যাকে সম্পূর্ণ অধিকার ত্যাগ করে প্রদান করা হয় তাকে সম্প্রদান কারক বলে। আমাদের বর্তমান সমাজে এই কারকের সংজ্ঞার সঠিক প্রয়োগ আদৌ আছে কি ? আমরা দেখি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠনা, দানবীর ব্যক্তিরা এখন দান করে তার সচিত্র ছবি পত্রিকায় প্রকাশের জন্য। এমনকি শহরে বন্দরে গ্রামে গঞ্জে পাড়া মহল্লায় যে কোন দান করার পর তা সবাই প্রকাশের জন্য বিভিন্ন পন্থা বা উপায় ব্যবহার করেন। যেমন ব্যানার ফেস্টুন, পত্রিকায় ছবি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ সব জায়গায় দানের ফলাও প্রচার হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে প্রচারে প্রসার আর এতে করে রাজনীতি, শিক্ষা, ধর্মীয় এবং সামাজিকতার নামে মানুষ কীর্তিমান হয়ে উঠে। যা আগের দিনের মানুষের মধ্যে ছিলনা। এখন তা খুব দৃষ্টিকটুভাবে প্রকাশিত বা প্রচারিত হতে দেখা যাচ্ছে। অনেকেরই দেখা যায় আয়ের সাথে দানের কোন মিল নাই। মিল নাই তাঁর সম্পদের মালিক হওয়ার সঙ্গেও। অবস্থাটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে দানবীর হলেই হল আগপিছ না ভেবে অনেকেই তাঁর পিছু নিচ্ছে। সত্যিকার অর্থে রাজনীতিবিদ, সমাজপতি, অবৈধ বিত্ত্বশালীরা আমাদের চোখে ধুলা দিয়ে আমাদের নিকট থেকে বাহবা আদায় করে নিচ্ছেন। একজন হুজুরের মুখে শুনেছি আপনার দানে গড়া যে কোন ধর্মীয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা পুল ব্রিজ সহ যে কোন দান অনুদান সাদাকায়ে জারিয়ার ছওয়াব আপনার নামে যোগ বা বিয়োগ কিছুই হবেনা যদি না তা নিজের বৈধ আয়ে না হয়। কিন্তু আমাদের মন মানসিকতা হচ্ছে আমার আমল নামায় যোগ বিয়োগ হোক বা না হোক দুনিয়াতে তো আমার নামের প্রচার প্রসার হচ্ছে। এদিয়ে তো আমি মানুষের মন জয় করতে পারছি। মানুষ বাহবা দিচ্ছে, তালি দিচ্ছে জীবনে কি তা অনেক বড় পাওয়া নয়। অসৎ ভূমিদস্যু দুর্নীতিবাজ সমাজ ও শিক্ষানুরাগীদের জিন্দাবাদ দিয়ে এসবের বেনিফিসিয়ারী হিসেবে অনেকেই নীতি নৈতিকতা ধর্মীয় অনুশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে টুপাইস কামিয়ে নিচ্ছে বিনিময়ে অসৎ মানুষকে মারহাবা দিচ্ছে। দিচ্ছে জিন্দাবাদ আর জয়ধ্বনি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যেন পরকালে কথা পরকালে দেখা যাবে এরকম একটা মনোভাব তাঁদের কার্যকলাপে প্রতীয়মান হতে দেখা যায় যা খুব দুঃখজনক।   

