
আমার কাছে অনেকেই মেডিটেশন সম্পর্কে অনেকেই জানতে চেয়েছিলেন। আমি সাইকোলজিস্ট কিংবা সাইক্রিয়াটিস্ট নই। আসলে আমার সীমিত জ্ঞানে মানুষের মন (Human Mind) এবং মেডিটেশন (Meditation) বা ধ্যান নিয়ে আপনাদের সাথে আজ আমার কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো। লেখার ভুলত্রুটি অবশ্য মার্জনীয়। যেকোন পরামর্শ সাদরে গ্রহণীয়।
মেডিটেশন সম্পর্কে জানার আগে মানুষের মন নিয়ে কিছু বলি। মন একটি ছোট্ট শব্দ হলেও এর পরিধি বিশাল। এর ব্যাপকতা অসীম। একে বোঝা মুশকিল। একজন মানুষের চিন্তা ভাবনা যতদুর পর্যন্ত বিস্তৃত মানুষের মন তার চেয়েও অনেক গভীরে অবস্থান করে। না হলে কি করে চোখ বন্ধ করলেই দেশে বসে লক্ষ মাইল দুরের আমেরিকার স্ট্যাচু অফ লিবার্টি আপনার চোখে ভাসে কল্পনা করুনতো!
আপনার চোখের একবার পলক ফেলতে যে সময় লাগে তাকে ১০০০ বার ভাগ করে যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময় বের হবে সেই ন্যানো সেকেন্ডে আমাদের মন কত টেরাবাইট ছবি ধারন করতে পারে সে কথা আমি চিন্তা করতেই অস্থির হয়ে যাই। সবচেয়ে মজার তথ্যটি আপনাদের দেই, মানুষের মনের অবস্থান কোথায় জানেন? না, বুকের বামপাশের হার্ট বা হৃদয়ে নয় এর অবস্থান কিন্তু আমাদের মাথায়। যাকে আমরা মস্তিষ্ক বলি। এখন যদি আমি বলি আমার মন খারাপ তার মানে কি আমার মস্তিষ্ক খারাপ? হা হা হা, না তা নয়; মন খারাপ মানে এটি আমার মস্তিষ্কের একটি আবেগীয় অনুভূতির অংশ। মন হচ্ছে লক্ষ কোটি নিউরনের খেলা বা ক্রিয়াকলাপ। মজার বিষয় তাইনা?
বিজ্ঞানী ফ্রয়েড মনের স্তরকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন- সচেতন, অবচেতন, অচেতন। এই
তিন ভাগের কাজ তিন রকমের। সচেতন চিন্তা ভাবনা স্মৃতি অভিজ্ঞতা নিয়েই সচেতন মন কাজ করে। এই যেমন এখন আমার পোষ্ট পড়ছেন সচেতন মনে।
কোন স্মৃতি চিন্তা সচেতন মনে আসার আগে অবচেতন মনে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ শে মার্চ এটা আমাদের সবার জানা। কিন্তু এই তথ্যটির ব্যাপারে আমরা সজাগ থাকিনা। এটাই মনের অবচেতন স্তর। অথচ কেউ যখন জিজ্ঞেস করে ২৬ শে মার্চের বিষয়ে তখন সেটি আমাদের অবচেতন স্তর থেকে সচেতন স্তরে চলে আসে।
আরেকটি হলো অচেতন স্তর। এই স্তর হলো মনের সেই স্তর যা সম্পর্কে আমরা সচেতন বা সজাগ থাকিনা এমনকি ইচ্ছে থাকলেও আমরা ধারনা করতে পারিনা। এই স্তরকে কল্পনা করুন মহাসমুদ্রের মাঝে একটি হৈমশৈল বা বিরাট দৈত্যকার বরফখন্ডের সাথে। যার উপরিভাগ দেখা গেলেও পানির নীচের অংশ দেখা যায়না। যে অংশটি দেখা যায়না সেটিই মনের অচেতন স্তর। এটি কিন্তু মোটেই নিষ্ক্রয় নয় বরং সক্রিয়। এটি আমাদের আবেগ অনুভূতি, যৌন তাড়না, কাম ক্ষুধা, আগ্রাসী আবেগ, রাগ, ক্ষোভ, ঘৃনা, ভালোবাসা সব কিছু নিয়ন্ত্রন করে।
মানুষের অপূর্ণ ইচ্ছে কিংবা দুঃখময় স্মৃতিগুলির আঁধার হচ্ছে মনের অচেতন স্তর। মানুষ অন্যকে খুন করে কিন্তু এই অচেতন মনের প্রভাবেই। মানুষ স্বপ্নে যা দেখে কিংবা হুট করে অযাচিত কিছু কথা বলে (sleep of tongue) তা কিন্তু এই অচেতন মনের প্রভাবেই। মোট কথা মানুষের সব গোপন আদিম কামনা বাসনার এক বিশাল কুঠুরি হচ্ছে এই অচেতন মন।
