যুগে যুগে যুগান্তরী

সাবিনা ইয়াসমিন ৯ জুলাই ২০২১, শুক্রবার, ০৪:১৯:০৮পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২৫ মন্তব্য

প্রথম যুগ-

জন্মের পরের প্রায় অর্ধেক সময়ের স্মৃতি ভুলে গেছি! মেমোরি ফাঁকা দেখাচ্ছিলো। বারকয়েক রিস্টার্ট দেয়ার পর কিছু কিছু রিকোভার হলো। সেই যুগে আমার একটা আটপৌড়ে নাম ছিলো। হাতে ছিলো কাঁদা-মাটি। যা খুশি বানিয়ে নিতাম, ভাবনার সব আদল তৈরী করতে চাইতাম নিজের খেয়ালমত।  তারপর হঠাৎ ঘাস ভরা মাঠের আনাচে-কানাচে ফড়িং এর ঝাঁক আর রঙিন প্রজাপতির পিছু নিতে নিতে এক সময় উপলব্ধি করলাম আমি বড় হচ্ছি! এমন করে বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে বেড়ানো ঠিক হচ্ছে না। ছেড়ে দিতে হবে শৈশবের মাঠ, পুতুলের ঘর। ভর দুপুরে বাড়ির কাছের ডোবা থেকে যেসব ব্যাঙের পোনা ধরে আনতাম পুষবো বলে, সেসবও আর আনা যাবে না। কারণ ব্যাঙ গুলো বড় হয়ে  ডোবাতেই ফিরে যায়। আমি বড় হয়ে ঘরে ফিরলাম, বড়ো হয়ে যাওয়া ব্যাঙের মতো। অতি আদরে পালিত সাদা ইদুর গুলোর উপর বেশ  বিরক্ত হয়ে তাদেরকে একপ্রকার তাড়িয়েই দিলাম।

ঐসময়ে আমার বন্ধু-বান্ধবী অনেক ছিলো। পিঠেপিঠি ভাইবোন, খেলার সাথী, সহপাঠীদের মাঝেই মিশে থাকতাম। বন্ধুত্বের সঠিক ব্যাখ্যা জানা ছিলো না।


দুই যুগ-

প্রথম যুগ মোটামুটি দ্রুত পার হয়ে গেছে। দ্বিতীয় যুগে এসে আমি অনেক পরিচয়ে পরিচিতি পেলাম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ, পরিবার সব জায়গাতেই আমার পরিচিতি বাড়লো। দুই যুগ শেষ হওয়ার আগে আগেই শিক্ষাজীবন সমাপ্ত হলো। শিক্ষা চলাকালীন সময়ে আমি গৃহবধু হলাম।  দুই সন্তানের মা হলাম। আমার নামের পাশে আরও অনেক নাম যুক্ত হলো। নতুন বাড়িতে নতুন পরিবারে এসে নাম এডিট হলো। সমাজে ওমুক বাড়ির বউ, তমুকের স্ত্রী, —– ওদের মা। আমার আটপৌরে নাম খানি একটু একটু করে একসময় পুরোপুরি ভাবে বিশেষ ঘনিষ্ঠ জনদের দুই ঠোঁটের সীমানা প্রাচীরে আটকে গেলো! এখন সেই নামে কেউ ডাকলে চমকে উঠি।

এমন করেই যুগ এগোয় পরবর্তী যুগের দিকে, পিছনে পরে থাকে চিরচেনা সম্বোধন.. স্মৃতি।
শিক্ষাজীবন হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছিল। নতুন নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে গেছি সম্পর্কের চাহিদা অনুযায়ী।  যার সাথে যতটুকু দরকার ততটুকুই  মিশেছি। এই সময়ে এসে আমার বন্ধুত্ব গড়েছি আমার সন্তানদের সাথে। আমার সুখ-দুঃখ,  আনন্দ-আশ্রয় সব কিছুতেই ছিলো আমার পরিবারের মানুষ,,আমার বোনেরা, আমার মেয়েরা।

