোর চেষ্টা করেন বাবু।কোনো ভয় নাই।আমরা আছি পাশে।আপনার ভাগ্যটা বেশ ভালো।বন্য জন্তুর পেটে যাইতে পারতেন।
আবারও চোখ বন্ধ হয়ে এলো।এরপর ঘন্টা দুয়েকের গভীর ঘুম।এভাবেই বিকেল ঘনিয়ে আসে।
ঘুম থেকে জেগে শরীরটা আগের থেকে সবল মনে হচ্ছে।উঠে বসলাম।একটি যৌথ পরিবার।কাশ নির্মিত ছোটো সাইজের দু’টি ছুঁপড়ি ঘর।আশেপাশে আর কোনো জননিবাস দেখতে পাচ্ছিনা।ব্লাউজবিহীন শাড়ি পড়ে এক অল্প বয়স্ক মহিলা বাচ্চাকে দুগ্ধ পান করাচ্ছে।আমাকে দেখে লজ্জা পেয়েছে।ছুপড়ি ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো খুব দ্রুতই।
খোলা আকাশের নিচে হাড়িতে কাউনের ভাত চরানো হয়েছে।গন্ধ পেয়েই বুঝতে পারছি।পাশেই একজন বৃদ্ধ মহিলা পোঁড়া শুটকি ভর্তা করছেন।দু’জন যুবক গাছের ডাল দিয়ে সুচালো কি যেনো নির্মান করছে।তা প্রায় তিন/চার বছর আগের কথা-এক দরিদ্র বন্ধুর গ্রামে গিয়ে কাউনের ভাত খেয়েছিলাম।অতিরিক্ত ঝাল দিয়ে করা শুকটি ভর্তা দিয়ে খেলে অন্যরকম টেস্ট পাওয়া যায়।কিছুটা ভালো লাগছিলো মানুষেের বিচরন খুঁজে পাওয়ায়-মিন্নির কথা বারবার মনে পড়ছে।না জানি ও কোথায় আছে,কেমন আছে।আরেকটু সুস্থ হলেই আশেপাশের গঞ্জে পাড়ি জমাতে হবে।মোবাইলে যোগাযোগ করাটা একান্ত আবশ্যক হয়ে উঠেছে।এসব অপরিচিত মানুষকে সত্যটা না জানানোই ভালো হবে।অন্য কোনো কিছু বানিয়ে বলাই শ্রেয়তর মনে করছি।
(মাসুদ চয়ন)
১৩টি মন্তব্য
শামীম চৌধুরী
পড়ে ভালো লাগলো। যেহেতু আগের দুই পর্ব পড়া হয়নি তাই বুঝতে পারছি না এটা কি ভ্রমন কাহিনী কিনা? যদি ভ্রমন কাহিনী হয় তবে সাথে সুপেয় পানি থাকা জরুরী। খাবারের চেয়ে শুধুমাত্র পানি বেশ কয়েক ঘন্টা ক্লান্তি দূর করতে পারে।
আহা…! পোঁড়া শুটকির ভর্তা শুনেই খেতে ইচ্ছে করলো। পরের পর্ব পড়ার অপেক্ষায় রইলাম ভাই।
মাসুদ চয়ন
অনেক ধন্যবাদ,সময় নিয়ে পাঠ করার জন্য।এটা গল্প ছিলো দাদা।
শিরিন হক
একজন বিপ্লবী ব্লগারের জিবন্ত প্রতিচ্ছবি লেখায় দারুন ভাবে তুলে ধরেছেন। মরনের সাথে লড়াই করে অবশেষে বাচ্চার পথ তো খুজে পেলেন। নিম্মির প্রতি যে টান তার ভবনায় আর একটু নিয়ে আসতে পারতেন বিপ্লবীর কল্পনায়।
মাসুদ চয়ন
ধন্যবাদ আপু।এই পর্বে নিজেকে বাঁচাতেই হাঁপিয়ে উঠেছিলো শুভ্র-তাই অন্য কিছু সেভাবে ভাবার অবকাশ পায়নি।নেক্সট পর্বে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে-আশা করি ওই পর্ব্ব অমন ভাবনার উদয় হবে।
শিরিন হক
কঠিন বিপদে মানুষের প্রিয় মানুষের কথা বেশী মনে পড়ে।
পরের পর্বের জন্য রইলাম
মাসুদ চয়ন
যখন সেন্স কাজ করেনা ঠিকভাবে তখন নিজেকে বাঁচানোটাই বেশি গুরুত্বপুর্ন হয়ে ওঠে।আর এটা একটা পর্ব মাত্র।গল্পের চরিত্রতো স্বাধীন-তাই নয় কি।আপোস করে কি গল্প লেখা যায়।একেক চরিত্র গল্পে একেক রাতম এ্যাটিচিউড নিয়ে উপস্থাপিত হয়।আপনি মনে হয় চরিত্রটা পছন্দ করেননি এভাবে
