
সুন্দরবনকে প্রকৃতির রানী বললে ভুল হবে না। কেওড়া আর গোলপাতায় ঘেরা সুন্দরবন। ‘আমাদের সুন্দরবন’ বইয়ের লেখক ফরিদী নুমান সুন্দরবনের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন যে, বিশাল, বৃহৎ, বিস্তীর্ণ, নীরব, নিথর, নিস্তব্ধ, শ্বাপদ-সংকুল ভয়াল, রোমঞ্চকর, চির রহস্যাবৃত এক বন। পৃথিবীর বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন। সাধারণের কাছে বাদাবনখ্যাত এই বন সত্যিই অনুদঘাটিত এক রহস্যের নাম, অপার বিস্ময়! অসম্ভব-অস্বাভাবিক রূপের আঁধার এই বনকে যিনিই দেখেছেন, তিনিই তার প্রেমে মজেছেন।
একবার ভাবুন তো এমন বর্ণনাময় সুন্দরবনে কার না যেতে ইচ্ছে করে? আমারও শখ বা সাধ জেগে উঠেছিলো সুন্দর বনের সৌন্দর্য নিজ চোখে দেখার জন্য। লেখক ফরিদী নুমানের হাত ধরেই প্রথম সুন্দরবন যাই। আমরা সুন্দরী খালের পাশ দিয়ে জাহাজ নিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমাদের এক সতীর্থের নজরে পড়ে এই পাখিটি। জীবনের প্রথম দেখলাম পাখিটিকে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই জাহাজ থেকে নেমে নৌকায় চড়ে বসলাম। ধীর গতিতে নৌকার মাঝি নৌকা নিয়ে পাখিটির দিকে ছুটছেন। দূর থেকেই পাখিটিকে ফোকাস করে একটি শট নেই। তারপর ধীরে ধীরে সামনের দিকে অগ্রসর হই। সবাই পিনপতন চুপ। কারো সঙ্গে কারো কথাবার্তা নেই। আমাদের দেখে পাখিটিও সামনের দিকে পানিতে ভেসে অগ্রসর হতে থাকে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বনের ভিতর ঢুকে যায়। ততক্ষনে আমরা সবাই বেশ কয়েকটি ছবি তুলি। সুন্দরবনের স্থানীয় মাঝি ও জেলেদের কাছে এই পাখি ‘সুন্দরী হাঁস’ বা ‘গেইলো হাঁস’ নামে পরিচিত। যদিও হাঁসের ঠোঁট ও পায়ের সঙ্গে এই পাখিটির কোন মিল নেই, তাই কেউ যেন না ভাবেন এটা হাঁস প্রজাতির পাখি। তারপরও আমি আঞ্চলিক নামটিই ব্যবহার করি।
সুন্দরী হাঁস বা গেইলো হাঁস Heliornithidae পরিবারের অন্তর্ভূক্ত মাঝারি আকারের ৫৬ সে.মি. দৈর্ঘ্যের একটি জলচর পাখি। এরা খুবই লাজুক স্বভাবের। নিজেদের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সুন্দরবনে লুকিয়ে থাকে। এদের গলা লম্বা। ঠোঁট মোটা। অনেকটা বাঁকানো ও খুব শক্তিশালী। এদের পিঠ জলপাই-বাদামী। বুক থেকে দেহের নিচের অংশ ফিঁকে-সাদা রঙের। দেহের অন্যান্য পালক জলপাই-বাদামী হয়। পায়ের আঙুলের পাতায় পর্দা এবং লেজে নরম পালক থাকে। সাদা ডোরা চোখের পশ্চাৎ থেকে ঘাড় পর্যন্ত কালো-বাদামী রং দেখা যায়। চোখের পাতা মোটর দানার মতো সবুজ। ঠোঁট উজ্জ্বল হলুদ। পা ও পায়ের পাতা মোটর দানা সবুজ। পা শক্তিশালী ও খাটো। আঙুলে পাতা-পর্দা আছে। পুরুষ ও মেয়েপাখির চেহারায় ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। পুরুষপাখির কপাল, গলা ও ঘাড়ের উপরের অংশ কালো। অথচ মেয়েপাখির গলা নিচে ও ঘাড়ের উপরে সাদা রঙের হয়ে থাকে। অপ্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও মেয়েপাখির চেহারায় ভিন্নতা নেই। শুধুমাত্র পুরুষপাখির কপাল ধূসর বর্ণের হয়।
সুন্দরী বা গেইলো হাঁস সুন্দরবনের খাল ও চিরসবুজ বনের হ্রদে বিচরণ করে। এরা বেশিরভাগ সময় একাই থাকে। তবে জোড়ায়ও দেখা যায়। আমাদের দেশে সংখ্যায় খুবই কম। শুধুমাত্র সুন্দরবনের খালে অল্প কয়েকটা দেখা যায়। এরা কাদায় হেঁটে বা অগভীর পানিতে সাঁতার কেটে খাবার খায়। এদের খাদ্যতালিকায় থাকে মাডস্কিপার, ছোট মাছ, জলজ নোনা পোকা, শামুক ও অমেরুদণ্ডী প্রাণী। শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে অনেক সময় পানিতে ডুব দিয়ে থাকে বা তড়িৎ গতিতে দৌড় দিয়ে বনের ঝোঁপের ভিতর লুকিয়ে যায়। খাবার শেষে পানির উপর ঝুলন্ত ডালে বসে এরা বিশ্রাম করে। মাঝে মাঝে হাঁসের মত উচ্চ স্বরে ডাকে।