 

তিন যুগ-

তৃতীয় সন্তান এর জন্ম এবং দ্বিতীয় যুগের রেশ নিয়েই তিন যুগে পদার্পণ করতে হয়েছে।

কথায় বলে, দান দান তিন দান, মানে হলো কারো যদি কিছু পাওয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে সেটা পেতে হলে কমপক্ষে তিনবার চেষ্টা চালাতে হয়। আমিও বেশি না, মাত্র তিন যুগের চেষ্টায় আরাধ্য অনেক কিছু পেয়েছি। মনের সর্ব চক্ষু মেলে/দেখে বুঝেছি, সৃষ্টিকর্তা এই যুগে এসে আমার প্রতি মনোনিবেশ করেছেন। বিপদে ধৈর্য রাখা, যেকোন পরিস্থিতিতে মানসিক স্থিরতা অটুট থাকা, আত্মসংযম, এবং নিয়তির প্রতি মনেপ্রাণে আস্থাশীল হওয়ার শিক্ষা পেয়েছি পরম করুনাময়ের দয়ায়।

আমি আমার ভাগ্যবিধাতার উপর কৃতজ্ঞতা রাখি কারণ  তিনি আমাকে এই সময় পর্যন্ত সুস্থ অবস্থায় বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমার জন্যে নির্ধারিত সকল দুঃখকষ্ট, রোগশোক, বিপদাপদ গুলো সহনীয় (দোজখের যন্ত্রণা তুল্য কোন কষ্টই পৃথিবীবাসীকে আল্লাহ তায়ালা দেন না) পর্যায়ে রেখেছেন। এবং প্রাপ্ত নেয়ামত গুলোকে বরকতময় করে দিয়েছেন/ দিচ্ছেন। আলহামদুলিল্লাহ।

বর্তমান – তৃতীয় যুগ অবস্থান কালে আমি পরিচিত পারিবারিক সীমানার বাইরে এসে  কিছু বন্ধু পেলাম। ঠিকঠাক বন্ধুত্বের সঠিক সংজ্ঞা অনুসারেই।
অবাক করা বিষয় হলো তাদেরকে পেয়েছি এই ভার্চুয়াল জগতে এসে! কখনো দেখা হয়নি, পূর্ব পরিচয় বা পরিচিতি কিছুই ছিলো না কারো সাথে, কিন্তু তারা কেমন করে যেন ধিরে ধিরে আমার একান্ত আপন হয়ে গেলো!

আমার ভালুকা বন্ধু- না না, এটা তার নাম না! আর দেখতে শুনতে মোটেই ভালুক নয়। তবুও আমি তার নাম দিয়েছি ভালুকা বন্ধু।
আমার সকল সুখ দুঃখের সাথী সে। ভালুক যেমন বিশালতার দিক দিয়ে সেরা, তেমনি সেও তার বিশাল মনোভাব, অন্তহীন উদারতা এবং বন্ধুত্বের সংজ্ঞায় একজন পরিপূর্ণ মানুষ। আমি তাকে আমার জন্য বিধাতার পাঠানো নেয়ামত (আশির্বাদ) রুপে পেয়েছি।

ময়না– সোনেলায় যারা আছেন, অথবা ভার্চুয়াল জগতে যারা আমাকে জানেন তারা প্রায় সবাই আমার এই ময়না বন্ধুটির সাথে পরিচিত।
উহু, ওর সাথেও আমার কখনো সামনাসামনি দেখা হয়নি, ফোনেও কথা হয়নি। আমাদের মাঝে যোগাযোগ যা টুকু সবই ঐ যাদুর বাক্সে!
ময়না, আমার বন্ধু এটা পারিবারিক ভাবেও স্বীকৃত। ময়নার বন্ধুত্ব নিয়ে গর্ব করার অনেক কারণ আছে, কিন্তু আফসোস এর কোন অবশিষ্টাংশ নেই।