মাসুদ চয়ন
যখন সেন্স কাজ করেনা ঠিকভাবে তখন নিজেকে বাঁচানোটাই বেশি গুরুত্বপুর্ন হয়ে ওঠে।আর এটা একটা পর্ব মাত্র।এরপর আরও অনেক পর্ব রয়েছে। গল্পের চরিত্রতো স্বাধীন-তাই নয় কি।আপোস করে কি গল্প লেখা যায়।একেক চরিত্র গল্পে একেক রাতম এ্যাটিচিউড নিয়ে উপস্থাপিত হয়।আপনি মনে হয় চরিত্রটা পছন্দ করেননি এভাবে।যা হউক-এখানে মৃত্যুর দাঁড়প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ নিজেকে শেষ রক্ষার প্রয়াস চালাচ্ছিলো মাত্র।আমার জানা মতে,অমন মুহুর্তে কমন সেন্সে অন্য কিছু ভাবার অবকাশ আশার কথা নয়।তবে গল্পতো,চাইলে সেভাবেও লেখা যেতো।কিন্তু,এভাবে হয়ে গেছে।আসল সত্যটি হচ্ছে,প্রতিটি মানুষেের সিন্স অফ হিউমার আলাদা,আপনি একভাবে চিন্তা করবেন,আরেক জন আরেক ভাবি,আমি আরেক ভাবে।এটা আমার ব্যক্তিগত থিংকিং মাত্র।গ্রহনযোগ্য হতেও পারে,নাও হতে পারে।
মাসুদ চয়ন
মন্তব্যে কিছু টাইপিং মিস্টেক হয়েছে।ধন্যবাদ আপনাকে সময় নিয়ে গল্পটি পাঠ করার জন্য।আমি গল্পটি একটু অন্যরকম আঙিকে লিখতে চেয়েছিলাম।শুভ্র চরিত্রে আবেগের চেয়ে বাস্তবতাকে বেশী প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলাল।এ জন্য চরিত্রটি এরকম লাগছে।কিন্তু-আমি ওভাবেই তাকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি
জিসান শা ইকরাম
লেখার মাঝে একটি কঠিন সত্যি প্রকাশ করলেন,
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ তার নিজের কথা আগে ভাবে,
একমাত্র ব্যতিক্রম মা। মা সন্তানকে বাঁচানোর জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
আকর্ষনীয় উপস্থাপনা,
পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা,
শুভ কামনা।
মাসুদ চয়ন
ধন্যবাদ দাদা।সবসময় ভালো থাকবেন
মনির হোসেন মমি
অল দা বেষ্ট।ঘটনার পরের পর্বের অপেক্ষায়।দৃশ্য চিত্রায়ণ খুব ভাল হয়েছে।একদম ।
মাসুদ চয়ন
ধন্যবাদ দাদা,ভালো থাকবেন সতত
সাবিনা ইয়াসমিন
মিন্নির জন্য যতট খারাপ লাগছিলো, তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগছে নিজের জন্যে। কত সহজে প্রানটা বেড়িয়ে যাচ্ছে “…. মৃত্যুদ্বারে পৌছে মানুষের নিজের প্রতি, নিজের জীবনের প্রতি মায়াবোধ টাকে সত্য আর বাস্তবতার সাথে তুলে ধরেছেন। গল্প প্রথম থেকেই খুব ভালো লেগেছে। এমন গল্প একজন স্বঘোষিত বিপ্লবী ব্লগারের জীবনী, প্রেম, শত্রুতা, মৃত্যু জয়, আবেগ, বিবেক নিয়ে সুন্দর পরিপূর্ণ গল্পটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুব সুন্দর করেই উপস্থাপন করেছেন। এমন জীবন ধর্মী গল্প আরো লিখুন।
শুভ কামনা 🌹🌹