মানুষ সৃষ্টির কাল থেকেই উৎসব আনন্দে মেতে উঠতে ভালবাসে। এ যেন এক প্রাণের খুদা। পৃথিবীতে প্রতিদিনের কঠিন বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে মানুষ উৎসবের আনন্দে কিছু সময় মেতে উঠতে ভালবাসে। উৎসবে হয় মানুষে মানুষের মিলন। এই মিলনের মাধ্যমেই উৎসবের সৃষ্টি ও তৃপ্তি। তাই উৎসবের কথা হলো মিলন। বিভিন্ন উৎসবের দিনে আমরা উদার, সকল প্রকার সংকীর্ণতা পরিহার করে আজীবন দীপ্ত হই। উৎসবের মধ্যে আমরা প্রেরণা লাভ করি। উৎসবের মাধ্যমেই আমরা বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হই। উৎসব এক আর মেলা এক। সব উৎসব মেলা নয়। সব উৎসবে মেলা হয় না। মেলার মধ্যে থাকে কোনো লোক কাহিনী, ও ধর্মীয় অনুসর্গ। মাহাত্ম থাকা দরকার এবং অবশ্যই আনন্দ।
বাংলাদেশের উৎসব, আমোদ-প্রমোদগুলির মধ্যে ধর্মীয় প্রবণতা বহু প্রাচীনকাল থেকে লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন দেব দেবী, পীর মাজার নিয়েও গড়ে ওঠে মেলার আয়োজন।
সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলা উপজেলায় চাঁনপাই গ্রামে মেলার আয়োজন হয়ে আসছে সেই যুগ যুগ ধরে। চৈত্র মাসে পনেরো দিনব্যাপী চলে এই মেলা।
রিতুর ছিল ছোটবেলায় এই মেলাতে যাওয়ার চরম নেশা। চৈত্রের ভরদুপুরে ফ্রক পরে গাঁটে দু’চার টাকা নিয়ে দৌড় দিত চাঁনপাইর মেলাতে। সাথে থাকত ওরই বয়সি এক ভাই কামরুল। কথিত আছে ওখানে এক মাজারকে উল্লেখ করেই এই মেলার আয়োজন হতো। যাইহোক, যেদিন রিতু দশ বিশ টাকা পেত খুশিতে আটখান হতো। মেলার উদ্দেশ্যে পথে যেতে যেতে বৃদ্ধ দাদিমা বয়সিদের পোটলা মাথায় করে পৌছে দিত মাজার পর্যন্ত।
একদিন ঠিক করল ওরা পুতুল নাচ দেখবে। কাপড়ে ঢাকা বেড়ার ফাঁকা দিয়ে টিকিট ছাড়াই ঢুকে গেল পুতুল নাচ দেখতে। ছোট ছোট জরির কাপড়ে মোড়ানো পুতুল গুলি হেলে দুলে নাচতে লাগল। কি চমৎকার এক নির্মল আনন্দ। ফেরার পথে কিনে নিতো মায়ের জন্য কাঁচা সবুজ গুয়োমুরি। পানের স্বাদ বাড়াতে যার জুড়ি নেই। কিন্ত রিতু নাগরদোলায় ভুল করেও উঠত না কখনো। যদি নিচে না নামে আর! শুন্যে যে ভয় বড় তার। দোলনায় তাই এখনো যে চড়েও না সে। বাদামের পাতায় মোড়ানো ছোলা বুট মুড়ি মাখা, ইশ! কি যে স্বাদ ছি্ল তা! সন্ধ্যা রবি বড়ই ব্যাকুল লাগত তার তখন। কেন যে এতো তাড়া থাকতো তার রাতের বুকে মুখ লুকানোর! আর একটু সময় হলে হাতির খেলা জমতো যে বেশ।
এ কালের মেলাতে নেই সেই মাটির গন্ধ আর। নেই সেই প্রকৃতির নির্মল আনন্দ। তবে এ কথাও ঠিক নতুন প্রজন্ম এ ভাবেই হয়ত তাদের আনন্দ খুঁজে নেয়।
রিতুর মেলা নিয়ে কিছু শব্দের গাঁথুনি আপনাদের ভাল লাগলে আমি কৃতজ্ঞ হব।
“ছোট খুকির মেলা”
ছোট খুকি মেলায় যাবে ফ্রক পরেছে,
দুইটি টাকা গাঁটি গুজেছে,
চৈত্রের মেলা, আহা! সেই চাঁনপাইর মেলা
তপ্ত দুপুরে পথে যেতে ধুলো মেখে ঘেমে নেয়ে একাকার।
নেই তবু এ চলার পথে ক্লান্তি তার।
ঐ যে মেলার শোরগোল শোনা যায়।
মেলায় আছে মন্ডা মিঠাই, গাঁটি আছে দুইটা টাকা ভাই।
আট আনার একটা কড়াই- হাঁড়ির জোড়া,
রাঁধব তো খাবে কে!