রম্যরানী– হাহাহাহা, তাকে আমি মনে মনে এই নামেই সম্বোধন করি। বলার অপেক্ষা রাখে না, তার সাথেও পরিচয় হয়েছে ফেসবুকে। তারপর থেকে সে একমুহূর্তের জন্যেও আমার সঙ্গ ছাড়েনি। কথা হয়েছে অনেকবার, কিন্তু দেখা হয়নি। একটু একটু করে সে আমাকে আমার মতো করে আপন করে নিয়েছে। অনলাইনে আমার অনুপস্থিতিতে অথবা অসুস্থ থাকার সময়ে কীভাবে যেন টের পেয়ে যায়! খোঁজ নিতে কখনোই তার দেরী হয় না! একটা কথা না বললেই নয়,  তাকে কিছুটা ভয় পেতে শুরু করেছি। আমি নিশ্চিত, যদি কখনো ব্যক্তিগত কারণে (ভাইরাল হতে নয়) আত্মগোপনে যেতে চাই  হয়তো সেটা সম্ভব হবে না। রম্যরানীর খোঁজ দ্য সার্চ মিশন শুরু হয়ে যাবে।

তিনি সোনেলাতেও সুপরিচিত একজন। আমার এই বন্ধুটি সমসাময়িক লেখায় যেমন সিরিয়াস, তেমন রম্য লেখায় জিনিয়াস। তিনি সোনেলায় নীড় বেধেছেন মাত্র এক বছর দুইদিনে, অথচ অন্যান্য অনেক ব্লগারদের তুলনায় তার ব্লগবাড়ি খুবই শক্তপোক্ত বলা যায়। অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা 🌹🌹 তাকে।

 

 

আমাদের জীবন নানা রঙের সম্পর্কের সুতোয় বাঁধা। প্রতিটি রঙই আলাদা, সব রঙের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। যেকোনো কারুকাজ/ নকশায় সৌন্দর্য বাড়াতে আমার যেভাবে প্রয়োজনীয় সুতো খুঁজে নিই, তেমনই সম্পর্কের চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন সম্পর্কের সাথে আমাদের তাল মিলিয়ে চলতে হয়। রক্তের সম্পর্ক, পারিবারিক আত্মীয়তা অস্বীকার করার উপায় কারোরই নেই। এই সম্পর্ক গুলো আমাদের বেঁচে থাকার মুলভিত্তি, এবং আমাদের অস্তিত্বের বাহক।

মনে রাখতে হবে, বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী হয় মন থেকে। এটা আত্মা পর্যন্ত ছুঁয়ে যায়/থাকে। সঠিক বন্ধুরা আমৃত্যু পর্যন্ত বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখে, বন্ধুর মূল্যায়ন করে। যে বন্ধুত্ব নিমিষেই শেষ হয়ে যায়, বিশ্বাসঘাতী হয়, সে সম্পর্ককে কখনো বন্ধুত্ব বলা যাবে না।

পরিচিত গন্ডি পেরিয়ে যাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়েছে তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ যোগ্যতায় অসাধারণ। আমার সাথে সংযুক্ত  হওয়া বা আমাকে তাদের আপনজন করার সম্পুর্ন ক্রেডিট তাদেরই।
সত্যি বলতে কারো সাথে কোনরূপ বন্ধুত্ব গড়তে আমার নিজস্ব কোন অর্জন নেই।

তিনযুগ পেরিয়ে এসেছি, জানি না চারযুগ পর্যন্ত বেঁচে থাকবো কি না। যেখানেই থাকি মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করি তিনি যেনো সবাইকে সুস্থ সুন্দর জীবন যাপনের তৌফিক দেন। ভালো থাকুক সবাই, ভালো থাকুক আমার সকল শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুরা ❤️❤️

 

** ছবি- আমার 😇😇

৯০৯জন ৫৬২জন

২৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