
আউলা বাতাসের ঘোর লাগা এক সন্ধ্যা।সারাদিনের খাটুনির পর বাইরে বের হয়ে হঠাতই ভালোলাগায় নিজেকে কেমন উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। আমার তিনি এসময় অফিসের সামনে এলোচুলে এসে হাজির।
আমি ভাবলাম, বাতাসে বোধহয় তার চুলের এ হাল। পাশে কফি শপে নিয়ে গিয়ে চুল ঠিক করে দিতে দিতে বললাম, কি হয়েছে আমার পটলু বাবুর!
আমায় কাঁদো কাঁদো শুকনো গলায় সে বলে, আর রাখো তোমার সোহাগ। বাবা এসেছেন গ্রামের বাড়ি থেকে। লাঠি নিয়ে আমার বাসায় বসে আছেন। মেয়ে ঠিকঠাক। আমি কোনমতে বাহানা করে বের হয়ে তোমার কাছে এলাম। আজ যদি আমরা বিয়ে না করি তাহলে আর কোনদিনই আমি তোমার হতে পারবো না।
হুমম, গভীর চিন্তার বিষয়। কারণ ঘটনা তো সেই বরাবরের। শশুর মশাই এর আগেও বড় ছেলের বিয়ে ঠিক করেছিলেন। এলাকার স্বনামধন্য কোর্টের পি, পি সাহেবের ভাতিজী। এদিকে আলি আবেদ তো আমার সাথে এনগেজড। তবে নামের মর্যাদা রাখতে মহাবীর আলির মতো, প্রধান শিক্ষক বাবার সামনে কথা বলার সাহস তিনি রাখেন না। সেদিনও তিনি মায়ের সাহায্যে পালিয়ে বেঁচেছেন।
এরপর বাড়িতে সবার ছোট ছেলেকে বিয়ে করানো হয়েছে। না হলে সবাইকে পি পি সাহেব চৌদ্দ সিকে লটকিয়ে রাখতেন।
বাপের বাধ্য ছোট ছেলে তখনও ডুয়েটে পড়ে। সে তার থেকে পাঁচ বছরের বড় মেয়েকে বিয়ে করে বউ বানিয়ে বাবাকে বাঁচিয়ে ফেলেছে।
আবিদ যখন আমাকে এ ঘটনা বললো। আমি তো হেসে কুটি কুটি। যাক আর কিছুদিন ঘোড়া বেঁচে ঘুরে বেড়ানো যাবে। সিরিয়াল যখন শেষ থেকে শুরু হলো। তখন আমাদের তো অনেক দেরী।
সেই থেকে শশুর মশাই আমার উপর দারুন খেপা। আমাকে কোনভাবেই বউ বানাবেন না এমন পণ করে বসে আছেন। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তার বড় বোনের।
‘কু’ ‘ক’ দিয়ে শুরু এমন নামের সাথে তার চরম শত্রুতা। তার ধারনা এই মেয়েরা অপয়া হয়। নড় বোনের মতের সাথে শশুর মশাই পুরোই একমত। তাই ‘ক’ ‘কু’এলাকার মেয়ে, বংশের মেয়ে যতো ভালোই হোক। তাদের সাথে সম্পর্ক মানে সর্বনাশ।
সবচেয়ে বড় কারণ দব্রম্মপুত্র নদীতে ভেসে এক পীর বাবা আউলিয়া এসেছিলেন। বোন পীরে বিশ্বাসী। তাই শশুর এবং তার বোন ছেলেদের হাত, রাশি এসব পীর বাবার কাছে দেখিয়ে জেনেছেন। পীর বাবা সাবধান করেছেন কঠিন ভাবে। ছেলেদের বিয়ে ‘কু’ বা ‘ক’ নাম, টাইটেল, এলাকা সম্পর্কিত কোন মেয়ের সাথে করানো যাবে না। ছোট ছেলের ধারে কাছেও তিনি এসব ঘেঁষতে দেননি। বাকি দুজনেরও দেবেন না।
আবিদ আমার প্রেমে হাবুডুবু খাবার পর নাম জেনেছে। সে কিছুদিন মরা মাছের মতো উল্টে ছিল। তারপর নিজে নিজে বলে, যাও কি হবে হোক! শশুর মশাই এ খবর জানার পর আমার হাত থেকে ছেলেকে বাঁচাতে মরিয়া। তাই বিয়ে থেকে আবিদ একবার পালিয়ে বেঁচে গেলেও আর না। এবার তার ফাইনাল ডাক।
আমার আর বাতাসে নিজেকে উড়িয়ে দেয়া হলো না। চুমু খেতে খেতে যখন কথা দিয়েছিলাম তখন ক্যামনে কথা ফেরাই। তাই নতুন ঠোঁটের মায়া ছেড়ে কাজি অফিসেই নিজেকে উড়িয়ে দিলাম। কপালের নাম গোপাল তাই রাতে আর বাসায় ফেরা গেলো না কারন শশুর মশায় লাঠি নিয়ে বসে। কোথায় যাওয়া যায় এ ভেবে রাস্তায় খুব হাটলাম দুজন। তারপর কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চেপে লাপাতা।
