ভাঙড় শাহর কথা শুনে বনবিবি ভাটির দেশে আসিল। জঙ্গল কাঁপিয়া জঙ্গাল শাহ্ আজান দিল। আজান শুনিয়া দক্ষিণ রায় চঞ্চল হইয়া উঠিল। এবং সে বুঝতে পারল “আসিয়াছে দোছরা সে আর” তখন দক্ষিন রায় তার চেলাদের হুকুম দিল আক্রমণকারীদের হটিয়ে দিতে বলিলঃ
ভাগাইয়া দেহ তাকে কোথা হতে এসে হাঁকে।
নাহি কি জানে, সীমানা আমার”?।
চেলাগন হুকুম তামিল করিতে গিয়ে বনবিবি আর জঙ্গাল শাহকে দেখে ভয়ে পালিয়ে যায় এবং দক্ষিণ রায়কে খবর দেয়।।
বলেঃ
এক মর্দ্দ, এক বিবি, কি কব দোছরা ছবি,
রূপে বন হয়েছে উজ্জল, বদনে মিলছে খাক,
বন্দ করে দুই আঁখ, তসবি হাতে বলে, আল্লাহ আল্লাহ”।
এই খবরে দক্ষিণ রায় রাগে জলে ওঠে এবং মন্ত্রীকে ডেকে রন সজ্জার আদেশ দেয়। কিন্তু দক্ষিণ রায়ের মাতা রায়মণী যুদ্ধের সংবাদ পেয়ে পুত্রকে ডেকে সস্নেহে বলেঃ
ব্যাটা তুমি ! লড়াইতে যাব আমি, আওরতের সাথে না লড়িবে তুমি।
কপালেতে আছে যাহা, অবশ্য হইবে তাহা, হেরে আইলে অক্ষ্যাতি হইবে।
তুমি কথা রাখ মোর, মনে হাসি হবে তেরা, তুমি থাক আমি যাই যুদ্ধে।”
বীর পুত্রের পক্ষে নারীর সংগে যুদ্ধ করা অমর্যদা মনে করে মাতা রায়মণি বীরঙ্গনার বেশে বহু সৈন্য সামন্ত নিয়ে যুদ্ধে যাত্রা করে। সেই যুদ্ধের সংগি ছিল বহু ভুত প্রেত।
বনবিবি রায়মনিকে ভূতপ্রেত সহ কড়া বাজিয়ে যুদ্ধে আসতে দেখে ভিই জঙ্গালি শাহকে আজান দিতে বলিল। তখন জঙ্গালি শাহ জোরে আজান ছাড়িল।
“আজানের ডরে ভূত না পারে টিকিতে, দেও দানব সকলি ভাগিল,ভেগে যায় লাখ লাখ, মুখে নাহি সরে বাক, রায়মনি পড়ে ভাবনায়”।
এদিকে বনবিবি,”আশা একহাতে লিয়া, তাতে দেওয়া ক্ষুক দিয়া, ফেকিল আছমন তরফেতে। এছমের জালে ঘুরে। যেমন ঝনঝন গেরে ডাকিনি সবার উপরেতে।” এরপর রায়মনি যতো ডাকিনি যোগিনী এনেছিল,”গেল সব লাহজায় মরিয়া”। রায়মনি তবুও দমিল না। বরং নিজেকে আরো রণসজ্জায় সাজিয়ে তৈরি হল, এবং ধনুকে কঠিন কঠিন বান প্রয়োগ করিতে লাগিল। যুদ্ধ করতে করতে রায়মনির সমস্ত বাণ যখন নিঃশেষ হয়ে গেল তখন রায়মনি রথ থেকে নামিল গোস্বা হইয়া। আর হাতে এক ধারালো ছোরা নিয়ে বাঘিনীর মতো বনবিবির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এবং বনবিবির বুকের উপর সজোড়ে ছুরিকাঘাত করিল। কিন্তু কি আশ্চার্য, বনবিবির বুকে সেই ছুরি ফুলের মতো ঘুরতে লাগল। তখন ভয়ে রায়মনি দেখে বলে একি অবতার ! না লাগে বিবির গায়ে ছুরির আঘাত, ফুল হইয়া পড়ে। তবুও রায়মনি দমবার নয়। আরো ক্রুদ্ধ হয়ে বনবিবির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।সে আক্রমনও ব্যার্থ হল। তখন কোনো উপায় না দেখে মরিয়া হয়ে ছুটে এসে বনবিবির কোমর ধরে যুদ্ধ আরম্ব করল। এ দৃশ্য ছিল এমনঃ
”হাতাহাতি করে যেন মস্ত হাতি লড়ে,ভিড়ন হইল যেন পাহাড়ে পাহাড়ে। সারাদিন লয়ে দোহে কেহ না পারিল, ”