ইসলামে দান সাদাকা যাকাত নামাজ রোজা হজ্জ অন্যের সামনে জাহির করার বিষয় নয়। যদি কেউ তা জাহির করে বা প্রকাশ করে তবে তা হবে রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদত। আপনি যদি হাজী হওয়ার জন্য হজ্ব করেন, দানবীর হওয়ার জন্য যাকাত দেন, শিক্ষানুরাগী হওয়ার জন্য মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন, নাম যশ খ্যাতির জন্য মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ, ব্রিজ পুল রাস্তা নির্মাণ করেন, নামাজী বলার জন্য মসজিদে যান তবে আখেরাতে এসবের কোন মূল্য নেই। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে ডান হাতের দান যেন বাম হাতে না জানে। পাশাপাশি কিছু ব্যতিক্রমের কথাও বলা হয়েছে। কিছু দান সাদাকা প্রকাশ করতে বলা হয়েছে যাতে সমাজের বিত্ত্বশালী অথচ কৃপণ, বখিল দান সাদাকা করতে চায় না, যক্ষের ধনের মতো তা আঁকড়ে রাখতে চায় তাঁদেরকে দান সাদাকায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য, আল্লাহ্‌র রাস্তায়, গরীব দুঃখী অসহায় মিসকিনদের সাহায্য সহযোগিতা, আর্ত মানবতার সেবায় খরচের ব্যাপারে উৎসাহ এবং প্রতিযোগীতার মনোভাব সৃষ্টির জন্য। তবে  ঢালাওভাবে সব দান সাদাকা প্রকাশ করা উচিৎ নয় মোটেও। প্রাণঘাতী মহামারী করোনাভাইরাসের এই মহা দুর্যোগকালে মানুষ দান অনুদান বা সাদাকা প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্যভাবে করছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ গরীব অসহায় মানুষের ঘরে ঘরে খাবার অর্থ পৌঁছে দিয়েছে। রাস্তায় নামা গরীব পথচারী, রিকশাচালক, দিন মুজুরদেরকে মানুষ ত্রাণ এবং অর্থ সহায়তায় এগিয়ে এসেছে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী। প্রাসঙ্গিক ভাবে এখানে উল্লেখ করতে চাই সমাজের অনেক ধনী ব্যক্তি শিল্পপতিরাও প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্যভাবে তাঁদের দান সাদাকা প্রদান করে চলেছেন। এদিকে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী করোনা ইউনিটের জন্য প্রথমে ৮০ লক্ষ টাকা পরে ৮ লক্ষ টাকা প্রাদান করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ব্যাক্তি একটি এ্যাম্বুলেন্স দান করেন। সমাজে এমন ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে মসজিদের উন্নয়ন হয়েছে, মসজিদ বেঁধে দিয়েছে কেউ জানে না এর অন্তরালে কে বা কারা জড়িত। অনেকেই মসজিদ মাদ্রাসায় দান করে নিজেদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থাকেন। তবে অনেকক্ষেত্রে দানশীল ব্যাক্তির দান অনুদান বা সাদাকা প্রকাশ করা জরুরি। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের এ প্রাণঘাতী মহামারীর সময়। মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন, আহারের প্রয়োজন, চিকিৎসাসেবা দেয়া অনেক জরুরি এবং অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রামের দানশীল ব্যাক্তি পি এইচ পি গ্রুপের চেয়ারম্যান জনাব আলহাজ্জ সুফি মিজানুর রহমান মা ও শিশু হাসপাতালের করোনা ইউনিটের জন্য এবং হাসপাতালের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য সর্বমোট তিন কোটি টাকা দান করেছেন। এবং আরও এক কোটি টাকা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন যখন চট্টগ্রামে করোনাকালে চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং সেবায় ধ্বস নেমেছে। মানুষ চিকিৎসা নেয়ার জন্য প্রাইভেট ক্লিনিক এবং হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে ঘুরতে অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছে। এমন দুঃসময়ের মুহূর্তে চট্টগ্রামের চিকিৎসা সেবা এবং চিকিৎসা সামগ্রী, ঔষধপ্ত্র এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের যোগান দেয়া খুব জরুরি হয়ে উঠেছে। আমারা বিশ্বাস করি আলহাজ্জ সুফি মিজানুর রহমান সাহেবের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চট্টগ্রাম ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে চট্টগ্রামের মহামারীর এ দুঃসময়ে আর্ত-মানবতার সেবায় এগিয়ে আসবেন। আলহাজ্জ সুফি মিজানুর রহমান যা করেছেন তা অনুকরণীয় অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। এ বিষয়ে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের দান অনুদান সাদাকার ব্যাপারের উৎসাহী, উদ্যোগী এবং ধর্মীয় প্রতিযোগীতার মাধ্যমে এগিয়ে আসার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস।

দেশে চলমান বৈশ্বিক প্রাণঘাতী মহামারী করোনাভাইরাসের এ দুঃসময়ে মানুষের মানবিক আর্থিক চিকিৎসা সাহায্য সহযোগিতায় সরকারের পাশাপাশি সামর্থ্যবান বিত্তশালী ধনীদের এগিয়ে আসা খুব জরু্রি। চট্টগ্রামের বিপর্যস্ত চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি কর্মহীন, গরীব, অসহায়, নিঃস্ব মানুষকে আর্থিক এবং ত্রাণ সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করার মহানুভবতা নিয়ে সকলের দান অনুদান সাদাকা নিয়ে এগিয়ে আসা উচিৎ। আমরা লোক দেখানো এমন দানের ছবি দেখতে চাই না যেখানে দশ বারোজনে মিলে ছোট্ট একটি ত্রাণের প্যাকেট বা ব্যাগ প্রদান করছেন। নিঃস্বার্থভাবে মানবিক এবং আর্থ মানবতার সেবায় এগিয়ে আসুন ছবি তোলার জন্য নয়। দয়া করে মানুষের দুঃখ অসহায়ত্ব দুর্ভোগ দুর্দশা ভোগান্তিকে নিয়ে ব্যাঙ্গ বিদ্রূপত্মাক ছবি তোলার তামাশা বন্ধ করুণ। আর্ত-মানবতার সেবায় মানবিক, নৈতিক এবং ধর্মীয়ভাবে এগিয়ে আসুন। মানবতার জয় হোক এ প্রত্যাশা সকলের।

৮৫২জন ৭২৫জন
0 Shares

২১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