পরদিন লাঠি হাতে তিনি তথ্য অফিস। আবিদ তথ্য অফিসে তার বস মুনতাসির ভাইকে সব রাতেই জানিয়ে রেখেছিল। বস হিসেবে তিনি অসাধারণ! শশুর মশাই তার ছেলের খোঁজে বেরিয়েছেন এটা জানার পর তিনি রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লেন,
– ও তো একটা ফাঁকিবাজ ছেলে। প্রায়ই অফিস ফাঁকি দিয়ে এক মেয়েকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তথ্য অফিসার হিসেবে তার অনেক বদনাম। এবার এলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
চাকরি যাবে না কিন্তু যায় যায়। অবস্থা বেগতিক এই চিন্তায় শশুর মশাই তারাতারী সেখান থেকে কেটে পরলেন। আমরা সপ্তাহ পরে মিনি হানিমুন সেরে ফিরলাম।
আমার মতো একটা বেখাপ্পা মেয়ের জন্য সব শেষ। এই রাগে বছরখানেক অবধি শশুর বিয়েই মেনে নিলেন না। শাশুড়ী মা শুধু মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে আমাদের বেহাল সংসারের খোঁজ নেন।
বেহাল বললাম, কারণ আমাদের কোন কিছুই ঠিক নেই। অনেক সময় মেয়েরা কাজ না পারলে ছেলেরা গুছালো হয়। আবিদ কিচ্ছু কাজ পারে না। দাদী বুয়া সকালে আসে। আমরা মোটামুটি সুন্দর করে খেয়ে বের হই। দুপুরে অফিস আর রাতে বাইরে। নয়তো বাড়ি ফিরে ডিম ভাজি আর আলু ভর্তা। কারন আমি আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি ছাড়া কিছুই রাঁধতে পারিনা।
এবার আমি শশুর বাড়ি যাচ্ছি একবছর পর। শাশুড়ী মা, ফুপু শাশুড়ীকে কেমন করে যেন অল্প অল্প রাজী করিয়েছেন আরকি! তবে জানিনা ‘কু’ ‘ক’ কিভাবে ম্যানেজ করেছেন।
আজও আষাঢ়ের ঘোর লাগা সন্ধ্যা। গ্রামের এমন সন্ধ্যায় পা ঝুলিয়ে আইলের পাশে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। ছোট গ্রাম্য বাজারের সব মিষ্টান্ন ভান্ডার গাড়িতে তুলে দিয়ে আমার বীর বিক্রম বললেন- আমি আসছি, তুমি যেতে থাকো।
আমি জানতাম, তিনি আমার সাথে আসবেন না। বাপের ভয়ে মধ্যরাতে মায়ের সাহায্যে বাড়িতে ঢুকবেন। আমিও তাই পথ চিনে চিনে এগুতে থাকলাম।
কচি কদম ফুলের গন্ধে চারদিক ভরপুর। আঙ্গিনায় বিরাট কদম গাছ। এটাকে তাহলে বলে শশুর বাড়ি। দেবররা সবাই দাড়িয়ে। ননদ নেই, এটা কষ্টের।
একগোছা কদম হাতে উঁকিঝুকি দেয়া একজন পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। হাসিখুশি চমৎকার মেয়ে। কদম দিয়ে আমায় বুকে জড়িয়ে নিলো। টের পেলাম সে অনায়াসে আমার বন্ধু হতে যাচ্ছে। বুঝলাম, শশুর মশাই এজন্যই আমার উপর খ্যাপা। আমি এতো ভালো না। মনে হলো বাহ! দারুণ পরিবার।
পরদিন উঠে গেলাম সেই সকাল সকাল মানে বারোটা। রান্না বা সংসার করতে নয়, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। সামনে পেলাম ছোট বউকে। আমার মুখ দেখেই সে বুঝতে পারলো, খিদে পেয়েছে। রান্না ঘরে নিয়ে গেল।
ও আল্লা গো পোলাও, গরু ভূনা, চিংড়ি, মাছ, মিষ্টি, দই কতো খাবার। সে সব রেঁধেছে। আর আমি রাঁধতে না পারলে কি হবে, আমার জীহ্বার টেষ্ট ভালো? গপাগপ ভালোই খাচ্ছিলাম! সে হাসিমুখে এগিয়ে দিচ্ছে। গরু, পোলাও শেষ। রসমালাই তিনটের বেলায় বিরাট হা মুখে শশুর মশাই হাজির। কি আর করা, হা তো করতেই হবে? এতো বড় রসমালাই যে তিনি কিনেছেন!