আরো যে চাই মাটির ঐ জামাই বউ ভাই।
কত হলো?
“আরো আট আনা”।
এই যে ক্রোচ পেতেছি দাট উঠিয়ে।
জামাই-বউ, হাড়ি-কড়াই টুংটাং বাজনা বাজে
খুকির ফ্রকের কোঁচের মাঝে।
মন্ডা মিঠাই, না হাওয়াই মিঠাই!
কোনটা যে খাই ;? বলতো ভাই
গাঁটি যে আছে একটা টাকা ভাই,
এই টাকার মাঝে মোর হরিন নাচে তা ধিন তাই।
মন্ডা মিঠা দারুন মজা, হাওয়াই মিঠা তা কেমন ভাই?
মুখে দিলে লাল হবে জীব?
হাওয়াই মিঠাতেই হবে বেশ।
ফিরছে খুকি মেলা থেকে, দাপটে চরন দুখান ফেলে।
এর পরে যে বৈশাখী মেলা।
খুকির মেলা -২
গোলাপী জামা তার, মাথায় এবার লাল ফিতার ঝুঁটি।
গাঁটি এবার পাঁচটি টাকা।
দুই দিল মা তিন দিল বাবা,
তা ধিন ধিন তা।
কতোরকম মেলার দোকান! চুরি ফিতে ;? না, তা যে চাইনে
ঐ যে নাগরদোলা , এক ঠ্যালাতে আকাশেতে
দমটা এবার গেল বুঝি! পাগলের দল মরবে নাকি?
পুতুল! গায়ে তার রঙিন জামা চুরি চুমকি আরো কতো কী
আমি কেন পুতুল হলাম না!
বাদাম গাছের পাতায় মোড়ানো ছোলাবুট দিচ্ছে উঁকি।
ছোলাবুট খাই চলো যাই।
হাওয়াই মিঠা ভাসে না হাওয়ায়,চরকা ঘোরে, জাল বোনে
মিঠা যে হলো এমন করে ভাই।
গাঁটি থাকলো আর দুই টাকা ভাই।
গুয়োমূরি মা আমার পানে খাবে
এক টাকার দাও তো ভাই।
জলদি আমার তাড়া আছে,
সাঁঝের বেলায় উঠোনে তাদের পুঁথি শুনব পুঁথি।
সেই পুঁথি বুঝি না আমি, তয় শুনি, পুঁথিতে কয় দুঃখের কথা,
সুখও আছে রাশি রাশি।
বৈরাগী, বোষ্টমী, গাজী কালু বনবিবি
আরো কতো গল্প।
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়লো বর্গী এলো দেশে
এই বর্গিদের গল্প।
পুঁথি কি ঘুম পাড়ানির গান!
এই যে চোখে ঘুম এলো আমার…………….।
১২টি মন্তব্য
অপার্থিব
যান্ত্রীকতায় বিদ্ধ নগর মানুষের কাছ থেকে মেলার আবেদন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিনে আগে চাঁদপুরে গিয়েছিলাম, সেখানে দেখলাম মাস ব্যাপি বিজয় মেলা হচ্ছে। গুগল করে জানলাম শহীদ জননী জাহনারা ইমামের উদ্যোগে শুরু হওয়া এই মেলা ১৯৯২ সাল থেকে সেখানে নিয়মিত আয়োজিত হচ্ছে। ্মেলায় মানুষের প্রচন্ড উচ্ছ্বাস দেখে সেদিন বেশ ভাল লেগেছিল।
মৌনতা রিতু
এমন সব মেলা নিয়ে ধারাবাহিক লিখব নাকি ভাবছি।
ভাল থাকবেন ভাই। লেখা কৈ? অপেক্ষা করছি লেখা দিন।
জিসান শা ইকরাম
বাহ! পোষ্ট পড়ে মুগ্ধ হলাম।
সব উৎসব মেলা নয়, এমন ভাবিনি কখনো।
সোনেলায় লেখকদের মাঝে খুব অল্প সংখ্যকই ব্লগ লেখেন, আপনি এই অল্প সংখ্যক ব্লগারদের মাঝে একজন হয়ে গিয়েছেন,
ব্লগার মৌনতা রিতুকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন -{@
কাপড়ের বেড়ার ফাঁক গলিয়ে পুতুল নাচ দেখতে যাওয়া ঘটনাটি পড়ে হাসি পেল খুব
দাদির বয়সিদের পোটলা মাথায় টেনে নিয়ে যেত রিতু, বাহ দারুন।
তা রিতুর মেলা নিয়ে শব্দের গাঁথুনি কি নতুন লেখা?
