
বাংলাদেশের হিন্দু বিবাহ আইনে যে ডিভোর্স নাই এই অদ্ভুত তথ্য আমি জেনেছি বছর তিনেক আগে পরিচিত একজনের ডিভোর্স হবার সময়ে। ল’ইয়ার বলল হিন্দু আইনে ডিভোর্স নাই। এমন হলে তারা যেটা করে তা হলো স্ট্যাম্প পেপারে পাত্র পাত্রী আর সাক্ষীর সাইন নিয়ে নোটারী পাবলিক করে রাখে। ওইটাই পেপার যেখানে লেখা থাকে একজন আরেকজনের উপরে ভবিষ্যতে আর কোনো দাবী করবে না! মানে একটা মনের সান্ত্বনা বাস্তবে হিন্দু বিবাহ আইনে কোনো ডিভোর্স নাই।
এইটা ২০২১ সাল! কোনো আদিম যুগতো না যে ডিভোর্স করার অধিকার থাকবে না মানুষের। আর একই দেশে বিয়ের আইন আলাদা কেন হবে? সবার জন্য বিয়ে রেজিষ্ট্রেশন আর বিবাহ বিচ্ছেদ আইন থাকা উচিত। হিন্দু বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন এখনও ঐচ্ছিক, বাধ্যতামূলক না। মানে না আছে বিয়ের দলিল না আছে ডিভোর্সের অধিকার, না আছে মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার। কি চমৎকার!
বিয়ে রেজিষ্ট্রেশনের কথা বললে অনেকে বলে আমাদের বিয়ে ভাঙে না, আমরা অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করি! হিহি …। ভাই এসব প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা বলতে আইসেন না। বিয়ের দলিল বা ডিভোর্স কিছু না থাকায় ছেলেদের সুবিধা তো খুব। ইচ্ছে হলেই আরেকটা বিয়ে করে ফেলতে পারবে। সে সংখ্যা হয়তো অনেক না কিন্তু এমন তো হয়ই। না আছে ধর্মের বাঁধা না আছে আইনের। চাইলে সে বউরে রেখে নাচতে নাচতে আরেকটা বিয়ে করে ফেলবে। যারা একটু প্রতিষ্ঠিত সেসব মেয়ে হয়তো মামলা করে বা তাদের সাথে এমন করা সহজ না। কিন্তু দরিদ্র পরিবারে মেয়েদের অবস্থা খুব খারাপ। আমাদের বাড়িতে আজ অব্দি মায়ের যতোগুলা গৃহসহকারী মহিলা ছিলো সবাই স্বামী পরিত্যক্তা। বর আরেকটা বিয়ে করে এই বউকে আর নেয় না। এরপর তাদের না জায়গা হয় শ্বশুরবাড়ি, না বাপের বাড়ি, না পায় আইনি সাপোর্ট, না পায় খোরপোশ। বাপের সম্পত্তির অধিকার তাদের নেই। এরা যাবে কই! আরও কি কি দিন এদের দেখতে হয় তা নিজে গ্রামে থাকি বলেই দেখেছি। সে সব কথা আর লিখলাম না। এরপর যদি মেয়ে মুসলমান কাউকে বিয়ে করে তখন আবার হিন্দুরা হৈ হৈ করে ওঠে। অথচ স্বামী পরিত্যক্তা, ডিভোর্সি বা বিধবা মেয়েদের বিয়ে করতে হিন্দু ছেলেদের খুব ইয়ে হয়।
আমার নিজের এক কাজিন দাদা এক সকালে ১৫ বছরের বিয়ে করা বউ রেখে গ্রামের ব্রাহ্মণ পাড়ার এক মেয়েরে নিয়ে ভেগে গেলো, বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে এলো। এরপর কতো কান্ড…. দুই বউ একসাথে সংসার করে এখন। তবে যে মেয়েগুলো যাদের স্বামী নেয়না এরা কোথায় যাবে? কি করবে? সবাই শিক্ষিত? সবার জব আছে? আর জব থাকলেও সে কেন বাবার সম্পত্তি পাবে না? যার বর অত্যাচারী সে কেন স্বামীকে ডিভোর্স দিতে পারবে না? কেন খোরপোশ পাবেনা? যে স্বামী পরিত্যক্তা সে কি করবে? আজীবন একা থেকে সংস্কৃতির উন্নয়ণ করবে? তার জন্য আপনাদের হিন্দু আইনে কি ব্যবস্থা রেখেছেন?
হিন্দু পারিবারিক আইনের সংশোধন কেন করেনা? নেতারা বসে বসে কি করে? কিছু নতুন করতে গেলেই আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি অমুক তমুক বলে বসে থাকে। অথচ ইন্ডিয়া এসব আইনে কতো এগিয়ে। নাকি তাদের চেয়ে তোমরা আরও বেশি হিন্দু? মেয়েরা মা আমাদের, দেবীর পূজা করি আমরা এসব শুধু না বলে এই জিনিসগুলোতে একটু হাত দেন। চোখ বন্ধ করে থাকলেই তো আর সব সমাধান হয়ে যাবে না! কিছু না হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় একটু ঘুরে আসেন, শুধু মধ্যবিত্ত নয় প্রান্তিক নারীদের দেখেন। এদের জন্য কিছু করার নেই? এই আধুনিক যুগে বসে মান্ধাতার আমলের আইন নিয়ে আর কতো? এই আইনটা সম্পর্কে ডিটেইলস জানতে চাই।
পুস্পিতা আনন্দিতা,
নিউইয়র্ক।
৫টি মন্তব্য
ফয়জুল মহী
একটা জটিল এবং বাস্তব সম্মত লিখা লিখেছেন। আমার গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায় লোকজন আছে দেখি নারী এইসবে প্রচুর কষ্ট পায়। এই অমানবিক প্রথা নিয়ে কেউ কিছু বলে কেনো জানি না
পপি তালুকদার
আইন নিয়ে পড়তে গিয়ে জানতে পেরেছি হিন্দু আইনে ডিভোর্স নাই।এর কারন বিয়েতে রেজিষ্ট্রেশন করা হয়না সনাতন পদ্ধতিতে বিয়ে হয়ে থাকে।যাই হোক সময়ের সাথে তা আজ বেমানান বৈকি। এটা সংষ্কার করা দরকার।
রোকসানা খন্দকার রুকু
বাপরে অসাধারণ লিখেছেন। কিছু মনে করিয়েন না সমাজের অধিকাংশ সমস্যা হিন্দু প্রথা থেকে এসেছে। যা মুসলিমদের মধ্যেও প্রবাহমান। পরিবর্তন অবশ্যই দরকার।
আরজু মুক্তা
আমি অনেক কিছু প্রথম জানলাম। নতুন করে ভাববার সময় এসেছে।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
নিয়মের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীদের নাভিঃশ্বাস উঠে গেছে। ডিভোর্সের বিষয়টি খুব ভোগাচ্ছে কারণ আইনি কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বিয়েতে। ইদানিং এই বিষয়টি যুক্ত হয়েছে হিন্দু আইনে। সনাতনী রীতির পাশাপাশি রেজিষ্ট্রি করে বিয়ে অনুমোদিত হয়েছে, সম্পত্তির বিষয়টি ও অনেকখানি সংশোধিত হয়েছে শুনলাম।