।।১।।
সিরাজগঞ্জ জেলাধীন শাহজাদপুর থানায় একটা গ্রাম কৈজুরী। যমুনা তীরবর্তী কৈজুরীহাট এবং ঠুটিয়া স্কুল এন্ড কলেজের প্রধান ফটকের মোটামুটি চার পাঁচ হাতের মধ্যে কয়েকটা চায়ের দোকান। এই চায়ের দোকানগুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মাঝে মাঝে এসে চা খায়। আবার এই দোকানের সামনে দিয়েই অনেক শিক্ষার্থী বাড়ি ফেরে।
সবগুলো চা ওয়ালার মধ্যে মেথু মিয়ার দোকানে বাড়তি সুবিধা আছে। এপ্রিলের এই চরম গরমে দোকানে বাড়তি কাস্টোমার ঠেকাতে সে চার্জার ফ্যান লাগিয়েছে। নিজের চায়ের দোকান আর পিয়ারী বেগমের আয়ে ভালোই সংসার চলে যাচ্ছে।
খালি একটাই আফসোস, পিয়ারী বেগমের এই তুফান সময়ে তাকে সময় দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। সংসারে নতুন শিশু আসতেছে তার ভবিষ্যতের জন্য তো কিছু গুছানো লাগবে। গরিবের সংসার। যা আয় করে তাতে দুজনে ভালো মতন চলে গেলেও সঞ্চয় তো হয় না সেরকম। সংসারে নতুন অতিথি আসা মানে নতুন নতুন বায়না। কত সাধ করে পরীর মতন পিয়ারী পেয়েছে সে একটা বউ হিসেবে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নতুন সংসারে তৃতীয় মানুষের আনাগোণার স্বপ্নের বাস্তবায়ন। আর মাত্র কয়েকটা দিন!
।।২।।
পিয়ারী, সখিনা আর নদী তিনজন একটা টিনশেড ঘরে বসে আছে। কারেন্ট নেই। তিনজনেরই মুখে কালবৈশাখী জমেছে। অস্থির!
পিয়ারী কথা বলে উঠলো, “শরীলডা এত্ত ঘুরাইতাছে! কামে যামু নাকি ভাবতাছি!”
সখিনা প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে কাকে উদ্দেশ্য করে জবাব দিলো বুঝা গেলো না, “কামে না যাইয়া উপায় আছে?” তারপরে পিয়ারীকে উদ্দেশ্য করেই বললো, “আর তো কয়েকটা দিন। মাসও শ্যাষ অইবো। বেতনডা পাইয়া এট্টু দ্যাশে যাও। পোলার বাপরে এহন তোমার সাথে রাখন দরকার। কি অয় না অয়!”
তিনজনের মধ্যে নদী নামের মেয়ে মানুষটির বয়স একটু বেশি। বাকি দুজন একে চাচী বলে ডাকে। সখিনার কথাকে সমর্থন জানালো সেও। বলে উঠলো, “তোমার অহনি যাওয়া দর্কার আছিলো। ডেলিবারির টাইম আগায় আশতাছে!” শেষদিকে কন্ঠে উৎকণ্ঠা!
কিছুক্ষণ নিরবতা! তারপরে তিনজনে উঠে দাঁড়ায়। পিয়ারী মুখ চোখ বেঁকিয়া ক্লান্তিধরা গলায় বলে উঠে, “লও যাই! সাভার থিকা যদি কৈজুরীর পথ কম হইতো তাইলে তো এক বেলার জন্যি যাওয়াই যাইতো। মানুষটারে দেখবার মনি চাতিছে।”
তিনজনে এক সাথে হেঁটে যেতে থাকে।
।।৩।।
রাজা ফ্যাশন হাউজের সামনে বেশ ভিড়। সামনে কয়েকজন শ্রমিক উঁচু গলায় কথা বলছে। “না, আমরা এই ভাংগা বিল্ডিঙে কাজ করুম না। আমরা মইরা গ্যালে আমাগো পোলাপানরে কি আফনে খাওয়াইবেন?”
“হ, অ তো ঠিকই কইছে!”
“আমাগো দাবী মাইনা লন।”
“আগে আমাগোরে কয়দিন ছুটি দিয়া বিল্ডিঙডারে ঠিক করেন, তারপরে আমরা হগলতে কাজ করুম!”
“সাব, আমাগো কতাডা এট্টু চিন্তা করেন!”