বনবিবি বরকতে স্মরণ করতে থাকে। বরকত জানতে পেরে , খোদার হুকুমে এক দোয়া বনবিবিকে দিল। “বরকতের দোয়াতে বনবিবি পাইল যে জোর। পাক দিয়ে ধরে রায়মনির কোমর, উঠাইয়া ছের হরে জমিনে ডালিয়া, আল্লাহ্ নাম নিয়া বসে ছাতি দাবাইয়া, চুলের মুঠি ধরে জবাই করতে যায় ছুরি ধরিয়া। রায়মনি বুঝতে পারে মৃত্যু নিশ্চিত বনবিবির হাতে। তখন সে আত্নসমার্পন করঘ সন্ধি করতে চায়। বলিলঃ” পাও ধরি তোমার, মাপ করি দেও মোর তকছির”। এই কথা শুনে দয়ার জননী মা বনবিবি রায়মনির বুকের উপর থেকে নেমে নিজের আসন গ্রহন করল। এবং বনবাসি সবাইকে ডাক দিল। তারা সবাই ভাটিশ্বরীর সন্মানে নজরানা নিে উপস্থিত হইল। চারিদিক আনন্দের সাড়া পড়ে গেল। বনবিবি তখন সকলের সামনে বলিলঃ
“বনবিবি বলে সই শোন বিবরন।
বাটিয়া আটিয়া ভাটি লইব এখন।।
কদাচ মনে কারো দুঃখ নাহি দিব।
সমান করিয়া বাদা কাটিয়া লইব।।”
কথামতো বনবিবি কারো মনে দুঃখ না দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে আঠারোভাটি রাজ্য শাসন করতে লাগল। এই মহত্বে বনের প্রধানগন খুবই সন্তুষ্ট হয়ে ভাটেশ্বরি বনবিবির আনুগত্য স্বীকার করে এবং সর্দ্দার বলে মানবে এই অঙ্গিকার করল। আরো জানা যায় যে বনবিবির দক্ষিণ সীমানা ছিল এড়োজোল উত্তর সীমানা ছিল হাসনাবাদ। দক্ষিণ রায়কে কোদাখালি দিয়েছিল। আর নিজে বহু বাদা সৃষ্টি করেছিল। এইভাবে সারা সুন্দরবন বা বাদায় স্বীয় বাহুবল ও সিদ্ধিবলে সম্রাজ্য বিস্তকর করে সাম্য ও ন্যায় নীতির সঙ্গে রাজত্ব করেছিল। এমনকি চরম শত্রু রায়মনির সাথে এমন একটি যুদ্ধের পরেও বন্ধুর মতো পাশে থেকে সবার মন জয়করে বহু পরিশ্রম করে বাদাবনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পরিভ্রমন করে গ্রাম বসিয়েছিল এবং মোম মধুর সন্ধান করেছিল।
বনবিবির এই কাহিনীর সংগে আর একটি কাহিনী যুক্ত হয়ে আছে। যে কাহিনী সুন্দরবনের সর্বত্র আজও প্রচলিত এবং কেন প্রচলিত সে ব্যাখ্যাও পাওয়া যাবে এ কাহিনীর অভ্যন্তরে। তাই পরবর্তী কাহিনীর অপেক্ষায় চলবে,,,,,,,
কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি এই বইটির লেখকগন ও সম্পাদক রাজিব আহমেদকে। এটি সুন্দরবনের ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি বই।
ধন্যবাদ সবাইকে।
১৭টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
বনবিবির কাহিনী পড়লাম,
জানলাম কিভাবে তিনি সুন্দরবনে আধিপত্য বিস্তার করেন।
আমার ফার্মে সাতক্ষীরার বেশ কিছু ষ্টাফ আছে, সুন্দরবনে যায় এরা মাঝে মাঝে, মধু আনাই আমি এদের মাধ্যমে। এরাও সুন্দরবনে যাবার আগে বনবিবির নাম উচ্চারন করে, মানত করে।
লিখতে থাকুন এমন লেখা।
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ ভাইয়া, মন্তব্য ছোট করলাম শুধু সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে। কারন পোষ্টটি বড় করে দিতে হবে। তবে ভাইয়া, আমাকে কেউ পোষ্ট সম্পর্কে প্রশ্ন করছে না ! এইটা হল ?