আশাকরি মন সম্পর্কে সামান্য ধারনা দিতে পেরেছি। এখন আসি মেডিটেশন পর্বে। মেডিটেশন বা ধ্যান হচ্ছে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রন করার একটি পদ্ধতি। ধ্যান আমাদের মনকে বুঝতে সাহায্য করে, নেগেটিভ চিন্তাকে পজিটিভ করতে সাহায্য করে।
আমি মেডিটেশন করি আমার মনকে স্থির করার জন্য, আবেগ নিয়ন্ত্রন করার জন্য। অতিরিক্ত আবেগ আমার জন্য নেগেটিভ চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এর কারনেই আমরা হঠকারী সিদ্ধান্ত নেই, নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেই। প্রচন্ড রেগে যাই, সিনেমা নাটকে কান্নার দৃশ্য দেখলে আমাদের কান্না পায়। অথচ অনেকসময় রক্তাক্ত লাশ দেখে নিজের চোখ দিয়ে একফোঁটা অশ্রুও ঝড়েনি।
এসবই হচ্ছে আমাদের মনের অচেতন স্তরের লাগামহীনতা। ফলে যারা আমাদের ভালোবাসেন, আমার পরিবার কিংবা আশেপাশের মানুষ আমাদের আচরনে কষ্ট পান। আর এর সব কিছুই হয় আমরা নিজেদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা বলে। একারনেই মেডিটেশন করেন অনেকেই। আমি নিজেও নিজের মনের উপর অনেকটাই নিয়ন্ত্রন খুঁজে পেয়েছি মেডিটেশনের মাধ্যমে।
ধ্যান অনেক ভাবেই করা যায়- বসে শুয়ে, সৃষ্টিকর্তাকে ডাকার মাধ্যমে যে যেভাবে আরামবোধ করেন সেভাইবে করতে পারেন। তবে তা হতে হবে একটু নিরিবিলি জায়গায়।
মেডিটেশনের মাধ্যমে আমি গহিন অরন্য পার হই, সবুজ মোলায়েম ঘাসের উপর পা মাড়িয়ে একা একা হেঁটে বেড়াই, নদীর পাড়ের কাঁশবনে বসে নীল আকাশ দেখি, বিস্তীর্ণ বালুচরে নিজের রক্তমাংসের শরীরকে ধীরে ধীরে ধুলিকণায় রুপান্তরিত করি। আমি মিশে যাই বালুকাবেলার এক অদ্ভুত সুর্যাস্তের গোধুলি আলোয়। নিজের মাঝে আমার আর কোন অস্তিত্ব থাকেনা।
মনের সচেতন এবং অবচেতন স্তর ভেদ করে আমি চলে যাই অচেতন মনের গোপন কুঠরিতে। সেখানে ছবি আঁকি মন নিয়ন্ত্রনের। নেগেটিভ চিন্তাগুলিকে পজিটিভ রঙ দিয়ে মেশাই, নিজের আবেগগুলিকে দিয়ে ছোট ছোট ঘর সাজাই, রঙিন ঘর। সেখানে প্রতিটি ঘরে থরে থরে সাজিয়ে রাখি আমার সুন্দর স্বপ্নগুলোকে, ঘার ধাক্কা দিয়ে বের করে দেই সব অলীকতা, অবাস্তবতাগুলোকে।
আমার আশা আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসাকে দিয়ে ফার্নিচার বানাই পছন্দমত। আগামীদিন কিভাবে কাটাবো তার প্লানগুলি সাজিয়ে রাখি ঘরের তাকে। রাগ হলে কি করবো, আবেগ নিয়ন্ত্রনে কি করবো চিন্তাভাবনা করে কিভাবে কথা বলবো এর সবকিছুই আমি আমার মনের অচেতন স্তরে সাজিয়ে রাখি সংগোপনে। এরপর ধীরে ধীরে ফিরে আসি সচেতন মনে। আর এসবেরই প্রতিফলন ঘটে আমার প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততায়।
প্রতিদিন সময় পাইনা মেডিটেশন করার, মাঝেমধ্যে করি। দু’বছর থেকে প্রাক্টিস করছি। তারপরেও অনেকসময় আবেগী হয়ে যাই, রাগ হয়, অস্থির হয়ে উঠি। কিন্তু মনে রাখবেন আমি আপনি আমরা মানুষ আর এসব আবেগ আমাদের থাকবেই। তবে তা হতে হবে নিয়ন্ত্রিত। আর এসবের নিয়ন্ত্রক আমাদের অচেতন মন। তাই মনকে নিয়ন্ত্রন করা শিখলে এসব আবেগীয় বিষয় এমনিতেই নিয়ন্ত্রন করতে পারবেন।