ভীড়ের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় বিচ্ছিন্নভাবে একেক জনের গলা ভেসে আসে।
পেছন থেকে পিয়ারী বেগম ক্লান্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কোথাও এট্টু বসতে মনে চায়। এই ভিড়ে কোথায় সে বসবে! আশেপাশে আরো মিলি, রিতা, বেবি, পুতুল, বিপুল, জমির ইত্যাদি নানান শ্রমিকের দিকে চেয়ে অনাগত একটা ভয়ের আভাস দেখা দেয়। শরীরের কোথায় যেন চিন করে শব্দ হয়। আশেপাশের কেউ টের পায়না। পিয়ারী একাই দাঁড়িয়ে অনাগত সন্তানের জন্ম ভাবনায় আপ্লুত হয়।
কিছুক্ষণ পরে …
কতক্ষণ পরে জানে না পিয়ারী। সাথে থাকা আরো অনেক শ্রমিকের সাথে সে শুনতে পায়, “বিল্ডিঙে কিচ্ছু হয়নি। তোমরা ভুল বুঝছো। আর কয়েকদিন কাজ করো। এই সপ্তাহে বিদেশে ডেলিভারী দিতে হবে। ওটা দিয়েই কয়েকদিন তোমাদের ছুটি দেব নে।”
“আগে কাজ করবো, তারপরে ছুটি? এই ছুটি কি আর মিলবো?” পিয়ারীর ভেতরটায় আবারো কিসের ভয় যেন খামচে ধরে।
।।৪।।
‘তুঝে ভুলা দিয়া …রো
তুঝে ভুলা দিয়ারো…ফির কিউ তেরি ইয়াদে…
তুঝে ভুলা দিয়া রো…
তেরি ইয়াদো…
… … …
খুদা তেরা হি ইয়ে ফয়সালা হে…’
মেথু মিয়া মোবাইলটা হাতে ধরে বসে আছে। গান বাজছে মোবাইলে। একই গান বার বার বেজে চলেছে। শেষ হচ্ছে। আবার শুরু থেকে বাজছে। মেথু মিয়ার খুব পছন্দের গান। পিয়ারী সাধ করে তার গার্মেন্টসের বেতন দিয়ে ওটা কিনে দিয়েছে।
খুব পছন্দের গান তার। গানটা বাজছেই। অবশ্য, এখন এই মুহুর্তে তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না যে সে খুব উপভোগ করছে গানটা। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কিছু যেন ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে। তাকে দেখে মোটেই সুস্থ সুস্থির লাগছে না। তার চোখ দেখে যে কেউ বলবে সে গত বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে ঘুমায়নি।
পোলাডার কষ্ট দেখে পিয়ারীর মায়ের বুকেও কষ্ট খোঁচা দেয়।
আজ দুইদিন ধরে তারা ঢাকা শহরে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তাদের মেয়ে পিয়ারীর লাশ আছে বলে জেনে এসেছে তারা। দুইদিন আগে পিয়ারী যেই জায়গায় কাজ করতো সেই আটতলা ভবনটি হাঁটু মুড়ে বসে পরেছে। আর তার হাঁটুর নিচে চাপা পরেছে ভারী ভারী পোশাক কারখানার জটিল যন্ত্রপাতির নিচে হাজার হাজার নারী পুরুষ শ্রমিক ও অফিসার।
লাশ হস্তান্তরের পর্ব শুরু হয়েছে। অনাগত সন্তান প্রত্যাশী এক বাবা এবং বড়ই পেয়ারের বউয়ের এক জামাই তার ষাটোর্ধ শাশুড়ি মাকে সাথে নিয়ে বেদনার্ত এক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। এইরকম মালিক পক্ষের গাফিলতির কারণে এরকম কত বাপ হারায় তার সন্তান ও প্রিয় বউকে। সংসারের একমাত্র সুখের বন্ধনটিও হারিয়ে যায় কিছু মানুষের এক সপ্তাহের বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের লোভের কাছে এইরকম হাজারো পিয়ারী হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। এক অন্ধকার এসে ঢেকে দেয় এঁদের অন্তরকে। সেই অন্ধকার কেটে কবে ভোর আসবে তা জানে না মেথু মিয়ারা।
(সমাপ্ত)
[রানাপ্লাজা ধ্বসের সময় রচিত]
৬টি মন্তব্য
হালিমা আক্তার
অসাধারণ গল্প। পিয়ারীদের কথা কেউ মনে রাখেনা।পিয়ারীরা হারিয়ে যায় সময়ের সাথে সাথে। শুভ কামনা।
মনির হোসেন মমি
গল্প যেন বাস্তব জীবনের ছবি। কত শত পিয়ারী গং যে অবহেলায় অনাদর হার ভাঙ্গা পরিশ্রমে ঝরে যায় তা আর বলার অপেক্ষা রাখেন না। চমৎকার প্লট ।
সৌবর্ণ বাঁধন
গল্পের বলার ভংগী অনেক সুন্দর। বর্ণনায় সাবলীলতা এই গল্পের সবচেয়ে বড় সাফল্য। সহজ ভাষায় তুলে ধরার মধ্যে রয়েছে মুন্সীয়ানা। শুভেচ্ছা নিবেন আপু।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
তোমার গল্প পড়ে রানা প্লাজার কথা মনে পড়ে গেল। পিয়ারীরা এভাবেই প্রিয় মানুষ থেকে ছিন্ন হয়ে যায় কারো অতি লোভের কারণে। অনাগত সন্তানের মুখ দেখা হয় না নিষ্ঠুর নিয়তির জন্য। ভালো থেকো সুস্থ থেকো।
আরজু মুক্তা
শ্রমিকের লাশে চাপা পরে আদর সোহাগ ভালোবাসা।
মন ছোঁয়া গল্প
সাবিনা ইয়াসমিন
রানা প্লাজার ভয়াবহ স্মৃতি মনে পড়লে এখনো আঁতকে উঠি। সেদিন সেই পথ দিয়েই এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ফিরছিলাম। অল্পের জন্যে এক্সিডেন্ট থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেদিনের শকড ভুলতে অনেক দিনরাত পার করতে হয়েছে।
গল্পটি মর্মস্পর্শী, যদিও গল্প। তবে হাজারো মানুষের ভেতরে কারো না কারো জীবনে সেদিন এমনই কিছু হয়েছিলো। হয়তো কেউ এমন স্মৃতি নিয়ে আজও নিভৃতে কাঁদে। দুর্ঘটনায় মৃতদের আত্মার শান্তি কামনা করি।
আপনি ভালো থাকুন, আরও লিখুন।
শুভ কামনা 🌹🌹