শপিংমলে প্রয়োজনীয় পোশাক কিন্তে গেলে তাড়াহুড়ায় মনের ভুলে একজোড়া হাতমোজা আর পা মোজা কিনে ফেলি। যেগুলো পড়লে অনেক গরম লাগবে। অনেক গরম ! অতঃপর একদিন ক্লোজেট গুছাতে গিয়ে সেই মোজাগুলো দেখে তীব্র মন খারাপ হয়। হাতে নিয়ে বসে থাকি। গন্ধ শুঁকি। নতুন মোজার গন্ধ পাই না। আমার বাবার গায়ের মিষ্টি গন্ধ পাই। অনেকদিন হয় ফোনের ওইপাশ থেকে কেউ বলে না___ “কেউ দেশে এলে আমার জন্য অনেক মোটা দেখে একজোড়া হাতমোজা আর পা মোজা পাঠাইস… অবশ হাত আর পা দুইটা হিম হইয়া থাকে… এইগুলা পরলে অনেক ভাল লাগে, আরাম লাগে …”
প্রয়োজনীয় ওষুধের রিফিল আন্তে ফার্মেসিতে গেলে ফার্মাসিস্ট মেয়েটি পনর মিনিট অপেক্ষা করতে বলে। আমি ঘুরে ঘুরে ওষুধের আইল দেখি। থরে থরে সাজানো ওষুধগুলো দেখি। ভিটামিন, ক্যালসিয়ামের কৌটার দিকে চেয়ে থাকি ক্ষণিক। এক্সপায়ার ডেট দেখি অযথাই। অনেকদিন কেউ বলে না___ ” আমার ওষুধ প্রায় শেষের দিকে… কেউ আসলে পাঠাইয়া দিস্ মনে করে… এইগুলি খাইলে শরীরে শক্তি পাই…।” আমি বুঝি, বয়স হলে মেডিসিন যতটা শারীরিক শক্তি যোগায়, তার চেয়েও বেশি মনোবল বাড়ায়…
প্রায়ই ভোরের দিকে ঘুমের ঘোরে বালিশের তলায় হাত্ড়ে হাত্ড়ে খুঁজে বেড়াই একটি আধুলি। যেদিন খুব ভোরে বাবা ব্যবসায়িক কাজে ঢাকায় যেতো, ঘুমন্ত আমার বালিশের নিচে একটি আধুলি রেখে যাওয়া চাই-ই-চাই…। প্রতি শুক্রবার দুপুরবেলায় নিউইয়র্কে রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে দেখি অনেককেই পাঞ্জাবী-টুপি পরে। পাঞ্জাবী-টুপি পরিহিতা বৃদ্ধ কাউকে হেঁটে যেতে দেখ্লে চেয়ে থাকি অর্থহীন ভাবে, যতক্ষণ না তিনি দূরে আরো দূরে দৃষ্টিসীমায় মিলিয়ে যান…
এই তো সেদিন, আমার মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় যাচ্ছিলাম আমরা পিতা-কন্যা। যদিও শরীরে চলাফেরার শক্তি নেই এতোটুকু, তবুও মনের জোরে বললেন, “তুই সাথে থাকলে আমি পৃথিবীর সবখানে যাইতে পারুম।” আমরা লঞ্চে একটি কেবিন ভাড়া নেই। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। কখনো প্যারালাইজড হাতখানা হাতে নিয়ে ম্যাসেজ করে দেই। বাবা শুয়েছিলেন পুরোটা পথ। তিন ঘণ্টার পথটুকুতে পুরোটা সময় বলে গেলেন গোটা একটা জীবনের উত্থান-পতনের গল্প। পিতৃহীন ছোট্ট একটি বালক কেমন করে মাইলকে মাইল পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতো… কেমন করে একটু একটু করে উপরে উঠে এলো __ সেইসব গল্প। যদিও তাঁর বখে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল, তবুও তিনি বেছে নিলেন সুশৃঙ্খল জীবন। অসীম মনোবলে নিজের চেষ্টায় উঠে এলেন। উপরে উঠার রাস্তাটা তো তৈয়ার ছিল না তখন। খাড়া পাহাড়ে উঠা যে কি জিনিষ ! বহুত দম লাগে… বহুত তেজ লাগে ! …… এমন একটি আবৃত্তি শুনেছিলাম ক’দিন আগে। একবার… দু’বার… বারবার। এটি শুনে কেউ অশ্রু সংবরণ করতে পেরেছে কিনা জানিনা। আমি পারিনি…
আজ হাতমোজা, পা মোজাগুলো বাসার পাশেই একজায়গায় দিয়ে এলাম। এগুলো দেখলে প্রচণ্ড মনখারাপ হয়। কেউ, কোন বৃদ্ধ আসছে শীতে এগুলো পরুক। হিম হয়ে আসা হাতগুলো, পা গুলো উষ্ণতা পাক। তাঁর ভালোলাগার মাঝে, আরাম বোধের মাঝে আমার বাবার জন্য প্রার্থনা হোক অন্তরের ভেতর থেকে…
## প্রতিনিয়ত এমন টুকরো টুকরো স্মৃতির মাঝে বাবা’রা মিশে থাকেন সন্তানদের দৈনন্দিন জীবনে… অনুভবে…
আজ বাবা দিবস। আমার বাবা নেই। 🙁
২৪টি মন্তব্য
আজিম
বাবাকে খুব ভালবাসেন আপনি, আপনার আগের লেখাগুলো থেকেও জেনেছি।
আপনার মত বাবাকে যারা অন্তর দিয়ে ভালবাসেন, দেখেছি জীবনে তারা সুখী হন, ভাল থাকেন।
বরাবরের মতই অনেক দরদী লেখা।
ছাইরাছ হেলাল
আর একটি অক্টোবরের বেশি দেরি নেই।
পথ ভুলে না তো।
রিমি রুম্মান
অক্টোবরে বিশেষ কিছু ?
রিমি রুম্মান
আমার বাবা সহজ সরল সংগ্রামী মানুষ ছিলেন। কঠিন যুদ্ধ করেছেন জীবনের সাথে, বাস্তবতার সাথে। আমাদের সর্বোচ্চ ভাল রেখেছেন। ভাল থাকবেন। শুভকামনা।
ছাইরাছ হেলাল
বাবাকে এর থেকে ভাল করে উপস্থাপন করা মনে হয় সম্ভব নয়।
চির শান্তিতে থাকুন তিনি।
রিমি রুম্মান
দোয়া রইলো আপনার আমার আমাদের সকলের বাবাদের জন্যে।
জিসান শা ইকরাম
লেখাটি পড়ে কিছুটা বিষণ্ন্নতায় আমি।আমারও বাবা নেই।বাবাকে কোনদিন বাবা দিবসের শুভেচ্ছা জানানো হয়নি।তিনি যখন ছিলেন,তখন দিবস ছিল না।
বাবারা থাকুক আমাদের স্মৃতির মাঝে অত্যন্ত সতেজ হয়ে।
রিমি রুম্মান
বাবাদের জন্য একটি দিন। ৩৬৫ দিনের একটি দিন মহিমান্বিত হয়ে থাকুক বাবাদের সন্মানে।
খেয়ালী মেয়ে
বাবার জন্য সব ছাড়তে পারি আমি, কিন্তু বাবাহীন এই শব্দটা মানতে পারবো না কখনো– আপনাদের লেখা পড়ে আপনাদের মতো করে লিখতে ইচ্ছে করে–কিন্তু বাবাকে নিয়ে এমন লেখা কখনো লিখতে চাই না………..