আমাকে বললেন, মা চা নিয়ে এসো। তোমার ফুপু শাশুড়ী এসেছেন তোমাকে দেখতে।
আমার বানানো যে চা। টেনশানে ঘেমে যাচ্ছিলাম। ছোট বউ শুধু হাসলো। মেয়েটার হাসি এতো সুন্দর। তার হাসির মতোই চায়ের কালার আর টেষ্ট। আমার খাওয়া হলো না। সে ট্রে তে সাজিয়ে দিয়ে ইশারা করলো। আমার এতটুকু রাস্তা যেতে অনেকবার মাথায় তুলে দেয়া কাপড় পরে গেল।
ফুফু শাশুড়ী চা খেয়ে আপ্লূত। বলছেন, আমার গাধা ভাইটা এতো কিউট বউটাকে এতোদিন বাড়িতে আনেনি।
এই গাধা তোর বউ বললো যে, রংপুরের মেয়ে। অবশ্য দেখেও তো মনে হচ্ছে এ মেয়ে সমস্যা না। তোমার সাথে কোন ‘ক’, ‘কু’ এর সম্পর্ক নেই তাই না মা। থাকতেও পারে না আমার বিশ্বাস।
আমি ঘামছি। শাশুড়ী মা তাহলে আমাকে রংপুরের মেয়ে বানিয়েছেন?আমি আমতা আমতা করলাম।
অতি চালাক মহিলা এবার প্রশ্ন করা শুরু করলেন।
– মা তোমার নাম যেন কি?
– নাম বললাম। তিনি শাশুড়ী মায়ের দিকে কড়কড় করে তাকালেন।
শাশুড়ী মা বললেন,- বুবু সমস্যা নেই। মাঝে শেষে ক, কু চলে।
– মা তোমাদের বংশের টাইটেল কি যেন?
– জী, খন্দকার।
– এখানেও তো ‘ক’ আছে। তিনি ঘেমে যাচ্ছেন।
শাশুড়ী মা আবার বললেন,- বুবু একেবারে শেষদিকে। সমস্যা নাই।
– তোমার পড়াশোনা, কোথা থেকে পড়াশুনা করেছ? কারমাইকেল কলেজ বা রোকেয়া ভার্সিটি তো না তাই না?
আমি সবার মুখ চাওয়া চাওয়ী করে বললাম- না এসব নয়। তবে কুষ্টিয়া ভার্সিটি।
এবার তিনি কোথাও গভীর মিথ্যার, ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেলেন। শশুর মশাইয়ের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন- তোমাদের বাড়ি তো আমাদের রংপুরে? তাই না মা।
– আমি মিথ্যা বলতে পারিনা। আর বলবোও না। আমি ‘কুড়িগ্রাম’ বলতেই, শাশুড়ী মা মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে বললেন বুবু বউমার নানাবাড়ি এখানে। দাদাবাড়ি তো আর নয়। নানাবাড়িতে কি আসে- যায়!
– তা অবশ্য ঠিক। তা বৌমা তোমার দাদার বাড়ি কোথায়?
আবার শাশুড়ী মা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। ফুপু শাশুড়ী তাকে থামিয়ে দিলেন।
আমি নির্ভয়ে বললাম- ‘কুমিল্লা’!