প্রজননকালে এদের ঠোঁটের গোড়ায় মাংসের টুকরার মত শিং গজায়। জুলাই থেকে আগস্ট মাস এদের প্রজনন সময়। প্রজননকালে পানি ও কাদা মাটি থেকে ৬-৯ ফুট উচ্চতায় গাছের ডালে ঘন পাতার আড়ালে ডালপাল দিয়ে গোল করে কাকের মত নিজেরাই বাসা বানায় ও ডিম পাড়ে। একসঙ্গে ৫-৬টি ডিম পাড়ে। নিজেরাই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। পুরুষ ও মেয়েপাখি মিলিতভাবে ছানার পরিচর্যা করে।
পৃথিবীতে এই পরিবারের ৩ প্রজাতির পাখি আছে। তার মধ্যে বাংলাদেশে ১ প্রজাতি পাওয়া যায়। বাংলাদেশে Heliopais sharpe গোত্রের সুন্দরী হাঁস পাওয়া যায়। এরা আমাদের দেশে দূর্লভ আবাসিক পাখি। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ‘গেইলো হাঁস’ খুলনা বিভাগের সুন্দরবনে দেখা যায়। সুন্দরবন ছাড়া দেশের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এ ছাড়াও উত্তর-পূর্ব ভারত, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় এদের দেখা যায়। এই পাখি বিশ্বে সংকটাপন্ন ও বাংলাদেশে বিপন্ন পাখি হিসেবে বিবেচিত।
বাংলা নাম: সুন্দরী হাঁস বা গেইলো হাঁস
ইংরেজি নাম: Masked Finfoot
বৈজ্ঞানিক নাম: Heliopais personata
ছবিগুলো ২০১৭ সালে সুন্দরবন থেকে তোলা।
১৫টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
এ ভাবেই আমরা আপনার সাথে থেকে সুন্দরী সুন্দর বনকে ক্রমান্বয়ে
খুঁটে-খুড়ে দেখতে থাকব।
এই বিপন্ন প্রজাতির হদিস কেমনে পেয়ে গেলেন কে জানে!!
আপনারা ভাগ্যবান।
নুমান ভাই সাথে ছিলেন! কৈ ছবিতে ত ঠাহর করতে পারিনি!
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ হেলাল ভাই। এটা ফরিদী নুমান ভাইয়ের সাথেই তোলা। জ্বী উনিও সাথে ছিলেন। ঠিকই বলেছেন ঐ গ্রুপে আমরা ৮ জনই ভাগ্যবান ছিলাম। আর সম্পর্ক নুমান ভাইয়ের সাথে উনি আমার শ্যালক। আমি উনার ভগ্নিপতি। হা হা হা…!!
শাফিন আহমেদ
আপনি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় আর পাখি নিয়ে যে আপনার বিস্তর জ্ঞান রয়েছে সেটা লেখা পড়লেই বোঝা যায় । বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতিগুলো সম্পর্কে আরও জানতে চাই। শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ ভাই।
শাহরিন
নতুন নতুন অনেক কিছু জানছি আপনার মাধ্যমে। অনেক ধন্যবাদ।
শামীম চৌধুরী
আপনার জন্য রইলো শুভ কামনা।
মনির হোসেন মমি
সুন্দরী হাঁস বা গেইলো হাঁস সম্পর্কে এ ভাবে বর্ননা না বললে বুঝতাম হয়তো একটি সাধারণ অন্যজাতের হাস।ধন্যবাদ ভাইয়া।কতকিছুই না জানছি আপনার কাছ থেকে। আমিও এই প্রথম কেবল ছবিতে এ জাতি পাখি দেখলাম।
শামীম চৌধুরী
একবার সাথে চলুন মমি ভাই। নিজ চোখে সব দেখে ও জেনে আসবেন।
আরজু মুক্তা
সুন্দরবনের অজানা রহস্য।
ভালো লাগলো।
শামীম চৌধুরী
আসলেও মুক্তা আপু সুন্দরবন একটি রহস্যময়।
তৌহিদ
নামটাইতো কি সুন্দর!! গেইলো হাঁস, এতদিন জানতাম শিং হয় শক্ত খোলসের। এখন জানলাম শিং মাংসের মতনও হয়!! কত অজানা জিনিস জানতে পারছি আপনার লেখায় শামীম ভাই। যদি কখনো সুযোগ হয় অবশ্যই আপনার সাথে সুন্দরবন যাব।
শুভকামনা রইলো ভাইয়া।
শামীম চৌধুরী
সঙ্গী হবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম ভাই।
সাবিনা ইয়াসমিন
আপনি জীবনে প্রথম এই পাখিটি দেখেছেন ! এতেই বোঝা যায় পাখিটি কতটা বিরল প্রজাতির। সুন্দরবন প্রকৃতি ও প্রানী বৈচিত্রের এক বিশাল ভান্ডার। আমরা ভাগ্যবান, বিশ্বের অপার বিস্ময় এই বনটি আমাদের দেশে রয়েছে। সময় ও সুযোগ পেলে হয়তো কোনদিন খুব কাছথেকে দেখতে পাবো। তবে আমাদের দেখা-জানার আকাঙ্ক্ষা আপনি পূরণ করছেন আপনার পোস্টের মাধ্যমে। কত কিছু জানতে পারছি, দেখতে পারছি। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ ভাইজান।
ভালো থাকবেন, শুভ কামনা 🌹🌹
শামীম চৌধুরী
আমার অক্লান্ত পরিশ্রম আপনাদের জানার ও ভালো লাগার সবায়ক বলে যখন আপনাদের কাছ থেকে প্রশংসা পাই তখন সত্যিই আপু কাজের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দেয়। দোয়া করবেন আমার জন্য।
জাহিদ হাসান শিশির
সুন্দর