আশাকরি নিজের মন নিয়ন্ত্রনে মেডিটেশনের ভুমিকা নিয়ে সামান্য হলেও আপনাদের ধারনা দিতে পেরেছি। আপনারা উপকৃত হলেই আমার লেখা স্বার্থক হবে।
ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।
[ছবি – নেট থেকে]
১৩টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
বাহ্, খুব সুন্দর গুছিয়ে লিখেছেন,
শুনে ভাল লাগল আপনি নিয়মিত মেডিটেশন করেন, এবং আপনার কাউন্সেলর আছে,
আমাদের সহ অন্যান্য ধর্মেও এর গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে, এবং এটি কার্যকারী পদ্ধতি।
একটি বিষয় বুঝছি না, সব কিছু বা সব আবেগ যদি সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রণে এসে যায় তাহলে
কী আমরা রোবটিক হয়ে যাব না!!
তৌহিদ ইসলাম
না ভাই, সবাই আবেগ নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা। একজন মানুষের স্বাভাবিক ভাবে যে আবেগ থাকা দরকার অন্য কেউ তা ঠিকমত প্রকাশ নাও করতে পারে। তাই ধ্যান হলো ভালো কার্যকর পদ্ধতি এটার জন্য।
নাহ রোবট হবো কেন? মানুষ জন্মগত ভাবেই আবেগ নিয়ে জন্মায়। কারো কম কারো বেশী। একেকজনের প্রকাশভঙ্গী একেকরকম।
তৌহিদ ইসলাম
ধন্যবাদ দাদাভাই, লেখাটি ভালো লেগেছে জেনে কৃতার্থ হলাম প্রিয়।
ইঞ্জা
খুব ভালো পোস্ট, মেডিটেশন বা যৌগ ব্যায়ামের চর্চা যুগে যুগে হয়ে আসছে এবং এই ব্যায়ামের দরুন শরীর মন দুইটাই ভালো থাকে।
লেখাটি খুব ভালো লাগলো ভাই
তৌহিদ ইসলাম
ধন্যবাদ দাদাভাই, লেখাটি ভালো লেগেছে জেনে কৃতার্থ হলাম প্রিয়। পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
ইঞ্জা
(3
নীলাঞ্জনা নীলা
মনের মতো একটা পোষ্ট লিখেছেন। এমন সব বিষয়ের উপর লেখা আমার খুব পছন্দের।
মেডিটেশন একটা সময় করতাম রোজ। এখন আর করিনা। আসলে একটা জিনিস দেখেছি, সহজে রাগ ওঠেনা। যা পছন্দ হয়না, তা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেই। আর এটা মেডিটেশন ছাড়াই শিখিয়ে নিয়েছি নিজেকে।
তৌহিদ ইসলাম
আসলে কিছু জিনিস থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়াই উত্তম আপু। লেখাটি ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো।
নীলাঞ্জনা নীলা
🙂
মৌনতা রিতু
মেডিটেশন নিয়ে পড়ার চেষ্টা করেছি। খুঁজে খুঁজে কিছু বইও জোগাড় করেছি। আসলেই মন ও মস্তিষ্কের এই মিল বন্ধন আমার বড় আজব মনে হয়।
আমি একসময় করতাম। এখন করা হয় না। তবে ওটার প্রভাব আছে এখনো। তবে রাগ কন্ট্রোলহয়েও হয় না। বেশ গুছিয়ে লিখেন আপনি। বেশ ভালো একটা পোষ্ট।
তৌহিদ ইসলাম
কস্ট করে লেখাটি পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা আপু। শুভকামনা রইলো। রাগ নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কষ্টসাধ্য বিষয়। তবে চেস্টা করলে পারবেন অবশ্যই।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
নিঃসন্দেহে মানব জীবনের জন্য এটি একটি উপকারী পোষ্ট।ভাল থাকবেন।
তৌহিদ ইসলাম
আপনার মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হলাম ভাই। সবার মঙ্গল কামনা করছি।