পিচ্চি রিতুর কাছে জিজ্ঞেস করে জানাবেন একটু?
মৌনতা রিতু
এই রিতুর মাঝে পিচ্চি রিতুর বসবাস এখনো বিদ্যমান। গতকালই বসে বসে ভাবছিলাম। লিখতে বসে দেখি কতো কি যে স্মৃতি মনে পড়ছে।
এই ছেলেমি শব্দগুলো আপনাদের ভাল লেগেছে শুনে ভাল লাগছে আমার। জানেন ভাইয়া, আজ পর্যন্ত লেখা একান্ত অনুভূতিরগুলির মধ্যে এই লেখাটাই নাকি আমার শ্রেষ্ঠ লেখা। এটা মেমন বলেছে।
জিসান শা ইকরাম
পিচ্চি রিতুর একান্ত অনুভুতির পোস্ট চাই আরো,
কবে পড়বো নতুন লেখা?
নীলাঞ্জনা নীলা
শান্ত-সুন্দরী চৈত্র মাসের ওই মেলা দেশের প্রায় অনেক জায়গাতেই হয়। ওটাকে চৈত্রের মেলা বলে।
আচ্ছা এই রীতু মেয়েটা আমার সাথে থাকলে ওর সব ভয় কাটিয়ে দিতাম আমি। আমি একটা পিচ্চিকে চিনি যে নাগরদোলা চড়তে খুব ভালোবাসে। ওই মেয়েটাও পুতুল নাচ দেখে দেখে মাথা দোলাতো সুরের তালে তালে। আর হাওয়াই মিঠাই, ইস আমারই তো জিভে জল চলে এসেছে। ওই রীতু পিচ্চিটা কি কটকটি নামক কোনো খাবার খেয়েছে? পৃথিবীতে ওই মিষ্টিগুলোর জুড়ি নেই, তাই না আপু? কটকটি, হাওয়াই মিঠাই, কাঠি লাগানো আইসক্রীম, বড়ইয়ের মিষ্টি আচার, ছোলা-বুট, মুড়ি-চানাচুর, ইস!
কতো পেছনের দিনে নিয়ে চলে গেলো তোমার এই একান্ত আপন কথাগুলো। ১০০ ভাগ স্বার্থক তোমার এই লেখা। মেমন সোনা ঠিক বলেছে এটা তোমার শ্রেষ্ঠ একান্ত অনুভূতি।
ভালো থেকো উৎসববতী মেয়ে। -{@
মৌনতা রিতু
সত্যি আপু, এইসব নির্মল আনন্দগুলো কখনোই ভোলার না।
কতোরকম যে মিঠা পাওয়া যেতো।
হুম, আমি বুঝতে পেরেছি ঐ পিচ্চিটা মিশরকন্যা।
মেমনের আইডি খুলতে বলি জিসান ভাইয়াকে। কিন্তু ও তো উত্তর দিতে পারবে না। শিখায়ে দিতে হবে।
অনেক ভাল থেকো আপু।
নীলাঞ্জনা নীলা
তুমি হ্যান্ডেল করবে। কিন্তু আইডিটা খুলে দাও। 😀
ছাইরাছ হেলাল
দৈনন্দিন কঠোর যান্ত্রিকতার ভিড়ে চিরাচরিত গ্রামীন মেলা গুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
হারাচ্ছে নির্মল হাসি আনন্দের ঐতিহ্য, যা ছিল আবহমান বাংলার আনন্দের উৎসভূমি,
তারপরও কেউকেউ তা প্রাণে বেধেছে তা দেখলে ভালই লাগে;
চলুক ভাল করেই,
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ।
ইঞ্জা
বাপ দাদার চৌদ্দগুষ্টির জম্ম শহরে বলেই আমিও শহুরে হয়েই রয়ে গেলাম, মেলাতো দেখিনি শুধু ঘুরে বেড়িয়েছি পাহাড় প্রান্তরে কিন্তু মেলা দেখা হয়নি বলে আফসোস রয়ে গেল মনে। ;(
মৌনতা রিতু
আফসোস করেন না। মোংলাতে এখনো সেই মেলা হয়। ঘুরে আসুন এক সময়।