শশুর মশাই দেখলাম চেয়ার ছাড়ছেন। আর আমার এমন সর্বনাশে আবিদকে কোথাও পাওয়া গেল না। ছোট বউ তখনও হাসিমুখে আমার কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। আমি নিজের জন্য একটুও বিচলিত না। তারাতাড়ি উঠতে পারলে ভালো হয়। আমার কাঁধে হাত দিয়ে যিনি আছেন তার হাতের চা টেস্ট করা জরুরি।
ফুপু শাশুড়ীর প্রেসার বেড়ে গেছে। তিনি বড় বউকে চেইন উপহার দিবেন বলে এনেছিলেন। কষ্টে তিনি তা না দিয়েই, দুপুরে না খেয়ে বাড়ি ছাড়লেন।
ছবি-নেটের
১৭টি মন্তব্য
রিতু জাহান
হা হা, চমৎকার।
হাস্যরসে ভরপুর গল্প।
ক দিয়ে কতো সমস্যা!
ননদ নেই এটা কস্টেরই বটে,, নুন ঝাল না হলে জমে না কিন্তু।
বেশ লিখেছো। অনেক দিন পর একটা চমৎকার মজার গল্প পড়লাম।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আমি ভালো লিখিয়ে না, বলতে পারো চেষ্টা আরকি! নুন ঝাল ছাড়া আসলেই জমে না।
ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। আর প্রথম মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা রিতু। ভালো থেক!
রেজওয়ানা কবির
ওরে বাপরে,অনেকদিন পর এমনভাবে রম্য পড়ে প্রান খুলে হাসলাম। ক তে সমস্যা জন্যইতো আমিও রেজওয়ানা কবির,,,,,,
বুঝতে হবে রোকসানা খন্দকার ফুপি বেঁচারী এটা কি জানে তোমার বনের নামেও ক আছে???খাইছে এবার😃
রোকসানা খন্দকার রুকু
হাসতে থাকুন বেশি করে। ট্যাক্স দিতে তো আর হয়না?
আর শেষে মাঝে ক কু তে সমস্যা নেই, চলবে। কিছু লিখে টিখে দেন পড়ি।
নার্গিস রশিদ
গল্প টা খুব মজা করে পড়লাম । ভালো লিখেছেন। শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
কৃতজ্ঞতা অশেষ। আপনার জন্যও শুভকামনা।।
ছাইরাছ হেলাল
পোটলা বাবুর দারুন কিচ্ছা, গুছিয়ে লিখেছেন এবারে দেখতে পাচ্ছি।
রোকসানা খন্দকার রুকু
কৃতজ্ঞতা অশেষ মহান। সাথেই থাকুন।।।
হালিমা আক্তার
হাসি হাসবো না তো কি, হাসির বায়না করেছি। ক আর কু নিয়ে এতো সমস্যা। ভাগ্যিস বাংলাদেশ এর মধ্যে ক নেই। থাকলে কি যে হতো। খুব মজা পেলাম। শুভ কামনা রইলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
হা হা হা তাও ঠিক কি যে হতো?
অশেষ কৃতজ্ঞতা আপা❤️
সাবিনা ইয়াসমিন
নাম শুনেই মরা মাছের মতো উলটে গেলেন! হাহাহাহাহা, আর ফুফু শাশুড়ীর চেইন শেষমেশে কে পেলো তাহলে?
ক আর কু থেকে সাবধানে থাকা লাগবে, আমি মরা মাছের মতো পালটি খেতে চাই না..
রোকসানা খন্দকার রুকু
থাকুন, থাকুন সেটাই ভালো হবে। আর চেইন?
যার কোথাও ক কু নেই সেই চেইন পাবে। সিরিয়ালে দেখছি অনেকেই আছে😀😀
খাদিজাতুল কুবরা
দারুণ রম্য গল্প! ক এর কীর্তি কিন্তু
রোকসানা খন্দকার রুকু
😭😭😭
খাদিজাতুল কুবরা
সরি, কীবোর্ড বেঈমানী করেছে।
ক এর কীর্তি কিন্তু চমৎকার হয়েছে। আমাদের সংসারের দুষ্ট মিষ্টি সম্পর্কগুলো কি সুন্দর সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলেছ। শুভেচ্ছা পরবর্তী গল্পের জন্য
রোকসানা খন্দকার রুকু
আমার সাথে সবাই বেঈমানী করে। যেমন আপনি করলেন এতো দেরী মন্তব্য করে।😄😄
অশেষ কৃতজ্ঞতা।🌹
খাদিজাতুল কুবরা
😀😀😀🤫