রিমি রুম্মান
এমন লেখা লিখতে না হোক কাউকে … লিখতে গেলে কলম ভারী হয়ে আসে … বুকের ভেতর পাথর চেপে আসে … কলম এগোতে চায় না …
ব্লগার সজীব
শুভেচ্ছা সকল বাবাকে। আপনি সব সময় ভাল লেখেন।
রিমি রুম্মান
ভালো থাকবেন … ধন্যবাদ আপনাকে
তানজির খান
একদম আমার অনুভূতি। অসাধারণ লিখেছেন। আজ আট বছর হলো আব্বাকে হারিয়েছি। এই কষ্ট কাউকে বোঝানও যায় না। অনেক ভাল লিখেছেন।
রিমি রুম্মান
ভালো থাকবেন … সকল বাবাদের জন্য দোআ রইলো
নীলাঞ্জনা নীলা
আমার চাকরী জীবনের শুরুতে প্রথম ক্লায়েন্ট যাকে আমি মাম্মা বলে ডাকি। একদিন মাম্মার স্বামী আমার সামনে এসে বলে আমাকে পাপা বলে ডাকতে হবে। আমার জন্মদাতা বাবাকে বলেছি সে কথা। পাপা’র জন্যে একটা কার্ড কিনেছি, মঙ্গলবারে গিয়ে দেবো। অদ্ভূত লাগে আমার দুটো বাবারই চরিত্রে বেশ মিল দেখে।
বাবাহারা জীবন কাউকে যেনো দেখতে না হয়।
রিমি রুম্মান
বাবাহারা জীবন বাবা নেই যার , সে ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারে না। তবুও বলি, এমনটি না হক। বাবারা বেঁচে থাকুক। ভাল থাকুন।
মেহেরী তাজ
মন খারাপ করা লেখা।
ভালো থাকুক আপনার বাবা যেখানে আছেন সেখানেই।
ভালো থাকুক পৃথিবীর সব বাবা তাদের নিজ নিজ অবস্থানে।
রিমি রুম্মান
আমি যখন নামাজে সেজদা দেই, মাটির বুকে বাবার বুকের স্পন্দন খুঁজে বেড়াই। মনে হয়, এই মাটির বুকেই তো ঘুমিয়ে আছে প্রিয় মানুষটি।
লীলাবতী
মনের কথাগুলো কত সহজ আর নিপুন ভাবে লিখতে পারেন আপু।মনে হয় এ যেন আমারই কথা।সকল বাবারা ভাল থাকুক।আপনার বাবাকে আল্লাহ বেহেশত নসীব করুন।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনিও। ভাল থাকুক সকল বাবা।
শুন্য শুন্যালয়
বাবাকে ঘিরে এমন অনুভূতি গুলো সবসময় তাজা থাকে, কখনও হারায় না, হারাবেও না।
আপু সব লেখায় তার আবেগ কিভাবে যেন এনে ফেলেন।
ভালো থাকুক বাবা, আর বাবার জন্য মেয়ের এমন আকুতি।
রিমি রুম্মান
সব ব্যস্ততা শেষে ক্ষণিক অবসর মেলে যদি, সামনে এসে দাঁড়ায় আমার বাবাময় শৈশব। মা চাকুরীজীবী ছিলেন। বাবা ব্যবসায়ের পাশাপাশি আমাদের দেখা শুনা করেছেন বেশি। বলা যায়, আমাদের খাওয়ানো, গোসল করানো, ঘুম পাড়ানো সবই করেছেন বাবা। তাই বাবাকে নিয়ে স্মৃতি গুলো বেশি কাঁদায়। ভাল থাকবেন।
প্রজন্ম ৭১
বাবাকে ভাল ভাবেই তুলে এনেছেন।আপনার লেখা খুবই টাচি।বাবার আত্মা শান্তি পাক।
রিমি রুম্মান
সরল সংগ্রামী একজন বাবা ছিলেন আমার বাবা। তাই ঘুরে ফিরে সব লেখা বাবাকে ছুয়ে যায়।