ছাইরাছ হেলাল
বনবিবির কথা আপনার এ লেখা না হলে জানাই হতো না।
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ ভাই, বানান ঠিক করার যে খাটুনিটা দেই সেই জন্য।
ছাইরাছ হেলাল
বানান ঠিক করার ব্যবস্থা আছে নাকি!
আমার প্রচুর ভুল হয়, ঠিকঠাক করিয়ে নিতাম।
মৌনতা রিতু
আপনার বানান ভুল হয় ! তাইলে আমারে দিয়েন, ঠিক কইরা দিমুনে। :D)
আবু খায়ের আনিছ
জানার অপেক্ষা…………….. লিখতে থাকুন আপু।
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ।
ব্লগার সজীব
মৌনতা আপু, আপনার এমন ধরনের লেখার প্রশংসা করার ভাষা আমার জানা নেই। আপনার গত সিরিজ এবং বর্তমান সিরিজ সোনেলার অলংকার হয়ে থাকবে। এ বিষয়ে ইতিপূর্বে কোন ব্লগার লেখেননি। ধন্যবাদ আপনাকে।
মৌনতা রিতু
আমি চেয়েছিলাম কেউ প্রশ্ন করুক, করে নাই। :D)
ছোটট করে তাই ধন্যবাদ দিলাম, হাসমুখ ভাই।
পরে বর্গির পর্বটা আরো বড় করে দেবার ইচ্ছে আছে। তবে বড় একটা পান্ডুলিপি তৈরির ইচ্ছে আছে। সবার কাছে দোয়া চাই।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু সাধু সাধু!
চলুক, আরোও জানতে থাকি।
মৌনতা রিতু
তাই না ! ধন্যবাদ।
মিষ্টি জিন
প্রথমে বন্দনা করি আল্লাহ নবীর নাম , তারপর বন্দনা করি বনবিবির নাম..
হা হা হা ., পুথী পরার চেষ্টা করছিলাম.. অসাধারন লেখা , খুব ভাল লাগছে সিরিজ গুলো। -{@
মৌনতা রিতু
পুঁথি পড়তে হয় সুর করে। আমার নানি বাড়িতে শুনতাম একসময়। এই পুঁথিগুলো যখন সুর করে আমার ছেলেদদের শুনাই ওরা খুব মজা পায় ও হাসে। ওর বাবার হাতে থাকে অভিধান।
এ এক মজার কিছু সময় কাটে আমাদের।
ধন্যবাদ পুঁথি পড়ার জন্য।
মিষ্টি জিন
জী আপু পুথী সুর দিয়ে পড়তে হয়। অনেক আগে বিটিভিতে পুথী পাঠের অনুষ্টান হোত ,আমি আর আমার মা খুব মনযোগ গিয়ে পুথী পাঠ শুনতাম । খুব ভাললাগতো শুনতে একটু আধটু পুথী পড়তে ও পারি ।
বাচ্চা দের পুথীপাঠে আগ্রহ দেখে ভাল লাগছে আপু..
অলিভার
চমৎকার সব উপমা সমৃদ্ধ লেখা। লেখা পড়তে গিয়ে বারবার পুথি পাঠ শোনার মত একটা অনুভূতি কাজ করছিল।
জানলাম অনেক কিছুই। কৃতজ্ঞতা জানবেন 🙂
মৌনতা রিতু
আমার দুই ছেলে অপেক্ষায় থাকে কখন মা সুর করে পুঁথি পড়ে শোনাবে। ওরা হাসে খিল খিল করে।
ধন্যবাদ রইল পুঁথিগুলো পড়ার জন্য।
এরপর দেখছি #শ্লোক# দিতে হবে ব্লগে।